- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

বিরিয়ানির গল্পঃ সুস্বাদু এই খাবারের উৎসের সন্ধানে

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, ভারত, ইতিহাস, খাদ্য, নাগরিক মাধ্যম, শিল্প ও সংস্কৃতি
[1]

ভারতের হায়দ্রাবাদ শহরের সড়কে বিক্রি হওয়া মুরগীর মাংসের বিরিয়ানি। ছবি ফুটপ্লেটের যা উইকিমিডিয়া কমন্সের মাধ্যমে নেওয়া । সিসি বাই এসএ ৪.০

বিরিয়ানি সংক্রান্ত এই আমাদের দ্বিতীয় প্রবন্ধ “বিরিয়ানির উৎস” নিয়ে যা দক্ষিণ এশিয়ার এক অতি পরিচিত এক খাবার। এই পর্বে আমরা ভারতে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন যে সুস্বাদু বিরিয়ানি পাওয়া যায় তার অনুসন্ধান করব।

যখন বিরিয়ানির [3] উৎপত্তি নিয়ে এক বিতর্ক চলছে এই নিয়ে যে দক্ষিণ এশিয়ার এই জনপ্রিয় খাবার পারস্য (বর্তমান ইরান) থেকে উদ্ভূত কি না, তার ইতিহাস আমাদের ধারণা দিচ্ছে যে চালের সাথে অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে তৈরি বিরিয়ানির জনক ভারতীয় উপমহাদেশ [4] এর মুসলমানেরা-যা ভারত বিখ্যাত মোগলাই খাবারের [5] অংশ।

তবে এতে এই শক্তিশালী যুক্তিকে [6] খণ্ডন করা যায় না যে বিরিয়ানী পারস্য থেকে আসতে পারে। বিরিয়ানি শব্দটি এসেছে ফার্সি বিরিয়ান শব্দ থেকে, যার মানে হচ্ছে রান্নার আগে ভেজে নেওয়া। তবে বর্তমান কালে ইরানের সড়কে যে ধরনের বিরিয়ানি বিক্রি হয় সেখানে এখন আর চালের ব্যবহার হয় না [7], তার বদলে এটি মাংসের এক খাবারে পরিনত হয়েছে যা এক কাগজের মত পাতলা পাউরুটির ভিতরে ভরে পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও হতে পারে যে এই খাবার বিভিন্ন পরিব্রাজকের মাধ্যমে [8] মধ্য এশিয়া থেকে ভারতের দাক্ষিণাত্য নামক অঞ্চলে এসে হাজির হয়।

বর্তমানে উপমহাদেশে যে ধরনের বিরিয়ানি পাওয়া যায় সেগুলোর উদ্ভব ১৫ শতক থেকে ১৯ শতকে, মূলত মুঘল সাম্রাজ্যের সময় [9]

বিরিয়ানির উৎপত্তি ও যাত্রা

রান্না এবং রান্নায় বিভিন স্বাদ আনার ক্ষেত্রে ভারত এক বৈচিত্র্যময় দেশ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভারতের উত্তরের বিভিন্ন রকমের খাবার যা মোঘল রন্ধন প্রণালী রান্নার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল যেমন দম পোখত [13] (একটি মুখ ঢাকা পাত্রে ধীরে ধীরে রান্না করা) এবং ঘি দিয়ে রান্না [14], পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতের নাগরিকেরা বিরিয়ানিতে অধিক পরিমাণ সব্জি, চাল এবং সামুদ্রিক মাছ জাতীয় উপাদান ব্যবহার করে।

উত্তর এবং মধ্য ভারতের বিরিয়ানি

ভারতের অন্যতম এক জনপ্রিয় বিরিয়ানি হচ্ছে লক্ষ্মৌ বিরিয়ানি [15], যা ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজধানী শহর লক্ষ্মৌ এর নামে পরিচিত। স্বাদে ও গন্ধে এই বিরিয়ানি অন্যতম এক সেরা বিরিয়ানি হিসেবে বিবেচিত। এর রং হালকা এবং এতে স্বল্প পরিমাণে মশলা ব্যবহার করা হয়।

হায়দ্রাবাদের সুস্বাদু মুরগীর বিরিয়ানি

হায়দ্রাবাদের দম বিরিয়ানি [28] যা মুঘল এবং ইরানী রান্নার সংমিশ্রণে তৈরি করা হয় [29]। দম বিরিয়ানির উৎপত্তি মুঘল সুবেদার আসিফ ঝা এর সময় যিনি ১৮ শতকে হায়দ্রাবাদের নিজাম [30] হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার রাজকীয় রসুইরা ঘরের রাঁধুনীরা মাংসকে রান্নার আগে রাতভর মসলায় মাখিয়ে নিত এবং লম্বা দানার সুগন্ধি বাসমতি চালের সাথে মিশিয়ে দেওয়ার আগে দইয়ের মাঝে রেখে তারপর এই মিশ্রনটিকে ভালভাবে ঢাকনা দিয়ে মুখ বন্ধ করা একটি পাত্রে [31] রান্না করা হত। একেই বলা হয় দম পোখত [13] পদ্ধতির রান্না, যাতে বিরিয়ানির সর্বোৎকৃষ্ট স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যায়।

হায়দ্রাবাদ এ কিছু ভিন্ন স্বাদের বিরিয়ানিও পাওয়া যায়, বিশেষ করে দুধের বিরিয়ানি [32] যা হায়দ্রাবাদের মসলাযুক্ত দম বিরিয়ানির ঠিক উল্টো; কারণ এটি মাখন মাখানো দুধের সাথে ভাজা বাদাম এবং অতি সামান্য পরিমাণ মসলায় এই বিরিয়ানি রান্না করা হয় যার কারণে এটি হালকা স্বাদের এক বিরিয়ানী।

দক্ষিণ ভারতের বিরিয়ানি

ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলে বিরিয়ানি রন্ধন প্রণালী একটু ভিন্ন, যার সাথে যুক্ত হয়েছে স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য নানান ধরনের সব্জি ও সামুদ্রিক মাছের মত খাবারের উপাদান। এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ভাটকাল অঞ্চলের ভাটকালী বিরিয়ানি [33]। কর্নাটকের এক ক্ষুদ্র উপকূলীয় শহর। এই বিরিয়ানি রান্নার জন্য মাংস, মসলা এবং চাল আলাদা আলাদা রান্না করা হয়, আর এই রান্নায় কোন তেল বা ঘি ব্যবহার করা হয় না, ঠিক পাতে দেওয়ার আগ মূহুর্তে সবগুলোকে একসাথে মেশানো হয়।

আরও দক্ষিণে গেলে রয়েছে ম্যাঙ্গালোর, যা কর্নাটকের এক উপকূলীয় শহর । সেখানে সামুদ্রিক বিভিন্ন উপাদান [34] দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করা হয়। এখানকার পাক্কি বিরিয়ানি, যেটি আধা সিদ্ধ মাছ চালের সাথে মিশিয়ে মুখ বন্ধ এক হাড়িতে চড়িয়ে হালকা আঁচে রান্না করা হয়। এতে মশলা হিসেবে সাধারণত মৌরি এবং ধনিয়ার ব্যবহার করা হয়, আর এই বিরিয়ানিতে লম্বা দানার বাসমতি চালের বদলে স্থানীয় বিভিন্ন রকমের চাল ব্যবহার করা হয়।

তামিলনাড়ুর আরকোট এলাকার আমবুর বিরিয়ানি [35] যা কিনা মূলত পাক্কি বিরিয়ানির [36] (যেখানে চাল আলাদা ভাবে রান্না করা হয়) স্টাইলে তৈরি হয়। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে আকারে ছোট দানার সিরাগা সাম্বা নামের চাল ব্যবহার করা হয়।

কেরালার একেবারে দক্ষিণে থালাসারি বিরিয়ানিতে [37] জিরাকাসালা নামে এক ধরনের স্থানীয় চাল ব্যবহার করা হয়, যা মাংসের সাথে একসাথে না মিশিয়ে আলাদা করে রান্না করা হয়। বিরিয়ানিতে স্বাদ ও সুগন্ধ যোগ করার জন্য সাথে মেশানো হয় কেরালার বিশ্ববিখ্যাত মসলাগুলো [38] আর পরিবেশনের পূর্বে এর উপর ভাজা পেঁয়াজ, কাজুবাদাম এবং কিসমিস সাজিয়ে দেয়া হয়। কোজিকোড বিরিয়ানিতে [39] (কালিকট বিরিয়ানি) খিয়ামা চাল ব্যবহার করা হয় এবং এটিতে মসলার স্বাদ আনার জন্য কেরালার নিজস্ব মশলাগুলো যুক্ত করা হয়।

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিরিয়ানি

ভারতের উত্তর পূর্বাংশের সিন্ধি গুজরাটি সম্প্রদায়ের মেমোনি সম্প্রদায়ের রয়েছে মেমোনি বিরিয়ানি [40], যা কিনা ভেড়া মাংস, দই, ভাজা পেঁয়াজ এবং আলু দিয়ে তৈরি করা হয়; সাথে থাকে সামান্য টমেটো। পাকিস্তানী বিখ্যাত সিন্ধি বিরিয়ানির সাথে পার্থক্য হচ্ছে এতে সামান্য টমেটো দেওয়া হয়। পশ্চিম ভারতের বোহরি বিরিয়ানি [41] রান্নায় দম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, চাল ভিজিয়ে এবং ধোঁয়ায় রান্না মাংস সহযোগে এটি রান্না করা হয়।

