নীচের এই প্রবন্ধটি হচ্ছে একটি অংশীদার মূলক পোস্ট যার লেখক দিমিত্রি স্ত্রেতেইনভ, আর এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ওসি মিডিয়া নামক ওয়েবসাইটে।
পূর্ব আবখাজিয়ায় যুদ্ধ পরবর্তী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে, তবে এই ফিরে আসার বিষয়টি সম্পন্ন হচ্ছে খুব ধীরে, বিশেষ করে টকুয়ারচাল জেলায়। জর্জিয়া-আবখাজিয়ায় যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটেছে ২০ বছর পূর্বে, কিন্তু প্রজাতন্ত্রের এই অংশে যুদ্ধের আতঙ্ক এখনো এক বিশাল ছাপ রেখে গেছে।
টকুয়ারচাল জেলার অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমিতে অবস্থিত পরিত্যাক্ত এই সকল গ্রামগুলো এ রকম এক নিদারুণ দৃশ্য তুলে ধরে। এ রকম গ্রামের কয়েকটি হচ্ছে দাজানতুখা, আকারমারা, পায়াতাইয়া শাখাতা, পলিইয়ানা, এবং খারচিলাভার অবস্থান আবখাজিয়ার কয়লা খনি উপত্যকায়।
সোভিয়েত আমলে এই এলাকায় ছিল বিভিন্ন জাতির বাস, যারা এক সাথে মিলে মিশে কাজ করত; এদের মধ্যে ছিল রুশ, গ্রীক, আবখাজ, জর্জীয় এবং আর্মেনীয় নাগরিক। যুদ্ধের সময় এদের বেশীর ভাগই তাদের গৃহ ত্যাগ করে চলে যায়। বর্তমানে এখানে মূলত রুশ ও আবখাজদের বাস।
প্রায় পরিত্যাক্ত এ রকম বসতিগুলো আবখাজদের কাছে এক ধরনের ভুতুড়ে নগর হিসেবে পরিচিত। যদিও যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে এখানে প্রায় ১০,০০০-এর বেশী নাগরিক বাস করত, বর্তমানে এ সব এলাকায় মাত্র কয়েকশ নাগরিক বাস করে।
টকুয়ারচালে এখন এই ধরনের দৃশ্য সাধারণ বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। যেমন ২০১১ সালে পুরো জেলার জনসংখ্যা ছিল ১৬, ০০০ হাজারের মত, বিগত এক দশকে জেলার জনসংখ্যা খুব কম সময় এই সংখ্যা ছাড়িয়েছে। ১৯৮৯ সালে পুরো জেলায় প্রায় ৪৩.০০০ জন নাগরিক বাস করত।
এই সকল কিছু হচ্ছে যুদ্ধের প্রভাব
১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েত যুগে নির্মিত পাঁচতলা খ্রুশ্চেয়ভাস্ক ভবন সমূহ এ অঞ্চলের পতন ও দুর্দশার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই সকল ভবনগুলো ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং এখন এগুলোর যে কোন একটি ভবনে দুটোর বেশী পরিবারের বাস এখন এক দূর্লভ ঘটনা।
দাজানতুখা গ্রামের প্রবেশ পথ, সেখানে আমি এক স্থানীয় বাসিন্দার দেখা পেলাম, এক প্রবীণ ব্যক্তি। তিনি এমন ভাবে আলাপ শুরু করলেন, যেন তা শেষ করতে চান না।
“এই সকল কিছু যুদ্ধের ফল”
“আমি কি আপনার সাথে বলতে পারি?”
