সিরিয়ার ইদলিব শিশু শ্রমিকদের ছোট হাতে বড় বোঝা

গ্রামীণ ইদলিবের কাফ্রানবেলের একটি গাড়ি মেরামতের দোকানে হামেদ আল-বেয়ুশ। ৩০ জানুয়ারি, ২০১৭ তারিখে তোলা। উত্স: হুদা ইয়াহিয়া/ অকথিতসিরিয়া।

এই গল্পটি মূলত: অকথিত সিরিয়া'র জন্যে ইদলিবের গ্রামাঞ্চলের ইতিহাসে একটি ইসলামিক ডিগ্রী (ইজাজাহ) নেয়া একজন সাংবাদিক এবং অ্যাক্টিভিস্ট হুদা ইয়াহিয়ার লেখা। অনুবাদ করেছেন নাজিহা বাশিরি। একটি অংশীদারিত্ব চুক্তির অংশ হিসেবে এখানে পুনরায় প্রকাশ করা হল।

গ্রামীণ দক্ষিণ ইদলিবে তাদের নিজ শহর মারাত আল নুমানে বেড়ে চলা জীবনযাত্রার ব্যয়ের পরিস্থিতিতে বিধবা মাকে সাহায্য করার জন্যে ১২ বছর বয়সী মাশাব আল বাকুরের জন্যে স্কুল ছেড়ে চাকুরি খুঁজে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ ছিল না।

মাশাব ২০১৫ সালে একটি বিমান হামলা সময় গোলার টুকরোর আঘাতে তার বাবাকে হারায় অল্প বয়সে কাজে যোগ দেয়া সিরিয়ার আরো অনেক শিশুদের একজনের মতো। দরিদ্র পরিবারে থেকে আসা এই শিশুরা চলমান যুদ্ধের কারণে আমূল পরিবর্তিত সিরিয়ার জীবনযাত্রার পরিস্থিতিতে সাধারণত তাদের পরিবারে প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়েছে। ফলে সীমিত শিক্ষা এবং অস্বাস্থ্যকর ব্যক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে তারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়।

কামারশালায় কর্মরত মাশাব অকথিতসিরিয়া’কে বলেছে: “জীবনযাত্রার [উচ্চ] খরচ আমাকে এই কাজ নিতে বাধ্য করেছে। কঠিন এবং স্বল্প বেতনের হলেও এটা কিছু না পাওয়ার চেয়ে অনেক ভালো।” অবসন্ন হলেও নির্দোষ চেহারার ১২ বছর বয়সী ছেলেটি আনন্দের সঙ্গেই বলেছে: “আমার দৈনিক বেতনে আমি প্রতিদিন দুই ব্যাগ রুটি কিনতে পারি।”

দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করা মাশাবের দায়িত্ব জেনারেটর চালু এবং বন্ধ করার পাশাপাশি ধাতব টুকরোগুলোকে একসঙ্গে জোড়া দেয়া। তার দৈনিক বেতন হলো ২৫০ সিরীয় পাউন্ড (এসওয়াইপি), প্রায় বাংলাদেশী ৯৪ টাকা। তার মতো অনেক শিশুকেই কম করে মজুরি দেয়া হয় যেটা তাদের প্রতিদিনের কঠোর পরিশ্রমকে প্রতিফলিত করে না। তাদের নিয়োগকর্তারা প্রায়ই তাদের তরুণ বয়স এবং অধিকারের জন্যে তাদের লড়াই করতে না পারার সুবিধা নেয়।

মাশাব এবং অন্যান্য শিশুরা যেখানে কাজ করে সেই কর্মশালার মালিক ৪০ বছর বয়সী আবু আহমেদ (ছদ্মনাম)। তিনি অকথিতসিরিয়া’কে ব্যাখ্যা করেছেন যে মাশাবের দিনপ্রতি মজুরী কমের কারণ এখনো তার তরুণ বয়স এবং সে এখনো পেশার সবকিছু শিখছে। “মাশাব এখানে কাজ করতে চায় এবং আমার তাকে ভাড়া করার [কারণ] হলো তার একটি কাজের প্রয়োজন। সে আরও দক্ষ হয়ে উঠলে এবং ভাল কাজ করতে পারলে আমি তার বেতন দ্বিগুণ করে দেব।”