পশ্চিম বাংলার কলকাতা বিরিয়ানি [42] দেখতে লক্ষ্মৌ বিরিয়ানির মত, কিন্তু স্বাদে খানিকটা আলাদা, এতে কম মশলা এবং সাথে আলু আর ডিম দেওয়া হয়।

এছাড়াও ভারতে উত্তরপূর্বে পাওয়া যাবে কামপুরি বিরিয়ানি [43], যা বিভিন্ন উপাদানের এক বৈচিত্র্যময় বিরিয়ানি। এটি আসামের মুসলমান জনসংখ্যা অধুষ্যিত কামপুর [44] শহরে পাওয়া যায়। প্রথমে মুরগী আলাদা ভাবে মটরশুটি, গাজর, শিম, আলু ও ক্যাপসিকাম নামের খানিকটা কম ঝাল মরিচ দিয়ে রান্না করা হয় সাথে খুব সামান্য পরিমাণ এলাচ ও জয়ফল দেওয়া হয়, তারপর বাসমতি চাল দিয়ে হালকা আঁচে এটি রান্না করা হয়।

রাস্তার খাবার ও মন্দিরের প্রসাদ হিসেবে বিরিয়ানি

ঐতিহ্যবাহী মুঘল বিরিয়ানি রান্না হত মাংস সহকারে আর কঠোরভাবে নিরামিষভোজী হিন্দু সভাসদের পক্ষে এই খাবার গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। আর তাই তাদের জন্য ছিল তেহেরি নামের আরেকটি খাবার, যাতে মাংসের বদলে থাকতো আলু ও অন্যান্য সবজি। বিরিয়ানির এই নিরামিষভোজী সংস্করণ ও পরম উপাদেয় খাবার এখনো কাশ্মীর ও উত্তর প্রদেশ রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিক্রি হওয়া এক জনপ্রিয় খাবার।

মুতানজান বিরিয়ানি [45] আরেক ধরনের বিরিয়ানি যাতে প্রায় সমান পরিমাণ ভেড়ার মাংস, চাল এবং চিনি থাকে। এটি কাশ্মীর ও উত্তর প্রদেশে খুবই জনপ্রিয়। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে মাওয়া বা খোয়া (দুধ দিয়ে বানানো বিশেষ উপাদান), মশলা, জাফরান, কেওড়া এবং গোলাপ জল মেশানো হয়।

মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে বিতরণের জন্য রয়েছে বিরিয়ানি:

তামিলনাড়ুর ভাদ্দাকামপাট্টি নামের এই গ্রামের মন্দিরে পবিত্র প্রসাদ হিসেবে বিরিয়ানি দেওয়া হয়

যদিও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা এর এর উৎপত্তি স্থলের দাবী নিয়ে চাতুর্যের সাথে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরে আলোচনা করছে, তবে বিরিয়ানির এই বিষয়টি নিয়ে খুব সামান্য বিতর্ক রয়েছে যে এই খাবার ভারতীয় উপমহাদেশ এর এক জনপ্রিয় খাবার:

অন্তত বিশ ধরনের বিরিয়ানী রয়েছে যেমন বোম্বে বিরিয়ানি, আফগান বিরিয়ানি, হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি, সিন্ধি বিরিয়ানি, কাচ্চি বিরিয়ানি ইত্যাদি, করাচির বাসিন্দাদের এটা উপলব্ধি করা উচিত যে তাদের এলাকায় বিরিয়ানির উৎপত্তি নয় অথবা তারা এটির স্বত্ব দাবী করতে পারে না। মুঘলদের হাতে এর জন্ম আর বৈচিত্র্যময় হয়েছে দিল্লি ও অযোদ্ধা নামে পরিচিত লক্ষ্মৌ নগরীর রান্নাঘর থেকে।

যদিও বিরিয়ানি পারস্য থেকে আমদানী করা, তবে ইতিহাসে এর উল্লেখ মেলে দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে সে সময় যার নাম ছিল অন সরু সঙ্গম সাহিত্যে যার উল্লেখ রয়েছে। সে সময় অনু সরু চাল আর মাংস মিশিয়ে গুলমরিচ, ধনিয়া ও অন্যান্য মসলা সহযোগে রান্না করা হত। ভারতের প্রায় জাতীয় খাবার কি তামিলকাম বা তামিলনাড়ুতে উদ্ভাবন হয়েছে?

বিরয়ানির উৎপত্তি স্থান নিয়ে বিতর্ক হয়ত চলতেই থাকবে, কিন্তু বিরিয়ানি কোন দাওয়াত কেউ পাশ কাটিয়ে যেতে দুবার ভাববে।