“কেন আলাপ? দেখতে পাচ্ছে না সবকিছুই তো পরিষ্কার “
যুদ্ধের আগে এই গ্রামের জীবন ছিল উচ্ছ্বল, যেখানে কমিউনিটি সেন্টার, স্কুল এবং কিন্ডারগার্টেন এখানকার নাগরিকদের সেবা প্রদান করত।
এখন বাঁধানো সড়ক বিবর্ণ সৌন্দর্য্যের ভবন দাঁড়িয়ে তাছে। যে সমস্ত লোকেরা একবার এখানে বাস করত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে সময় কেন্দ্রীয় ভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখত, তারা এখন এই এলাকা ত্যাগ করেছে।
এক ভুতুড়ে শহর দাজানতুখায় এখন পঞ্চাশ জনের মত নাগরিক বাস করে, যাদের মধ্যে ৩৮ জনের বাস আকারমারায় গ্রামে, আর অন্য গ্রামেও প্রায় একই রকম নাগরিক বাস করে। এই সকল খ্রুশ্চেয়ভাস্ক-যেখানে এখনো একটা দুটো পরিবার বাস করে, যার চিহ্ন হচ্ছে বারান্দায় নেড়ে দেওয়া কাপড়।
দুই মেয়ে শিশু, যাদের দুজনের বয়স সাত, তারা এক বিবর্ণ গৃহের জানালা দিয়ে উঁকি দিল, আমার হাতে ক্যামেরা দেখার সাথে সাথে তারা ঘুরে গেল।
তাদের একজন উত্তর প্রদান করল” মা ছবি তুলতে নিষেধ করেছে।
“কেন?”
“তিনি মানা করেছেন, ব্যাস আর এটাই হচ্ছে শেষ কথা।”
এখানে বাস করা বেশীর ভাগ বাসিন্দা তুরস্কের কয়লা খনি কোম্পানি টকুয়ারচালাগুলুতে কাজ করে, যারা এখানে কয়লা উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত। এখানে বাস করা ব্যক্তিদের পরিবার পাশাপাশি কৃষিকাজের সাথে যুক্ত, যা মূলত নিজেদের খাওয়ার জন্য যেমন, পশু প্রজনন, মৌমাছির চাষ, সব্জি উৎপাদন, ইত্যাদি কৃষিকাজ করে থাকে। এই ধরনের চাষে সবার জন্য খাবার উৎপাদন করা খুব কঠিন, শীতকালে জেলা প্রশাসন বিনামূল্যে গ্রামবাসীদের মোমবাতি ও পাউরুটি বিতরণ করে থাকে।
” আমি জানি না আগামীতে কী ঘটবে, কিন্তু আমরা জুকিনি চারা বপন করব।”
গালিনা নামের এক প্রবীণ মহিলা, যাকে তার প্রতিবেশীরা আন্ট গালইয়া (গালইয়া খালা) নামও ডেকে থাকে, প্রায় দশ বছর আগে তিনি আকারমারা থেকে দাজাংতুখায় এসে বসতি স্থাপন করেন। যদিও তার বড় মেয়ে ফ্রান্সে বাস করে, গালিনার ইচ্ছে নেই আবখাজিয়া ত্যাগ করে তার মেয়ের সাথে বাস করার। তিনি বলেন “আবখাজিয়া সবসময় আমার মনকে টানে”।
গালিনা তার মেয়ের কাছ থেকে সাহায্য নিতে অনিচ্ছুক, বরঞ্চ সে তার মেয়েকে উৎসাহ দেয় যেন সে তার মাকে মাসিক ভাতা প্রদান করার বদলে নাতি নাতনিদের ৯ ডলার সম পরিমাণের অর্থ প্রদান করে।
তিনি স্বীকার করেন, “এখানে যদি কারো সবজি বাগান ও ঘর না থাকে, তাহলে তার টিকে থাকা মুশকিল”
আন্ট গালইয়া বলেন যে তিনি এবং গ্রামের অন্য বাসিন্দারা নিয়মিত একে অন্যের সাথে দেখা করেন এবং ছুটির দিনগুলো এক সাথে উদযাপন করেন।
যখন তিনি কথা বলছিলেন তখন তার এক তরুণী প্রতিবেশী বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
আন্ট গালইয়া জোরে তাকে নাতাশা নামে ডাকল। “তারা বলছে যে আমরা জুকিনি (এক ধরনের লাউ জাতীয় সব্জি) চারা রোপন করতে পারব না। আমি ইতোমধ্যে জমি প্রস্তুত করে ফেলেছি। আমি জানি না কী ঘটবে, কিন্তু আমরা জুকিনি চারা রোপন করব”।
‘নাগরিকেরা সবকিছুতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে ’
গালিয়ার পরিচিত নাগরিক নাতাশা তার স্বামী ও পাঁচ সন্তানসহ কিছু সময়ের জন্য নিজ গৃহে বাস করেছে। যখন এই যুদ্ধ শুরু হয় তখন নাতাশার বয়স ছিল ১১ বছর। এখন প্রতিদিন তার যুদ্ধ পূর্ববর্তী গ্রামীণ জীবনের কথা মনে পড়ে।
যদিও আত্মীয় স্বজনদের বাস মধ্য রাশিয়া, ওশেটিয়া এবং জর্জিয়ায় বাস করে-আর আবখাজিয়া আলাদা হয়ে গেছে- তারপরেও এই এলাকা ত্যাগ করার সুযোগ তাদের ছিল না।
খুব বেদনার্ত ভাবে তিনি জানালেন “সম্প্রতি আমরা সুখুমিতে (আবখাজিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী) একটা জমি কিনেছি। সেখানে আমরা একটা বাড়ি নির্মাণ করতে চাই, কিন্তু খুব শীঘ্রই তা ঘটছে না”।
নাতাশা তার প্রতিটি সন্তানের জন্য প্রায় ৯ ডলার করে সন্তান ভাতা পেয়ে থাকেন। তার স্বামী এক কয়লা খনিতে কাজ করেন। এই তরুন পরিবারে নিজস্ব খামার রয়েছে, এটি তাদের বাড়ীর কাছে, যেখানে ছোটবেলায় নাতাশা যে কিন্ডারগার্টেনে এক সময় পড়ালেখা করেছে তার কাছে, তারা শুকর, গরু, মোরগ ও মুরগী পালন করে থাকে।
তিনি বলেন যখন নাগরিকেরা যুদ্ধের পরে গ্রাম ত্যাগ করতে শুরু করে, সে সময়টা ছিল আতঙ্কের । কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই ভয় উধাও হয়েছে।
[এখন] আমরা রাস্তার অন্ধকার বা সেখানে লোকজনের উপস্থিতির অভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি না। লোকজন এখন যে কোন কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক নাগরিক ভেবে থাকেন যে এই সকল ভবন যুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, লুটপাটের কারণে এ সকল কিছু ঘটেছে। যুদ্ধের পর আর কোন কাজ করা হয়নি এবং সকলে যে ভাবে পারছে বাস কছে। প্রতিদিন আমি ভাবি শহরটি কেমন ছিল আর যুদ্ধের সময়টা।
আমাদের আলোচনার প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে, এক তরুণ দৌড় দিল। সে এক ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের জানালা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। জানালা দিয়ে একটা বল উড়ে এলো আর আরেকটা ছোট্ট ছেলে সেই বলের পেছনে দৌড় দিল। সে বলটাকে লাথি দিল আর বলটা গড়িয়ে পাহাড়ের ঢালের দিকে চলে গেল।
এখন একদল ছেলে বলটাকে অনুসরণ করছে, তারা সকলে চিৎকার করছে। যখন তারা দৌড়াচ্ছে, তখন তাদের কেউ কেউ পাথর তুলে নিচ্ছে এবং ক্ষয়ে যাওয়া এই সকল শীর্ণ ভবনের দিকে সজোরে ছুড়ে মারছে। এই সকল ধ্বংসপ্রাপ্ত উপাদান তাদের শৈশবের একটা অংশ, যা যে অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে ভাবনাহীন। তারা আর কোনকিছু জানে না।
এই প্রবন্ধে ব্যবহৃত সকল নাম এবং পরিভাষা লেখকের নিজস্ব এবং এতে ওসি মিডিয়ার সম্পাদক মণ্ডলীর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেনি।