২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে সোমালিয়ার বন্দর নগর বোসাসো শহরে ১৬ বছর বয়স্ক ফাইজা মোহাম্মদ আবদিকে শ্রোণী এলাকায় (মেরুদণ্ডের নীচে) গুলি করা হয় কারণ এই কিশোরী, ধর্ষণের উদ্দেশ্যে তার উপর হামলা চালানো ব্যক্তিদের বাঁধা দিচ্ছিল। আব্দেকাদির ওয়ারসামে নামক নিরাপত্তা বাহিনীর এক সৈনিকের গুলিতে ফাইজা ভয়ানক ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সোমালিয়ার আধা স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল পান্টল্যান্ডে তার উপর এই হামলা করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে তুরস্কের এক হাসপাতালে ফাইজার চিকিৎসা চলছে। প্রাপ্ত সংবাদের সূত্র রেডিও ডালসান:
সংবাদ সুত্রে জানা গেছে, পান্টল্যান্ডে বেড়াতে এলে সেখানকার নৌসেনার তাকে ধর্ষণে চেষ্টা করে, তবে ফাইজা হামলাকারীদের আপ্রাণ প্রতিরোধের চেষ্টা করতে থাকে। যখন আব্দেকাদের ওয়ারাসামে নামের সৈনিক উপলব্ধি করে যে এই উদ্দেশ্যে সে সফল হবে না তখন সে ফাইজার গোপন অঙ্গের কাছে গুলি করে এবং মেয়েটিকে গুরুতর আহত করে। আহত এবং রক্তাক্ত এই মেয়েটিকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে মোগাদিসুতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানকার ডাক্তাররা বলে যে মেয়েটির বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন এবং এই চিকিৎসা করা তাদের সাধ্যের বাইরে।
দুর্ভাগ্যবশত, কেবল ফাইজা একা এ রকম ঘটনার শিকার নয়। যদিও কিছু সোমালী আধা স্বায়ত্ত্বশাসিত এলাকা সম্প্রতি ধর্ষণ বিরোধী আইন চালু করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তারপরেও ধর্ষনের ক্ষেত্রে ধর্ষকের দায়মুক্তি হচ্ছে এমন এক সাধারণ সংস্কৃতি, যার মাধ্যমে অনেক ধর্ষক অপরাধ করে শাস্তির আওতার বাইরে থাকে এবং অজস্র ধর্ষণের ঘটনা ঘটতেই থাকে।
আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু শিবিরে ধর্ষণের ঘটনা।
বিগত দুই দশক ধরে চলা সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষ অনেক নাগরিককে বাধ্য করেছে নিজ বাস গৃহ ত্যাগ করে আইডিপি বা আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিতে। এই সকল উদ্বাস্তু শিবির শহরের বাইরে অবস্থিত এখানে যে সমস্ত নারী ও বালিকার বাস করে তারা প্রায়শ এই ধরণের যৌন হামলার শিকার হওয়ার মত নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। তাদের কোন ধরণের নিরাপত্তা নেই এবং মাঝরাতে অথবা যখন তারা জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করতে দুর্গম এলাকা যায় তখন বেশির ভাগ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। গৃহযুদ্ধের কারণে একই সাথে দেশটির আইন ও বিচার ব্যবস্থার ভেঙ্গে পড়ার কারণে ধর্ষণের শিকার নারীরা আইনের দরজায় কড়া নাড়তে পারে না।
ফীকান, যে কিনা ৪৫ বছর বয়স্ক এক তালাকপ্রাপ্ত মা, সে বুয়োলো বাআলাই আইডিপি উদ্বাস্তু শিবিরের বাসিন্দা। তাকে তার সন্তানের সামনে ধর্ষণ করা হয়, তিনি গ্লোবাল ভয়েসেস-এর কাছে এই ঘটনার বর্ণনা করে তিনি বলেন:
মাঝ রাতে পান্টল্যান্ড পুলিশের পোষাক পড়া এক ব্যক্তি আমার গৃহে ধাক্কা মারে, অস্ত্রের মুখে আমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায় এবং ধর্ষন করে। সে কেবল আমাকে ধর্ষণ করেনি, সে আমার উপর অত্যাচার চালায় এবং আমার শরীরের বেশ কিছু জায়গায় আঘাত করে আমাকে ছেড়ে যায় যা এখনো আমার শরীরের ব্যাথার কারণ।
ফীকানের উপর যে রাতে হামলা হয়, সে রাতে পান্টল্যান্ড পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য গালকায়োর কেন্দ্রীয় এলাকার অবস্থিত ব্লুবাক্লেই আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু শিবিরে গিয়েছিল। পুলিশের সদস্যারা শিবির বাস করা নারীদের ঘরের বেড়া ভেঙ্গে সেখানে প্রবেশ করে এবং ফীইকান এবং অন্য এক মাকে জোর করে ধরে বাইরে নিয়ে আস। এরপর দুজন রমণীকে তারা ধর্ষণ করে। দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটনার শিকার নারীরা এখনো তাদের উপর সংঘঠিত অত্যাচারের প্রতিকার লাভ করেনি। ধর্ষকদের ধরা হয়েছে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করা হয়নি, এই রকম অপরাধের কারণে তাদের গ্রেফতার করাও হয়নি।
পান্টল্যান্ড মানবাধিকার সংস্থার মতে, সোমালিয়ার আধা স্বায়ত্ত্বশাসিত পান্টল্যান্ড অঞ্চলে ২০১৭ সালে ৮০টি ধর্ষণের ঘটনার অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। যদিও ধারণা করা হয় ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশী, কারণ ধর্ষণের শিকার অনেক নারী সামাজিক লজ্জার ভয়ে, অপরাধমূলক বিচার ব্যবস্থার প্রতি এবং এই ধরণের ঘটনায় সেবা দিতে অপ্রস্তুত থাকা স্বাস্থ্য বিভাগের কারণে মুখ খুলতে চায় না।
ন্যায় বিচার না পাওয়ার মত ঘটনা ছাড়াও, যৌন হামলার শিকার যারা তাদের এই ধরণের ঘটনায় সুস্থ্য ভাবে টিকে থাকার ক্ষেত্রে আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে স্বাস্থ্যগত সেবা কাঠামো, আধুনিক উপাদান এবং যন্ত্রপাতির অভাব, যা এই ধরণের চিকিৎসায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পাশাপাশি এই স্বাস্থ্য কাঠামোয় ধর্ষণের শিকার নারীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানে সক্ষম যোগ্য লোকেরও অভাব রয়েছে।
স্থানীয় সংস্কৃতি এই ধরণের অপরাধে ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, কারণ স্থানীয় প্রথা অনুসারে ধর্ষণের শিকার নারীকে সমাজের বিচারে হয় ধর্ষণকারীকে বিয়ে করতে অথবা ক্ষতিপূরণ হিসেবে “উট কিংবা কোন গবাদি পশু” গ্রহণ করতে হয়:
ধর্ষণের ঘটনা এখানে ব্যাপক ভাবে ঘটে এবং সোমিলায়ার বেশীর ভাগ অংশে প্রায়শ ধর্ষকের কোন শাস্তি হয় না। দেশটিতে দশকের পর দশক ধরে চলা সংঘর্ষে সহিংসতার সংস্কৃতিতে ঘি ঢেলেছে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যে সকল প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাদের দুর্বল করেছে, এছাড়া প্রচলিত নিয়ম অনুসারে ধর্ষণের শিকার নারীকে ক্ষতিপূরণ গ্রহণে বাধ্য করা হয়–প্রায়শ এই ধরণের ক্ষতিপূরণ হয় উট বা গবাদি পুশ-এবং অনেক সময় ধর্ষণের শিকার নারীদের ধর্ষণকারীকে বিয়ে করতে হয় যা প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রের মাঝে যুদ্ধ বন্ধে শতাব্দী প্রাচীন এক প্রথা।
সঠিক পদক্ষেপে গ্রহণে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া- কিন্তু তা কি যথেষ্ট?
৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, পান্টল্যান্ডের আধা স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল খবরের কাগজের শিরোনামে উঠে আসে যখন এই অঞ্চল ধর্ষণ প্রতিরোধে গারোয়ে শহরে প্রথম এক ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করে।
এর আগের বছর, ২০১৬ সালে সেপ্টেম্বর, পান্টল্যান্ড সোমালিয়ার প্রথম প্রশাসনিক অঞ্চলে পরিণত হয় যেখানে ধর্ষণ বিরোধী এক খসড়া আইন তৈরি করা হয়। সংসদের এর সমর্থনে আওয়াজ তোলে, যেখানে ৪৫ জন সদস্যদের মধ্যে ৪২ জন এই খসড়া আইনের পক্ষে ভোট দেয়, যা পরে এক আইনে পরিণত হয়।
৬ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে নিজস্ব এক ঘোষণার মাধ্যমে তৈরি সোমালিল্যান্ড নামের এলাকার সংসদ পান্টল্যান্ডের কাজের ধারা অনুসরণ করে এবং এক নতুন ধর্ষণ বিরোধী খসড়া আইনের প্রস্তাব করে। তবে, গওররটি (প্রবীণদের সংসদ) অনুমোদন পাওয়া এবং এক আইনে পরিণত হওয়ার আগে সংসদের অনেক দূর যেতে হবে।
যদিও বিগত বছরগুলোয় ধর্ষণ-এর মত বিষয় সোমালি সরকারের একই সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে । নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা পরিমাণ এখনো প্রচণ্ড এবং এই ধরণের নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলার পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে।