শ্রীলংকায় তথ্য অধিকার অনুরোধে ওয়েবসাইট অবরোধের প্রক্রিয়া উন্মোচিত

শ্রীলংকার তথ্য অধিকার ওয়েবসাইটের স্ক্রীনছবি।

রাইসা বিক্রমাতুঙ্গে র এই পোস্টটি পূর্বে পুরস্কার-বিজয়ী শ্রীলংকার একটি নাগরিক সাংবাদিকতা ওয়েবসাইট গ্রাউন্ডভিউজে প্রকাশিত হয়েছিল। গ্লোবাল ভয়েসেসের সঙ্গে একটি বিষয়বস্তু ভাগাভাগি করার চুক্তির অংশ হিসাবে এর একটি সম্পাদিত সংস্করণ নীচে প্রকাশিত।

২০১৭ সালের ৮ই নভেম্বর তারিখে খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে যে স্বাধীন সংবাদ ওয়েবসাইট লঙ্কা-ই-নিউজকে  শ্রীলংকার সমস্ত ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী কর্তৃক আটকে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে কিছু অনলাইন ওয়েবসাইট শ্রীলংকার তথ্য অধিকার (আরটিআই) আইনের আওতায় এ ব্যান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে একটি অনুরোধ দাখিল করলে সংবাদ ওয়েবসাইটটির অবরোধ প্রক্রিয়া সম্পর্কে উদ্বেগজনক বিবরণ পাওয়া যায়।

গত কয়েক বছর ধরে লংকা-ই-নিউজ  বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। ২০১২ সালে, এক আইনজীবী এর সম্পাদকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার ১৪টি অভিযোগ দায়ের করেন। এই অবরোধটি হতাশাজনকভাবে ২০১০ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পূর্বমুহূর্তে এবং আবার ২০১১ সালে গ্রাউন্ডভিউজ এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালসহ আরো কয়েকটির সঙ্গে সাইটটিকে অবরোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেসময় শ্রীলংকার টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (টিআরসি) সাইটগুলি অবরোধ করার কথা অস্বীকার করেছিল।

তথ্যের জন্যে শ্রীলংকার স্বাধীন সংবাদ সাইটগুলোর আনুষ্ঠানিক অনুরোধ

২০১৫ সাল থেকে শ্রীলংকায় একটি নতুন গণতান্ত্রিক সরকার থাকায় পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপাক্ষে সরকারের নীতিমালার সমালোচনাকারী ওয়েবসাইটগুলির নিয়মিত এবং ইচ্ছেমাফিক অবরুদ্ধ থাকার বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রাউন্ডভিউজ এবং এর সহযোগী ওয়েবসাইট বিকল্পমাত্রাম অবরোধের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও তথ্য পেতে আরটিআই আইন অনুসারে আবেদন জমা দিয়েছে।

১০ই নভেম্বর গ্রাউন্ডভিউজ শ্রীলংকার টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রন কমিশন (টিআরসি) -এর কাছে নিম্নলিখিত অনুরোধগুলো জমা দিয়েছে:

  • ১. ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত ওয়েবসাইটগুলির বিরুদ্ধে টিআরসির পাওয়া বিভিন্ন অভিযোগ এবং অনুরোধ জানানো কর্তৃপক্ষ সমূহের পরিচয়
  • ২. ২০১৫ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত অভিযোগের কারণে শ্রীলংকার আইএসপি (ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী)গুলোতে অবরুদ্ধ কোনও ওয়েবসাইট এবং অবরোধের জন্যে প্রদত্ত কারণসমূহ
  • ৩. ২০১৭ সালে নিউজ ওয়েবসাইট লঙ্কা-ই-নিউজের বিরুদ্ধে আনীত কোন অভিযোগ এবং অনুরোধ জানানো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষসমূহের পরিচয়
  • ৪. ২০১৭ সালের নভেম্বরে লঙ্কা-ই-নিউজ অবরোধের যে কোন আদেশ, আদেশপ্রদানকারী কর্তৃপক্ষের পরিচয় এবং এর জন্যে প্রদত্ত কারণ
  • ৫. লঙ্কা-ই-নিউজ অবরোধে টিআরসি- এর অংশগ্রহণ রেকর্ড, যদি থাকে

