বাংলাদেশের মানচিত্রের সর্ব পশ্চিমের জেলা শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জ [2]। এই জেলার গ্রামের বাড়িগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তা হলো, বাড়িঘরগুলো মাটির তৈরি। আর দেয়ালজুড়ে রঙিন আল্পনা আঁকা। জেলার টিকোইল গ্রামের বাড়িঘরের দেয়ালও আল্পনার ক্যানভাস। টিকোইল তাই পরিচিতি পেয়েছে আল্পনার গ্রাম [3] হিসেবে।
বাংলা নববর্ষ [4] উদযাপন উপলক্ষ্যে টিকোইল গ্রাম ও আল্পনা শিল্পীদেরকে উপজীব্য করে দেশের বৃহত্তম রং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড একটি ডকু বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। বিজ্ঞাপনটিতে শিল্পীরা দেয়াল আল্পনার কাজে যে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করেন, তার পরিবর্তে সিনথেটিক রং ব্যবহার করতে বলায়, বিজ্ঞাপনটি প্রচার হওয়ার পর থেকেই নেটিজেনরা এটির বিরোধীতা করছেন।
মাটির বাড়ি [6] বাংলাদেশের গ্রামীন ঐতিহ্যের নিদর্শন। সাধারণত, দেশের পাহাড়ি এবং উঁচু অঞ্চলে এর দেখা মেলে বেশি। মাটির বাড়ি বানাতে আঠালো মাটি কাদায় পরিণত করে দেয়াল বা ব্যাট তৈরি করা হয়। এরপর এর উপরে কাঠ বা বাঁশের সিলিং দিয়ে তার উপর খড় বা টিনের ছাউনি দেয়া হয়। অন্যান্য বাড়ির চেয়ে মাটির ঘরে শীত ও গ্রীষ্মকালে বসবাস অনেক আরামদায়ক। বাইরে গরম থাকলে ভিতরে ঠান্ডা; আর বাইরে ঠান্ডা থাকলে ভিতরে গরম থাকে। নওগাঁয় জেলায় একটি মাটির বাড়িতে ১০৮টি কক্ষ রয়েছে।
বরেন্দ্র ভুমি [7] হিসেবে খ্যাত এই অঞ্চলে বাড়িঘরের দেয়ালে আল্পনা আঁকার চল কবে থেকে শুরু হয়েছে, তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। বংশ পরস্পরায় গ্রামের অধিবাসীরা এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন। তবে আল্পনা আঁকার মূল কারিগর হচ্ছেন বাড়ির নারীরা। সাধারণত পূজার সময় অথবা বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আল্পনা আঁকা হয়ে থাকে। শুধু বাইরের দেয়াল নয়, ঘরের ভিতরের দেয়ালেও আল্পনা আঁকা হয়। আল্পনা শিল্পীরা আঁকার যে রং ব্যবহার করেন, তা তৈরি হয় পুরোনো পদ্ধতিতে। এই প্রাকৃতিক রং তৈরি হয় খড়িমাটি, লালমাটি, আতপ চাল সিদ্ধ, চরের বালি, গাছের পাতা দিয়ে।
টিকোইল গ্রামের ঘরবাড়ির আল্পনার ঐতিহ্য তুলে আনতে গিয়ে বার্জার তাদের বিজ্ঞাপনে [8] পরামর্শ দিয়েছে, প্রাকৃতিক রং বেশি দিন টেকে না। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যায়। আল্পনার রং যেন টেকসই হয়, সেজন্য তারা যেন অন্য রং ব্যবহার করে।
বিজ্ঞাপন প্রচার হওয়ার পরপরই অনেকে কৃত্রিম রং ব্যবহার নিয়ে আপত্তি তুলেন। ফ্রিল্যান্স রাইটার ও ফটোগ্রাফার অপু নজরুল [9] লিখেছেন:
সারা পৃথিবী যখন ইন-অর্গানিকের ধ্বংস থেকে বাঁচতে হন্য হয়ে অর্গানিক সোর্স খুঁজছে ঠিক সেই মুহুর্তে টিকোইল গ্রামে গিয়ে বার্জার অর্গানিক সোর্স থেকে রঙ তৈরী করা গ্রামবাসীর হাতে তুলে দিয়েছে নিজেদের সিনথেটিক রঙ। তার ফলে এখন নাকি আর কয়দিন পর পর রঙ করা লাগবেনা, রঙ স্থায়ী হবে৷ কি ভয়াবহ কথা! আলপনা ঘন ঘন আঁকা হতো বলেই না গ্রামবাসী এত দক্ষ হয়ে উঠেছে। স্থায়ী আলপনা বসে গেলে আর প্র্যাক্টিসের সুযোগ কই আর বৈচিত্র্যই আসবে কোত্থেকে?
চৌধুরী রিপন প্রাকৃতিক রং দিয়ে শত বছরের আল্পনা আঁকার ঐতিহ্য ধ্বংস করার সমালোচনা করে টুইট করেছেন:
Poor @BergerPaintsBD [10], can't even write common #চাঁপাই [11] #শিল্পী [12] #বাঙালি [13] spellings rightly, now ridiculously replacing that villagers hundred years #culture [14] of drawing #Alpona [15] using organic colors.#শুভনববর্ষ [16] #টিকোইল [17]#Berger [18] #OVC [19] #Blunder [20] #NuhashHumayun [21] pic.twitter.com/3OtM6ZRg3T [22]
— Chowdhury Ripan (@ripansays) April 8, 2019 [23]
ধিক বার্জারপেইন্টসবিডি। চাঁপাই, শিল্পী, বাঙালি’র মতো সাধারণ বানানগুলোই ঠিক মতো লিখতে পারেন না, আবার এসেছে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে গ্রামের মানুষদের শত বছরের আল্পনার আঁকার ঐতিহ্য প্রতিস্থাপন করতে।
ফারজানা কে তিথি [24] নামের একজন ফেইসবুক ব্যবহারকারী প্রাকৃতিক রং কীভাবে দীর্ঘস্থায়ী করা যায়, সেই প্রযুক্তি নিয়ে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
শুধু টিকোইল নয়, ওই অঞ্চলের আরো অনেক গ্রামেই এরকম আল্পনা করা ঘরবাড়ির দেখা মেলে। যেমন টিকোইলের পাশের গ্রাম গোসাইপুর। সে গ্রামেও দেখা মিলে এমন আল্পনা আঁকা ঘরবাড়ির। ব্লগার, পরিব্রাজক, পর্বতারোহী তারেক অণু গোসাইপুরের নকশা করা ঘরবাড়ির ছবি [25] শেয়ার করেছেন ফেইসবুকে। তার অনুমতি নিয়ে কিছু ছবি এখানে ব্যবহার করা হলো।
বারজার কোম্পানি এই সমালোচনার কোন জবাব এখনো দেয়নি। তবে তারা এবছর পয়লা বৈশাখে ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভেনিউতে নবীন ও প্রবীণ শিল্পীদের ৩ লাখ স্কয়ার ফুট লম্বা আলপনা আঁকার প্রোগ্রাম এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন [30] ।