যেসব মানুষের ইন্টারনেট সংযোগ নেই তাদের সাহায্য করার লক্ষ্যে ফেসবুক যখন ফ্রি বেসিকস অ্যাপ্লিকেশনটি চালু করে তখন তারা বলেছিল যে এই অ্যাপটি সমগ্র বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটে সংযুক্ত হবার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করবে।
কিন্তু গ্লোবাল ভয়েসেসের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে এই দাবির বিপরীতে অ্যাপটি মূলত ফেসবুক এবং অন্যান্য কর্পোরেশনের চাহিদা পূরণ করে, তাদের নিজস্ব ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যগুলি অর্জনের জন্য অ্যাপ ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগায়।
ফ্রি বেসিকস হচ্ছে একটি অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে এক গুচ্ছ অ্যাপ্লিকেশনের সেট – এটি ব্যবহারকারীদের বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটে সংযুক্ত করে না, বরং এটি মাত্র কয়েকটি ওয়েব ভিত্তিক পরিষেবা সরবরাহ করে, যার মধ্যে সবচেয়ে স্বীকৃত এবং জনপ্রিয় হচ্ছে ফেসবুক অ্যাপ।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় বিশ্বব্যাপী ৬৩টি দেশে ফ্রি বেসিকস চালু ছিল। প্রতিটি বাজারে, এটি সাধারণত ফেসবুক এবং একটি স্থানীয় টেলিযোগাযোগ অপারেটরের মধ্যে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। সেই অপারেটররা গ্রাহকদের কাছে অল্প পরিমাণে মোবাইল ডেটা সরবরাহ করে, যা কেবল ফ্রি বেসিকস এ সংযুক্ত হতে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতিটি দেশে ফ্রি বেসিকস এর একটি করে অনন্য সংস্করণ রয়েছে, যা স্থানীয় ব্যবহারকারীদের জন্য উপযুক্ত ভাষা সমর্থন করে এবং নির্দিষ্ট ওয়েব কন্টেন্ট প্রদানের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়ে থাকে।
ফ্রী বেসিকস ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ফেসবুক কী ধরণের তথ্য সংগ্রহ করে?
আমাদের গবেষণা নিশ্চিত করেছে যে ফ্রি বেসিকস উন্নয়নশীল দেশগুলির ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন পছন্দ, অভ্যাস এবং আগ্রহের বিষয়ে তথ্যগুলির অনন্য ভাণ্ডার ফেসবুকের কাছে সহজলভ্য করে। ফেসবুক ফ্রী বেসিকস ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এই অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে এবং এছাড়াও ফেসবুকে তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে।
আমরা যে সকল সংস্করণ পরীক্ষা করেছি, তাতে এটি ব্যবহার করার জন্যে ব্যবহারকারীদের দৃঢ়ভাবে ফেসবুকে লগ ইন করার জন্য উত্সাহ দেওয়া হয়েছে এবং যদি তাদের ইতিমধ্যে অ্যাকাউন্ট না থাকে তবে সাইন আপ করতে বলা হয়েছে। ফ্রী বেসিকস অ্যাপের মূল পৃষ্ঠার উপরের অংশে ফেসবুক অ্যাপটি প্রদর্শিত হয়। অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের ফেসবুকে লগ ইন করতে এবং তাদের ফেসবুক বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখতে উত্সাহিত করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে – উদাহরণস্বরূপ, কলোম্বিয়ার গবেষক মনিকা বনিলা জানিয়েছেন যে তার আইফোনে ফেসবুক অ্যাপ্লিকেশন চালু ছিল বলে তার নিজের অ্যাকাউন্টটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফ্রি বেসিকসে যুক্ত হয়ে যায়।
ফেসবুকে লগইন করে বা না করেই হোক না কেন, ফ্রি বেসিকস ব্যবহারকারীরা ফেসবুকের সাথে তাদের তথ্য ক্রমাগত ভাগ করে চলে।
আমাদের দল গবেষণা প্রক্রিয়া শুরুতেই এটি দেখতে পায়। যখন কোনও ব্যবহারকারী প্রথমবার অ্যাপ্লিকেশনটি চালু করেন, তখন তাকে অবশ্যই অ্যাপটির বিভিন্ন নীতিকে স্বীকৃতি দিতে হয় এবং তথ্য ভাগাভাগি করতে অনুমতি দিতে হয় – যেমন ব্যবহারের শর্তাবলী, একটি ডেটা নীতি, একটি কুকি নীতি এবং একটি পণ্য-নির্দিষ্ট গোপনীয়তা নীতি। আমরা অবাক হয়েছি এই সমস্ত নীতির ব্যবহার দেখে কারণ এগুলো ব্যবহারকারীর সাথে ফেসবুকের মধ্যে চুক্তি হিসাবে লিখিত ছিল – ফ্রি বেসিকস এর সাথে নয়।
কিভাবে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে?
ফেসবুক তাদের ওয়েবসাইটে এই উদ্যোগটি সম্পর্কে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছে যে ফ্রী বেসিকস এর জন্য সমস্ত ওয়েব ট্র্যাফিক ইন্টারনেট.অর্গ প্রক্সি সার্ভারের মাধ্যমে যায় যার ফলে এই ট্রাফিক প্রবাহটিকে টেলিকম অপারেটররা “শূন্য হারে” অর্থাৎ বিনামুল্যে রাখতে পারে, এবং প্রযুক্তিগতভাবে এভাবে ডাটা স্থানান্তর করা সাশ্রয়ী।
এই প্রক্রিয়াটি ফেসবুককে একটি একক নোড বা প্লাটফর্ম দেয় যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের মেটাডেটা সংগ্রহ এবং অস্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা যায়। তার মানে ব্যবহারকারীরা ফেইসবুক চালালে বা না চালালে, বা ফ্রি বেসিকস প্রোগ্রামের মধ্যে অন্য কোনও পরিষেবা বা সাইট ব্যবহার করলে- ফেসবুককে জানিয়ে দিচ্ছে তারা কী সাইটগুলি, কখন এবং কতক্ষণ ধরে ভিজিট করছে সে সমস্ত তথ্য। নিয়মিত পরিষেবার প্রক্রিয়া হিসাবে ফেসবুক এই ডেটা ব্যবহার করে ব্যবহারকারীর পছন্দগুলি জানার জন্য যাতে ফিডে কী ধরণের তথ্য প্রচার করতে পারে তা নির্ধারণ করা যায়। কলোম্বিয়াতে, গবেষক মনিকা বনিলা দেখেছেন যে তিনি ফ্রি বেসিকস অ্যাপের কোন কোন সাইট ভিজিট করেছেন সেটা তার ফেসবুক নিউজফিডের কন্টেন্টে প্রতিফলিত হয়েছে।
ফ্রি বেসিকস ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আর কারা?
যে ছয়টি দেশে যেখানে আমরা গবেষণা পরিচালনা করেছি, সেখানে দেখেছি যে ফ্রি বেসিকস এর মূল পাতায় (স্ক্রিনশট দেখুন) দেয়া আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার সাইটের বা অ্যাপের নাম- যেমন ইএসপিএন, চেঞ্জ কর্পস এবং জনসন অ্যান্ড জনসন, যারা “বেবি সেন্টার” অ্যাপ্লিকেশন এর নির্মাতা।
বেবিসেন্টার অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারকারীদের ব্যবহারিক স্বাস্থ্য তথ্য সরবরাহ করে, সাথে সাথে এটি ব্যবহারকারীদের অনুসন্ধান আচরণ এবং সম্ভাব্য গ্রাহকদের স্বার্থ এবং অভ্যাসগুলির উপর লাভজনক ডেটা (মূল কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসনকে) সরবরাহ করে – যা এমনকি এই অ্যাপে দেয়া তথ্যের সঠিকটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
অ্যাডউইক ম্যাগাজিনে ২০১৪ সালে দেয়া একটি সাক্ষাত্কারে, জনসন এন্ড জনসন গ্লোবাল স্ট্রাটেজি ম্যানেজার ক্রিস্টিনা হফটোল্ড জানান যে বেবি সেন্টার অ্যাপটি “কোন মা কি খুঁজতে চাইতে পারে তা আগে থেকেই জানতে পারে তার পূর্বের খোঁজার রেকর্ড বিবেচনা করে।” তিনি আরও জানিয়েছে যে বেবি সেন্টার এর দেয়া তথ্য কিভাবে কোম্পানির ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী শিশুর বাবা-মায়ের কাছে বিক্রিতে সহায়তা করেছিল। তিনি আরও বলেন যে অ্যাপ্লিকেশনটির তথ্য ফেসবুক এবং টুইটারে পিতামাতার ক্রিয়াকলাপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের থেকেও সঠিক ও মূল্যবান।