তিনদিন পর ১৩ নভেম্বর তারিখে তামিল ভাষার ওয়েবসাইট মাত্রাম অনুরূপ অনুরোধ দাখিল করার পর নানাধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়। টিআরসি মাত্রামকে তাদের অনুরোধ ইংরেজী বা সিংহলী ভাষায়তে জমা দিতে বলে স্বীকার করেছে যে তারা এটি প্রক্রিয়া করার জন্যে উপযুক্ত নয় বলে তাদেরকে অনুরোধটির অনুবাদ বাইরে থেকে করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, টিআরসি বলেছে যে এটা সিংহলি ছাড়া শ্রীলংকার দু’টি সরকারি ভাষার একটি তামিল ভাষায় করা তাদের গৃহীত প্রথম আরটিআই অনুরোধ।

সিংহলীতে বিষয়বস্তু প্রকাশকারী সহযোগী ওয়েবসাইট বিকল্পও টিআরসি’র কাছে আরটিআই আবেদন জমা দেয়। তবে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে বিকল্প ও মাত্রামের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। এটিও বিশেষভাবে অদ্ভুত যে টিআরসি'র সদস্য হিসেবে নিজ ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতির পরামর্শক হেমন্তা ওয়ার্নাকুলাসুরিয়া জাতীয় টেলিভিশন অবরোধের পক্ষাবলম্বন করেছেন বলে অনলাইন প্রকাশনা দি আইল্যান্ড–এর একটি নিবন্ধে প্রকাশ করা হয়েছে।

টিআরসি অবরুদ্ধ ওয়েবসাইট এবং নিবন্ধের তালিকা প্রকাশ করেছে

২৮ নভেম্বর তারিখে টিআরসি গ্রাউন্ডভিউজকে সাড়া দিয়ে বলেছিল যে প্রথম অনুরোধটি “তাদের আয়ত্ত্ব, হেফাজত বা নিয়ন্ত্রণে নয়।” রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা বা জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অজুহাতে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অনুরোধগুলো বাতিল করা হয়েছে।

তবে তারা (দ্বিতীয় অনুরোধ) টিআরসি’র অবরুদ্ধ ওয়েবসাইটগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছিল। এছাড়াও মাত্রাম ২০১২ সালের পর থেকে আইএসপিগুলোর কাছে ওয়েবসাইট অবরোধের বিশদ বিবরণ চেয়েছিল। কিন্তু তারা সেটা গ্রহণ করেনি।

টিআরসি প্রকাশিত তথ্য থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৩টি ওয়েবসাইট অবরোধের কথা জানা গিয়েছে। ওয়েবসাইটগুলি রাজনৈতিক সংবাদ এবং অশ্লীল সামগ্রী বিষয়ক।

শ্রীলংকার টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন অনুসারে অবরুদ্ধ ওয়েবসাইটসমূহের তালিকা। গ্রাউন্ডভিউজের মাধ্যমে প্রাপ্ত চিত্র

সরবরাহকৃত আনুষঙ্গিক দলিলপত্রে প্রতিটি ওয়েবসাইট অবরোধের পিছনের প্রক্রিয়াটি প্রদর্শিত হয়েছে।

টিআরসি’র চূড়ান্ত আদেশ গণমাধ্যম মন্ত্রণালয় জারি করলেও অন্ততঃ চারটি ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে প্রাথমিক আদেশটি সরাসরি এসেছে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের উচ্চতর অবস্থান থেকে।

রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের চিঠি। গ্রাউন্ডভিউজের মাধ্যমে প্রাপ্ত চিত্র

তখনকার রাষ্ট্রপতির সচিব পি বি এ্যাবিকুন স্বাক্ষরিত এই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে তালিকাভুক্ত ওয়েবসাইটগুলো রাষ্ট্রপতির মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। কিছু কিছু ইউনিফর্ম রিসোর্স লোকেটর (ইউআরএল) স্পষ্টভাবে সমগ্র ওয়েবসাইটের পরিবর্তে নির্দিষ্ট নিবন্ধের সাথে লিংক করা হয়েছে।

এই পদক্ষেপের পর সংসদীয় সংস্কার এবং গণমাধ্যম মন্ত্রণালয় টিআরসি’র কাছে মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নিমল বোপেজ স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠিয়েছে।

ফলস্বরূপ, টিআরসি প্রধান প্রধান ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীগুলোর সিইওদের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে।

এই একইরকম চিঠি মোবাইল ফোন সরবরাহকারী মোবিটেল, ডায়ালগ, এতিসালাত, এয়ারটেল এবং শ্রীলংকাবেলের সিইওদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। গ্রাউন্ডভিউজের মাধ্যমে প্রাপ্ত চিত্র

টিআরসি চারটি ওয়েবসাইট: ভিগাসাপুয়াথ.ব্লগস্পট.কম, উকুসসা.অর্গ, লংকানিউজওয়েব.টুডে এবং লংকানিউজ অবরোধ করার কারণ হিসেবে “ভুল তথ্য প্রকাশ এবং রাষ্ট্রপতির সুনাম ক্ষুন্ন করার”  কথা বলেছে। অন্য দু’টি লংকানিউজওয়েব.টুডে এবং সিনহালা.আইএনডাব্লিউটুডে “মিথ্যা তথ্য প্রকাশ” করার জন্যে অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

গ্রাউন্ডভিউজের মাধ্যমে প্রাপ্ত চিত্র

জাফনার বিচারকদের বিরুদ্ধে মানহানিকর মন্তব্য করার জন্যে নিউজাফনা.নেট ওয়েবসাইটকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে দু’টি অশ্লীল সামগ্রী প্রকাশ করায় সাইবার অপরাধ বিভাগ-এর একটি তদন্তের পর সেগুলো অবরুদ্ধ করা হয়।

শ্রীলংকায় ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রক সার্বিক আইনের অভাব রয়েছে

(কম্পিউটার অপরাধ আইন, শ্রীলংকার টেলিযোগাযোগ আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ইলেক্ট্রনিক আদান-প্রদান আইনসহ ইন্টারনেট ব্যবহারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেশ কয়েকটি আইন থাকলেও) ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণের অথবা একে একটি মুক্ত অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে প্রচারের কোনও সার্বিক আইন নেই।

শ্রীলংকায় সরকারি তথ্য বিভাগের ২০১১ সালে সংবাদ ওয়েসাইট নিবন্ধন আইন এবং আরও সাম্প্রতিককালে ২০১৬ সালে গণমাধ্যম ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের স্বীকারোক্তি অনুসারে ‘চরিত্রহনন’ এবং ‘গোপনীয়তা লঙ্ঘন’ –এর অজুহাতে ছয়টি ওয়েবসাইট অবরোধসহ অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ বা বাধা প্রদানের কয়েকটি প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে।

১৯৯১ সালের শ্রীলংকা টেলিযোগাযোগ আইনের ৫৩ ধারা অনুসারে টিআরসি’র ওয়েবসাইট অবরোধের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ। অভিবাসী শিক্ষার্থী ও আইনজীবী গেহান গুনাতিলেকে টুইট করেছেন:

প্রমাণাদিগুলো পরিষ্কার এবং এটা সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের দিকে নির্দেশ করে। শ্রীলংকার রাজনৈতিক কর্মীরা মনে করেন এই চর্চাটিকে গণমাধ্যম এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যে বাঁধাহিসেবে গণ্য করা উচিৎ।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .