বাংলাদেশে রয়েছে ভয়াবহ এক মাদক সমস্যা এবং এর মূলে রয়েছে মায়ানমার থেকে চোরাইপথে আনা ইয়াবা ট্যাবলেট যা মেথঅ্যাম্ফিটামিন আর ক্যাফাইন এর সংমিশ্রণে তৈরি। কিন্তু এর সুলভে প্রাপ্তি ঠেকাতে বা যুবাদের মধ্যে ইয়াবা আসক্তি রোধে কি একটি রক্তাক্ত যুদ্ধের দরকার ছিল?
গত কয়েক দিনে সরকারের “জিরো টলারেন্স” মাদক বিরোধী অভিযানে ৫০ এর অধিক কথিত মাদক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর পরে তাঁদের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাড়া দেশজুড়ে এই মাদক অভিযান এখনো চলছে।
তবে সাধারণ নাগরিকরা এই মাদক বিরোধী অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টরালেন্স নীতির প্রশংসা করে জুলকার নাইন টুইট করেছেন:
মাদকব্যবসায়ী ও এরসাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করায় দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই এই মহত্ কাজ পরিচালনা করার জন্য । মাদক দেশের শত্রু ,উন্নয়ের বাধা ।"শূণ্য টলারেন্স" লক্ষ্য অর্জন করা চাই ।
— Md.Julkar Nine (@md_julkar) May 22, 2018
ওদিকে অনেকে এই মাদক অভিযানকে ফিলিপাইন্সের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তের মাদক যুদ্ধের সাথে তুলনা করছে যেখানে গত দুবছরে ২০,০০০ এর অধিক মৃত্যু ঘটেছে, যার মধ্যে অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
সৈকত রুশদি টুইট করেছেন:
Is #Bangladesh following the footsteps of #Duterte by launching #extrajudicial killings in anti-drug #shootout of suspects without trial? https://t.co/RNfCKHt6kx
— Shaikat Rushdee (@ShaikatRushdee) May 21, 2018
#বাংলাদেশ কি দুতের্তের পথ অনুসরণ করছে মাদক বিরোধী অভিযানে বিচার ছাড়াই কথিত অপরাধীদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে?
বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে ৪ কোটি ইয়াবা ট্যাবলেট আটক হয়েছে, যেখানে বছরে ২৫-৩০ কোটি ইয়াবা ট্যাবলেট বাজারে ঢোকে। তুলনামূলকভাবে ২০১০ সালে মাত্র ৮১ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট আটক করা হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখ বলে ধারনা করা হয়। এদের বেশিরভাগই তরুণ এবং ইয়াবাসেবী। ইয়াবা একটি দামী মাদক এবং মাদকসেবীরা অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পরছে তাঁদের আসক্তির পয়সা জোগাতে।
‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দিকে আমরা পা না বাড়াই’
এদিকে মাদক বিরোধী অভিযানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন অনেকেই। হত্যা করে কোনো সমস্যা সমাধান হতে পারে না বলে তারা মনে করেন। অ্যাডভোকেট জিয়াউর রহমান ফেসবুকে লিখেছেনঃ
Bangladesh kills 13 drug dealers in major crackdown May 20 – Let us not WALK the path of EXTRAJUDICIAL killings. Superbad for #Democracy. Improve the law and order system and plug the miscreants into the system. Let the system take care of them. #StopEXTRAJUDICIALKilling.
শুধুমাত্র ২০মে মাদকবিরোধী অভিযানে ১৩জন মাদক ব্যবসায়ীর মৃত্যু ঘটেছে – বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দিকে আমরা পা না বাড়াই। এটি গণতন্ত্রের জন্যে খারাপ। আইনের শাসন আরও মজবুত করতে হবে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আইনকে তার নিজের গতিতে চলতে দিন। #বিচারবহির্ভূতহত্যাকাণ্ডবন্ধকরুন।
বাংলাদেশে “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড” বা ক্রসফায়ার বলতে পুলিশের হেফাজতে কথিত অপরাধীদের মৃত্যুকে বোঝানো হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলা হয় যে অস্ত্র উদ্ধারের সময় দুষ্কৃতিকারী এবং পুলিশের মধ্যে গোলাগুলির সময়ে উক্ত অপরাধী মারা যান।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত দশ বছরে দেশে ১,৭৫৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তবে, পুলিশ কোন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেনি বলে জানিয়েছে।
জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ প্রবাসী সাংবাদিক তাসনীম খলিল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন:
দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ। আইনের ম্যক্সিম। বাংলাদেশে র্যাব-পুলিশ ৮ দিনে ৩৭ জন নির্দোষ মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। এর নাম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।
— Tasneem Khalil (@tasneem) May 22, 2018
সাংবাদিক হাসান মামুন লিখেছেন:
আমরা তো চাইছিলাম, ভয়াবহ মাদক ব্যবসায় জড়িত উচ্চ পর্যায়ের লোকজন এবার ধরা পড়ুক — যেহেতু বলা হয়েছিল ‘জিরো টলারেন্স'। চুনোপুঁটিদের বিরুদ্ধে এসব ঘোষণা করা আর বাস্তবায়নের কোনো মানে আছে কি? এটা মানুষকে আশান্বিত করবে না; রাঘববোয়ালরাও ভীত হবে না এতে।
‘আইন তো ক্ষমতার হাতে বন্দী, নাকি!’
বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকার কাছে দেশের শীর্ষ মাদক কারবারিদের একটি তালিকা এসেছে যা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা। সে তালিকায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত রয়েছেন এমন কয়েকজনের নাম রয়েছে, একজন এমপি সহ।
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন কোন প্রমাণ ছাড়া সেই এমপিকে মাদক ব্যবসায় জড়িত হিসেবে রিপোর্টে না উল্লেখ করতে। তবে ক্ষমতাসীন দলের হোমরাচোমরাদের সেই তালিকায় দেখে অনেকেই শুধুমাত্র নিচের দিকের মাদকব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন।
তাদের সাথে ক্ষমতাসীন দলের যোগাযোগ ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন বাম রাজনৈতিক জুনায়েদ সাকী। তিনি লিখেছেন:
মাদক গুরুতর সমস্যা। সমাধানের প্রধান জায়গা হচ্ছে ক্ষমতার সাথে এর যোগসাজশ ছিন্ন করা। কিন্ত রাষ্ট্র যখন মানুষ মেরে ফেলাকে (ক্রসফায়ার) সমাধান হিসেবে হাজির করে, এর চাইতে ভয়াবহ প্রতারণা আর কি হতে পারে?
কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ গডফাদারদের বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলেছেন
যারা ক্রসফায়ারড হইলেন তারা কে কত নম্বরে ছিলেন তালিকায়? জানি না।
যারা তালিকায় ১ থেকে ১১ নম্বরে আছেন তারা তো দেখছি ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ কি?
আইন তো ক্ষমতার হাতে বন্দী, নাকি! গডফাদারদের বন্দী করেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে শুধু সরকারী প্রেসনোটেরই প্রতিফলন দেখা যায়। শফিকুল আলম সাংবাদিকদের এ বিষয়ে রিপোর্ট করার সময়ে সঠিক প্রশ্নগুলো করতে বলেছেনঃ
Crossfires are the worst human rights violation in Bangladesh and many other countries in the world. Yet many reporters here don't know how to report a crossfire killing. They just copy and paste an official press statement, describing a story (most often lies) just the way the authorities wanted to tell it.
ক্রসফায়ার হচ্ছে বাংলাদেশ এবং অন্য আরও কিছু দেশের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘণকারী পদক্ষেপ। তবে এদেশের অনেক সাংবাদিকরাই জানেনা এ নিয়ে কিভাবে রিপোর্ট করতে হয়। তারা কোন প্রশ্ন ছাড়াই শুধু সরকারী প্রেসনোটকে কপি করে রিপোর্টে দিয়ে দেন যাতে ঘটনাটি নিয়ে সরকারী গল্পটিকেই (অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যা) প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
ইয়াবা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। তবে সরকার এটিকে ক্যাটেগরি এ মাদক (হিরোইন, কোকেনের মত মাদক) হিসেবে একে তালিকাভুক্ত করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। এর ফলে ইয়াবা মাদক বিক্রির অপরাধে ভবিষ্যতে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত কঠিন শাস্তি আসবে। তাই বোঝা যাচ্ছে মাদক নিয়ে আরও মৃত্যুর খবর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আসছে।