আমাদের পরীক্ষা করা সমস্ত সংস্করণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কর্পোরেট সংস্থার সেবার পাশাপাশি স্থানীয় কন্টেন্টও ছিল। তবে ফিলিপিন্সের মতো কিছু দেশে, অ্যাপের প্রধান পৃষ্ঠায় স্থানীয় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কন্টেন্ট ও সামগ্রী বেশী ছিল, অন্যগুলোতে এমন পাওয়া যায়নি।
মেক্সিকোতে, টেলসেলের দেওয়া ফ্রি বেসিকস সংস্করণগুলির মূল পৃষ্ঠায় কেবল একটি স্থানীয় পরিষেবা অন্তর্ভুক্ত ছিল: কার্লোস স্লিম ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট, যা টেলসেলের সিইও এবং বিলিওনিয়ার কার্লোস স্লিমের সংস্থা। মেক্সিকোর গবেষক জিওভানা সালাজার প্রত্যক্ষ করেছেন যে অ্যাপ্লিকেশনটি ইচ্ছাকৃতভাবে ফ্রি বেসিকসে যুক্ত করা হয়েছিল যাতে ব্যবহারকারীদের কাছে তা প্রচার করা যায় এবং ব্যবহারকারীর অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
আমরা অ্যাপটির যে সংস্করণগুলো পরীক্ষা করেছি সেগুলোর মূল পৃষ্ঠায় আরও অনেক পরিষেবা যুক্ত রয়েছে দেখা গেছে (এমনকি ১২০ থেকে ১৫০টি পরিষেবা পর্যন্ত)। তবে এই পরিষেবাগুলির বেশিরভাগই অ্যাপটির একটি ভিন্ন অংশে স্থানান্তরিত থাকে দেখা গেছে এবং সেগুলো একটি ড্রপ-ডাউন মেনুর আড়ালে লুক্কায়িত থাকে যাতে ব্যবহারকারীরা (বিশেষত প্রথমবার ব্যবহারকারীরা) সহজেই তা দেখতে না পারে।
আমরা যখন ফেসবুককে জিজ্ঞেস করলাম কেন তারা পরিষেবাগুলোকে দুটি আলাদা স্তরে বিভক্ত করেছে, তারা উত্তর দিতে অস্বীকার করেছিল।
টেলিযোগাযোগ অপারেটর এবং ‘অজানা তৃতীয় পক্ষঃ”
তাদের নীতিগুলিতে, ফেসবুক বলেছে যা তারা নির্দিষ্ট তৃতীয় পক্ষের সাথে তথ্য ভাগ করার অধিকার সংরক্ষণ করে। এটি অজানা যে এই তৃতীয় পক্ষগুলোর মধ্যে টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলো আছে কিনা যাদের সাথে তারা অংশিদারিত্বে যুক্ত। টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলো ব্যবহারকারীর অনেক মূল্যবান তথ্য হাতে পায় বিভিন্নভাবে: উদাহরণস্বরূপ, ফ্রি বেসিকস ব্যবহার করার জন্য একজন ব্যবহারকারীর সিম কার্ডের সাথে একটি স্মার্ট ফোন থাকা আবশ্যক। আমরা যেসব দেশে গবেষণা চালিয়েছি সেখানে দেখেছি সিম কার্ড কেনার জন্য আপনার ব্যক্তিগত তথ্য যেমন আসল নাম এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহ করতে হয় টেলিযোগাযোগ কোম্পানিকে।
এই গবেষণায় অনেকগুলি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে যার উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি: ফেসবুক অ্যাপটির মাধ্যমে কতগুলি তথ্য সংগ্রহ করছে এবং তারা এটি কার কার সাথে ভাগ করছে। এই সংগৃহীত তথ্য ফেসবুক এবং অন্যান্য কর্পোরেশন কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য নতুন বিপণন কৌশল গড়ে তুলতে কতটুকু সাহায্য করছে?
আমরা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আগামী কয়েক মাসে ফেসবুকের ফ্রি বেসিক টিমের সাথে অ্যাপ্লিকেশন সম্পর্কে আরও আলোচনার আশা রাখি।