- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাশিয়ার যুদ্ধে ‘কিন্ডারগার্টেনে দাঙ্গা পুলিশ’

বিষয়বস্তু: পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ, রাশিয়া, আইন, ধর্ম, নাগরিক মাধ্যম, প্রতিবাদ, যুবা, সরকার, রুনেট ইকো
[1]

ছবি: পিক্সাবে

প্রথমবার পুলিশ যখন এভগেনিকে ফ্যাসিবাদ প্রচারে অভিযুক্ত করে তখন তিনি  মস্কো থেকে প্রায় ৩৫০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বের একটি প্রাদেশিক প্রজাতন্ত্র মোর্দোভিয়াতে বসবাস করতেন।

পরিপাটি একটা শার্ট আর টাই পরা ছোটখাট একজন মানুষ তিনি। স্থানীয় পুলিশ কিভাবে তাকে একবার নয় দুইবার দুই বছরের জন্যে জেলে আটকে রাখার চেষ্টা করেছিল সেটা বর্ণনা করার সময় তিনি হাসছিলেন।

এভগেনি এটা সত্যি বলে স্বীকার করেন যে তিনি ঐ এলাকার মানুষের কাছে প্রচারপত্র বিলি করতে গিয়েছেলেন। কিন্তু সেগুলো নাৎসি প্রচারণা নয়। এভগেনি খ্রিস্টানদের একটি প্রশাখা যিহোভার সাক্ষী’র অনুসারী – যারা ঈশ্বরের বাণী প্রচারকে তাদের বিশ্বাসের একটি মৌল ভিত্তি হিসাবে দেখেন।

“আমি আমার মুখোমুখি বসে থাকা পুলিশকে বলেছি নাৎসিরা কিভাবে যিহোভার সাক্ষীদের নিপীড়ন করেছিল,” এভগেনি আমাকে বলেন। “পুলিশের লোকটি সেটা বিশ্বাস করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার ফাইলের দিকে তাকিয়ে স্বীকার করেছিলেন এগুলো সব মিথ্যা ছিল। আমি একবার নয় দু'বার জেলকে ফাঁকি দিয়েছি। আমি জানতাম ঈশ্বর আমার সঙ্গে রয়েছে।”

নিজেকে একজন মিশনারী (ধর্ম প্রচারকারী) বলে দাবি করা এভগেনি একটি বাইবেল অধ্যয়ন গোষ্ঠী পরিচালনা করেন এবং ঈশ্বরের বাণী ছড়িয়ে দেন। এখন থেকে তিনি শব্দটি ব্যবহার না করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করবেন। গত জুনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন স্বাক্ষরিত বিভিন্ন নতুন সন্ত্রাসবিরোধী আইনের কারণে আরো ধর্মপ্রচারের কাজ করতে গেলে যা হবে সেটা হলো পুলিশ তাকে জেলে নিক্ষেপ করবে।

মূলত: কট্টর ইসলামী প্রচারকদের লড়াই করার জন্যে পরিকল্পিত নতুন সন্ত্রাসবিরোধী আইনগুলোর সম্ভাবনা সুদূরপ্রসারী। কাউকে (বিস্তৃতভাবে সংজ্ঞায়িত) মিশনারী কাজ করতে হলে তাকে এখন নিবন্ধিত ধর্মীয় সংগঠন বা দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত থাকতে হবে। তারপরও কাজটি শুধু উপাসনা ঘরের মতো বিশেষভাবে মনোনীত এলাকায় সীমিত থাকতে হবে।

এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধকে  সমর্থন করা এভগেনির জন্যে সহজ ছিল না। তবুও তিনি বলেছেন আইনটি ভীতিকর সময়ের একটি নিদর্শন।

“বাইবেলে লেখা আছে বলেই আমরা জনগণের কাছে যাই,” এভগেনি বলেছেন। “আমরা খালি গির্জায় অপেক্ষা করে বসে থাকতে পারবো না। তবে আমি আইনটি নিয়ে চিন্তিত নই কারণ আমি তো কোন ভুল কাজ করছি না।”

এভগেনির মতো মানুষদের আস্থা সত্ত্বেও রাশিয়ার বিতর্কিত নতুন আইনটি ইতোমধ্যে দেশটির আধ্যাত্মিক জগতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।

প্রথম লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলেন মূলত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা একজন স্বাধীন ব্যাপটিস্ট ডন ওসেওয়ার্দে যিনি মস্কো থেকে ২২৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি শহর ওরিয়োলে একটি বাইবেল অধ্যয়ন গোষ্ঠীর নেতৃত্বে দান করেন। ডনের অধ্যয়ন গোষ্ঠীটি ছোট হলেও সেটা পুলিশকে তার বাড়িতে শনিবারের একটা বৈঠকে অভিযান চালানো থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

