- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

কাঠমুন্ডুর প্রাচীন পুকুর এর পুনরায় সংস্কার সংরক্ষণবাদীদের প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছে

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, নেপাল, ইতিহাস, উন্নয়ন, দুর্যোগ, নাগরিক মাধ্যম, শিল্প ও সংস্কৃতি, সরকার
[1]

২০১৫ সালের ভূমিকম্পের পূর্বে রাণী পোখরী পুকুর। ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী অনুপ অধিকারি-এর। সিসি বাই–এনসি ২.০।

নেপালের কাঠমুন্ডু উপত্যকায় [2] এবং দক্ষিণের সমতল এলাকা সবসময় দেশটির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক সমন্বিত অংশ হয়ে রয়েছে। যখন এখানকার কিছু পুকুর ভালভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে [3], সেখানে অন্য কয়েকটি পুকুর আধুনিক ভাবে নির্মাণ অথবা কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে পুরোপুরি বিনষ্ট হয়ে গেছে।

রাণী পোখরী [4] শব্দের অর্থ হচ্ছে রাণীর পুকুর, আর এই পুকুরের মাঝে ঐতিহাসিক বালগোপালস্বর মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরের সংস্কার কাজের জন্য এই পুকুর থেকে পানি সরিয়ে ফেলা হয়েছে হয়েছে যাতে মন্দিরের সংস্কার কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় । কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল সামগ্রিক ভাবে পুকুরের সংস্কার করা হবে কারণ ২০১৫ সালের মহা বিপর্যয়কর ভূমিকম্পের [5] পর এই মন্দিরের খানিকটা অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

কাঠমুন্ডুর মাঝখানে অবস্থিত এই পুকুরটি রক্ষায় এখন কাঠমুন্ডু উপত্যকার একটিভিস্ট এবং স্থানীয়রা একত্রিত হয়েছে:

মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আমরা রাণী পোখরীর এই দশা করেছি। একই স্থান থেকে নেওয়া দুটি ভিন্ন সময়ে এর দুটি ছবি।

রাণী পোখরির সৌন্দর্য্য এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব

রাণী পোখারী, ১৭ শ শতকের এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য মণ্ডিত এলাকা, ধারণা করা হয়ে থাকে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা প্রতাপ মাল্লা [8] তার প্রিয় রাণী অনন্তপ্রিয়াকে [9] সান্ত্বনা প্রদানের জন্য এই পুকুর খনন করেন, কারণ সে সময় রাণী তার ছোট ছেলের মৃত্যুতে শোকার্ত ছিলেন।

পুকুরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত বালগোপালেস্বর মন্দির বছরে একবার জনসাধারনের জন্য খুলে দেওয়া হয়, যখন পরিবারে ছেলে বা মেয়ে একমাত্র সন্তান, তাদের ভাইটিকার (ভাইয়ের দীর্ঘায়ু বা মঙ্গল কামনার জন্য বোনেরা ভাইয়ের কপালে যে টিপ পরিয়ে দেয়) দিন মন্দির পরিদর্শন করে। এই উৎসব ভাইবোনদের জন্য উৎসর্গকৃত উৎসব, যা মুলত আলোর জন্য নিবেদিত হিন্দুদের পাঁচদিনের উৎসব তিহারের [10] পঞ্চম দিনে অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও ছাট উৎসবের [11] সময়ও পুকুরের মাঝখানে অবস্থিত এই মন্দির খুলে দেওয়া হয়।

১৯১৯ সালে রাণী পোখরীর একটি দৃশ্য

অতীতের সেই রাণী পোখরী “পুরোনোই সুন্দর” ১৯৯০-এর দশক (বিক্রম এর যুগে) সংঘঠিত ভূমিকম্পের সময় রাণী পোখরিকে যেমন দেখাত।

সৌন্দর্য্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে পরিচিত এই পুকুরকে ঘিরে রয়েছে ঘণ্টাঘর (দি ক্লক টাওয়ার) এবং ত্রিচন্দ্র কলেজ, যা নেপালের পূর্ব অঞ্চলের প্রথম কলেজ এবং দুর্বার হাই স্কুল,পশ্চিমাঞ্চলের নেপালের প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। রাজা প্রতাপ মাল্লা ও তার দুই সন্তান এক হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে রয়েছেন এক মূর্তি রয়েছে-এর দক্ষিণ পাড়ে। মন্দির কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে মন্দিরের চার কোনায় হিন্দু দেব ও দেবীর কয়েকটি মূর্তি স্থাপন করা হবে।

বিতর্কিত এবং বাজে ভাবে পুনর্নির্মাণ

এই পুকুর সংস্কারের [16] বিষয়টি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, স্থানীয় জনগণ এবং কাঠমুন্ডু মেট্রোপলিটন সিটির (কেএমসি) মাঝে এক বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে যারা এই এই কাজের দেখাশোনা করছে। এই কাজে নিয়োজিত ঠিকাদাররা এর পুনর্নিমাণের কনক্রিটের উপাদান ব্যবহার করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হলে এর সংস্কার কাজ কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকে।
যখন ঠিকাদাররা কনক্রিটের এক দেওয়াল নির্মাণ শুরু করে তখন আবার আন্দোলন শুরু হয় [17]:

কেএমসি বলছে তারা রাণী পোখরীর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি এবং একে আধুনিক করতে চায়, সাথে এখানে অবস্থিত লুমিয়ের ঝর্ণা, একটা উদ্যান এবং কফির দোকান নির্মাণ করতে চায়। এটি নেপালের প্রাচীন স্থাপনা সংরক্ষণ অধ্যাদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যে আইনে উল্লেখ রয়েছে ১০০ বছরের বেশী প্রাচীন স্থাপনা মূল কাঠামো অক্ষত রেখে সংরক্ষণ করতে হবে।

রাণী পোখরী ৩৫০ বছর ধরে জল ধারণ করে রেখেছে, যদি এর নির্মাণের সময় কোন ইঞ্জিনিয়ার ছিল না। কিন্তু এখন পুনরায় নির্মাণের নামে রাণী পোখরীর পানি ধরে রাখা আধুনিক সময়ের ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য একটি বিশাল কাজ। সীমাহীন নির্লজ্জতা।

দি কাঠমুন্ডু পোস্টে সঞ্জিত ভক্ত প্রধান লিখেছে [21]:

এক প্রাকৃতিক জলধারায় রাণী পোখরীর নির্মাণ করা হয়, যার একেবারে জমাট বাঁধা মাটি একে পানিরোধী এক মন্দিরে পরিণত করে, আর এর ডুবে থাকা দেওয়াল ঘটনাক্রমে এর পানির স্তরকে পুনরায় পূর্ণ করে, অন্যদিকে ভুগর্ভস্থ খাল পুকুরের পানিকে তিন ধারা এবং ভোহটা হিটির দিকে পরিচালিত করে। প্রায় ৩৫০ বছরের পুরোনো এই পুকুরের পানি অতীতে কখনো শুকিয়ে যায়নি কিংবা বাস্তবে এর প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়েনি।

হিটি হচ্ছে এমন একটি এলাকা যেখানে এক বা একের অধিক পাথরের তৈরি পানি প্রবাহ বা নালা রয়েছে যা প্রাকৃতিক জলধারা থেকে সংগৃহীত বৃষ্টির পানি দিয়ে পূর্ণ করা হয়, এর কাছে পুকুর নির্মাণ করা হয় যাতে এই সকল প্রাকৃতিক জলাধার আবার পূর্ণ করা এবং এমনকি শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা যায়। এই খালের মধ্যে দিয়ে যে পানি প্রবাহিত হয় তা এমন এক পদ্ধতিতে প্রবাহিত হয় যার মধ্যে দিয়ে পুকুর, হিটি এবং জমিতে প্রতিদিনের ব্যবহারে এবং চাষের জন্য পানি সরবরাহ হয় [8]

পুনরায় নতুন করে নির্মাণ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেওয়ার পর ২০১৬ সালে এর সংস্কার কাজ স্থগিত রাখা হয় এবং একটি কমিটি গঠন করা হয় [23] যারা সরকারকে আদিরূপ বহাল রেখে পুকুরের পুনঃসংস্কারের [24] বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে।

যখন এই আন্দোলন রাণী পোখরীর পুনরায় নির্মাণের কাজে বিলম্ব ঘটাচ্ছে, তখন নৃবিজ্ঞানী ডেভিড গ্যালেনার বলছেন যে এই বিতর্ক কাঠমুন্ডু উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক সংস্কৃতি স্থাপনা কী ভাবে নির্মাণ করা হবে তার এক নমুনা হিসেবে [25] বিবেচনা করা যেতে পারে।