ইতোমধ্যে সামনে কী ঘটতে চলেছে সেটা জেনেও ডন পুলিশের কাছে তার বৈঠক শেষ করার অনুমতি চান। এরপর তারা তাকে স্থানীয় থানায় নিয়ে গিয়ে অনুমোদনবিহীন ধর্মপ্রচারক কাজ পরিচালনার জন্যে তার বিচার করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। অবশেষে তাকে ৪০,০০০ রুবল (প্রায় ৫৫ হাজার বাংলাদেশী টাকা) জরিমানা করা হয়।

“তারা আমার পিছু নেয়ায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম,” তিনি বলেছেন। “আমি কারো জন্যে সমস্যা ছিলাম না। আমি সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করিনি। আমরা তো রুশ অর্থোডক্স গির্জার বিরোধীও নই। তবে আমি বুঝতে পারি আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কটি এখন কঠিন। এটা আপনার নিজের সমস্যা – বিশেষ করে বিদেশী কারো জন্যে অন্য কাউকে দোষারোপ করার একটা রাজনৈতিক সুবিধা মাত্র।”

এধরনের রাজনৈতিক সুবিধার জন্যে মাঝে মাঝে একটু অতিরিক্ত পুলিশী কর্মের মাধ্যমে মূল্যও দিতে হয়। ডন জানান, স্থানীয় কর্মকর্তারা আসলে তাকে ফাঁদে ফেলেছে। একটি ব্যাক্তিগত লেটারবক্সে তার ছেড়ে দেয়া একটি ফ্লায়ার (প্রচারপত্র) বের করে নিয়ে তারা সেটা আবার একটি আবাসিক বুলেটিন বোর্ডে প্রকাশ্যে সেটে দিয়েছে। এমনকি সব অভিযোগ অপ্রমাণিত হলেও আদালত-নিযুক্ত ডনের আইনজীবী তাকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত হতে পারেন বলে সতর্ক করার পর কর্তৃপক্ষের অবস্থানে স্ফটিকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ডন ইতোমধ্যে রাশিয়ার সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত ছুটে গেলেও এটা ২০ জানুয়ারি তারিখে তার রায় পাল্টাতে অস্বীকার করে। এদিকে সাংবিধানিক আদালতে তার আবেদন এখনো ঝুলে রয়েছে। তবে ডন বলেন ফলাফল যাই হোক না কেন তিনি এখন রাশিয়া ত্যাগ করার পরিকল্পনা করেছেন। তিনি ইতোমধ্যে তার অ্যাপার্টমেন্ট এবং তিনি একসময় যেখানে বাইবেল সভা অনুষ্ঠান করতেন সেই ঘর বিক্রি করে দিয়েছেন এবং তিনি রাশিয়ায় সব ধর্মীয় কার্যকলাপ ছেড়ে দিয়েছেন।

“এটা খুব অন্যায্য এবং নিষ্ঠুর যে এই মানুষদেরকে তাদের উপাসনার – যে কার্যকলাপ তাদের এত আনন্দ দিতো সে সবের – জায়গাগুলো থেকে তাদের নিজেদের সরকার তাদেরকে বঞ্চিত করছে,” ডন বলেছেন। “আমি এখানে যে কয়েক বছর ছিলাম, সম্ভবত: ছোট্ট একটি গোষ্ঠই ঈশ্বরের সান্নিধ্যে শান্তি লাভ করতে পেরেছে। তবে সেটাও এসবকে সার্থক করে তুলেছে। আমি কিছু নিয়েই দু:খ করি না।”

একটি সুবিধাজনক হুমকি

গত গ্রীষ্মে পাস হওয়া আইনটি রাশিয়া ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চাপে রাখার প্রথম আইন নয়, তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে বছরের পর বছর ধরে সরকারের শত্রুতার বিষয়টি জেনে গিয়ে থাকবেন।

ধর্ম ও সমাজ অধ্যয়ন কেন্দ্রের ইউরোপীয় ইনস্টিটিউটের গবেষক রোমান লুনকিন বলেছেন রাশিয়ায় বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর নিপীড়ন এক দশকের বেশি সময় ধরে চলছে।

লুনকিনের মতে “সন্ত্রাসীবিরোধী” আইনটি এর আগে আসা আইনগুলোর অনুরূপ। এটি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে আসলে এমন একটি বিপজ্জনক “গোষ্ঠী” বিবেচনা করতে উৎসাহ যোগায় যাদের হুমকি মোকাবেলা করা কর্মকর্তাদের জন্যে সহজ।

“কোনভাবে তারা এসব আন্দোলনের বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়ার ন্যায্যতা দাবি করলেও তাদের যুদ্ধটি একটি কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে দাঙ্গা পুলিশের (অভিযানের) মতো যেমন হাস্যকর তেমন বিয়োগান্তক হবে,” তিনি বলেছেন।

তা সত্ত্বেও অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, রুশ কর্তৃপক্ষ আগামী মাসগুলোতে নতুন আইনটি আরও কঠোরভাবে লাইসেন্সবিহীন ধর্মপ্রচারকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করবে।

কনস্টানটিন আলেক্সিভ একজন আইনজীবী এবং জনগণের সংস্থা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিষয়ক রাস্ট্রীয় দ্যুমা কমিটির সদস্য। তিনি ডন ওসেওয়ার্দের আপীল আবেদন নিয়ে স্লাভোনিক ন্যায়বিচার কেন্দ্রের সঙ্গেও কাজ করেছিলেন। আলেক্সিভ বলেছেন নতুন “বিরোধী সন্ত্রাসী” আইনটিকে বিচারকরা যেভাবে ব্যাখ্যা করছেন সেই আলোকে তিনি মনে করেন যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্যে রাশিয়ার পরিস্থিতি আরো ঘনীভূত হবে।

“আলোচ্য আইনটি ধর্মপ্রচারের কাজকে নিষিদ্ধ করেনি; এটা (শুধু) নিয়ন্ত্রণ করে। তবে রুশ আইনকে আইনী পাণ্ডিত্যের পরিবর্তে প্রায়শই মনের মধ্যে বিদেশীভীতি এবং কুসংস্কার রেখে ব্যাখ্যা করা হয়,” তিনি বলেছেন।

আলেক্সিভ বলেছেন তিনি মনে করেন রাষ্ট্র রুশ সমাজের উপর যত বেশি ক্ষমতা লাভ করতে চাইবে আদালতগুলো ততবেশি ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করতে বাধ্য হবে। “রাষ্ট্র সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চায় সম্ভাব্য সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা,” আলেক্সিভ বলেছেন। “নির্দিষ্ট আইনে এই দুটি কারণের ভারসাম্য থাকতে হবে। দোলকটি বর্তমানে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার দিকে দুলে আছে, তাই আমরা ধর্মীয় আইনকে আরো গুটিয়ে আনা দেখতে পাবো।”

মানবিক সাহায্য

দেশেটির ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত এবং প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও অনেক গির্জা রাশিয়ায় তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে।

রাশিয়াতে সাতটি মিশন চালানো মর্মন গির্জা হলো আরেকটি সংস্থা যাকে অবশ্যই নতুন নিয়মকানুনগুলো মেনে চলতে হবে। মর্মনরা রাশিয়াতে তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। তবে মিশনারী হিসেবে কাজ করা তরুণদের নিজেদের “স্বেচ্ছাসেবক” পরিচয়ে দিতে বলা হয়েছে বলে কথিত রয়েছে।

“গির্জা [ধর্মপ্রচার কাজের] আইনটিকে সম্মান করবে, সমুন্নত রাখবে এবং মেনে চলবে,” একটি সংবাদ বিবৃতিতে গির্জার একজন মুখপাত্র এ খবর জানিয়েছেন। “মিশনারিরা রাশিয়ায় থাকবে এবং পরিবর্তনের এসব প্রয়োজনীয়তার মধ্যেই কাজ করবে। গির্জা কার্যকর হতে যাওয়া আইন এবং এর প্রভাব আরো অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করবে।”

ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মানবিক সাহায্যের ওপর বেশি জোর দিয়ে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে বলে অনেকে এখনো আশাবাদী। দূরপ্রাচ্যের রুশ শহর নাখোদাতে একসময় কাজ করা সাবেক মর্মন ধর্মপ্রচারক রায়ান গার্ডার বলেছেন তার গির্জা অভাবগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণদের নিয়ে নিজ কাজ চালিয়ে যাবে।

“মর্মন গির্জা অভাবগ্রস্তদের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে খুব সক্রিয়,” রায়ান বলেছেন। “আমরা বুঝতে পেরেছি সবাই আমাদের সম্পর্কে আরো জানা তো দূরের কথা আমাদের বিশ্বাসে সবাই আগ্রহী নন। তারপরও আমাদের বিভিন্ন সময় সাহায্যের হাতের দরকার হয়। সেই ভূমিকাটি পালন করতে পেরে আমরা আনন্দিত।”

এভগেনির মতো অন্যরা আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। “আমরা হিটলারের সময় এই কাজ করেছি। আমরা স্ট্যালিনের সময় এই কাজ করেছি,” তিনি বলেছেন। “এটা শুল্ক কর্তৃপক্ষের ব্যাপার বলে এখন তারা আমাদের সাহিত্য এবং আমাদের বাইবেলগুলো আটকে করে রেখেছে। আমরা বাইবেলগুলো এখানে পেলে কাজ চালিয়ে যেতে পারবো।”