গ্রামীণ ইদলিবের কাফ্রানবেলের একটি গাড়ি মেরামতের দোকানে ১৪-বছর-বয়সীহামেদ আল-বেয়ুশ। ৩০ জানুয়ারি, ২০১৭ তারিখে তোলা। উত্স: হুদা আল-ইয়াহিয়া/ অকথিতসিরিয়া

মাশাবকে স্কুল ছাড়তে দেখে দুঃখী ৩৫ বছর বয়সী উম্মে মাশাব জানিয়েছেন যে সে শীর্ষ শিক্ষার্থীদের একজন ছিল। তবে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে মাশাবের কাজ তাদের পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয়েরভার বহনে সাহায্য করে এর যোগ্য মূল্য দিয়েছে। তিনি আরো বলেন যে শেষে পর্যন্ত সে হয়তো আরো ভাল কাজের শিক্ষানবিশ হতে পারতো। কোন ডিগ্রী এবং কোন কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়া চার সন্তানের জননী হবার কঠোর বাস্তবতায় উম্মে মাশাব তার পরিবার চালানোতে সাহায্য করার জন্যে এই উভয়সংকটের আর কোন সমাধান খূঁজে পাননি। তার সবচেয়ে বড়টি হলো মাশাব আর তার সবচেয়ে ছোটটি মুহাম্মদ মাত্র তিন বছর বয়সী।

পরিবারটির মাসিক জীবনযাত্রার ব্যয়ের অন্তত: $১০০ (প্রায় ৮,০০০ বাংলাদেশী টাকা) সমপরিমাণ। উম্মে মাশাব মাশাবের স্কুলের ব্যয়ের অতিরিক্ত খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই – খাতা-কলম, জামাকাপড় এবং একদিনের দৈনিক ভাতা মিলে প্রতি বছর $১০০ সমপরিমাণ হবে – এমনকি স্কুল ব্যয় অনে কম হলেও। চার সন্তানের ভরন-পোষণ করার চিত্রটি আসলেই এরকম নিরানন্দময়।

গ্রামীণ ইদলিবে কম সংখ্যক শিক্ষার্থী স্কুলে ভর্তির কারণ প্রধানত: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো লক্ষ্য করে শাসকগোষ্ঠী এবং রুশ বিমান হামলা। এর ফলে যুদ্ধের তীব্রতার সাথে সাথে এলাকায় শিশুশ্রমের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। রুশ হস্তক্ষেপ দুর্দশা শুধু আরেকটু বাড়িয়েছে মাত্র।

স্কুল ত্যাগকারী ১৪ বছর বয়সী হামেদ আল বায়ুশ অকথিতসিরিয়া’কে ব্যাখ্যা করেছেন: “আমার এখনো স্কুলে থাকার কোন উপায় নেই দু’টি কারণে: প্রথমতঃ আমার নিজের ভাতা প্রয়োজন যেটা আমি আমার দরিদ্র পিতার কাছে চাইতে পারবো না। দ্বিতীয়তঃ স্কুলগুলো যেমন থাকার কথা আর তেমন নেই।” হামেদ যা বুঝাতে চেয়েছে সেটা হলো হাস এলাকার একটি স্কুলে সংঘটিত গণহত্যা এবং আরো অনেক গ্রা্মের অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক শিক্ষকই একটি জেট ফাইটার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাওয়ার পর সাধারণতঃ তাদের পাঠদান বন্ধ করে দেন। ১৪ বছর বয়সী ছেলেটির মতে আরেকটি গণহত্যার আশংকা এবং দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়াশুনার কোন মানেই হয় না। শাসকগোষ্ঠী স্কুলগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করায় তার কাছে এখন কর্মস্থলগুলো অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে হয়।

হামেদ একটি গাড়ী মেরামতের দোকানে কাজ করে। এটা একটি কঠিন কাজ হওয়া সত্ত্বেও সে বলেছে যে সে খুশি এবং সন্তুষ্ট, কারণ অন্ততঃ সে এখন  নিজেকে চালাতে এবং এমনকি মাঝে মাঝে তার ভাইবোনদেরকেও সাহায্য করতে সক্ষম। ইদলিবের গ্রামাঞ্চলে বাচ্চা্রা অনেক কাজ হাতে নিয়েছে – ফুটপাতে বেচা-বিক্রি, গবাদি পশু পালন, চাষবাস অথবা বিদ্যুৎমিস্ত্রী, ছুতোর এবং নাপিতের শিক্ষানবিসী করছে।

১৩ বছর বয়সী ওমর এবং ১২ বছর বয়সী যায়েদ দুই ভাই বাড়ি বাড়ি গৃহস্থালী দ্রব্যাদি বিক্রি করছে। ২০১৪ সালে শাসকগোষ্ঠী তাদের পিতাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তারা তাদের পাঁচজনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।

তাদের মা, ৩৯ বছর বয়সী মারিয়াম আল-হাসান তার সন্তানদের কাজ করার জন্যে অখুশী হলেও তার পিঠের সমস্যার কথা উল্লেখ করে বলেছেন: “আমার মত একজন নারী তার সন্তানদের কাজ করতে না পাঠিয়ে আর কী করতে পারে।” “আমি এই কঠোর পরিস্থিতিতে কোনো উপযুক্ত কাজ খুঁজে পাচ্ছি না। আর আমার সন্তানরা যদি টাকা না আনতো, আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম না।”

গ্রামীণ ইদলিবের কাফ্রানবেলের একটি গাড়ি মেরামতের দোকানে ১৪-বছর-বয়সীহামেদ আল-বেয়ুশ। ৩০ জানুয়ারি, ২০১৭ তারিখে তোলা। উত্স: হুদা আল-ইয়াহিয়া/ অকথিতসিরিয়া

কোন সন্দেহ নেই যে এখন সেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে চেয়ে শিশুদের জন্যে ঢের বেশি কাজের সুযোগ রয়েছে। তুলনামূলকভাবে শিশুরা কম বেতন নেয়ার কারণে এখন ইদলিবের গ্রামাঞ্চলে আরো বেশি করে শিশুশ্রম দেখতে পাওয়া যাবে।

সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ৩১ বছর বয়সী আমজাদ আল সেলিম বর্তমানে একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তিনি অকথিতসিরিয়া’কে বলেছেন, “এই ঘটনাটি সমাজে সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ফেলেছে বিশেষ করে শিশুদের উপর।” তিনি শিশুদের অপব্যবহারের – প্রধানত: তারা শারীরিক এবং মানসিকভাবে গ্রহণ করার জন্যে প্রস্তুত নয় তাদের এমন কাজ দেওয়ার – নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন এসব কাজ শিশুদের উপর অনেক চাপ সৃষ্টি করে এবং তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়; এই পেশাগুলো শিশুদের বিকাশে সাহায্য করে না এবং তাদের শিক্ষাকে বাঁধাগ্রস্ত করে।

অন্যদিকে আল-সেলিম বলেছেন তিনি শিশুদের সহজ-সরল – তাদের উপর চাপ সৃষ্টি না করা এবং তাদেরকে একটা ভাল উপার্জন এনে দেয়া – কাজগুলো করার মধ্যে কোন সমস্যা দেখেন না। “আমরা এখন দুঃসময়ে দিনাতিপাত করছে। এটা যুদ্ধকাল এবং নির্দয় সময়। প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারানোতে অনেক নারী ও শিশুদের উপর পরিবার চালানোর বোঝা চেপেছে। তাদের কাজ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই এবং সেইজন্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অভাবে শিশুশ্রমের বৃদ্ধি দেখতে পাওয়াটাই স্বাভাবিক।”

২৯ বছর বয়সী আম্মার আল-সুউয়িদ একজন প্রকৌশলী এবং কাফ্রানবেলের স্থানীয় পর্ষদের একজন সদস্য। তিনি শিশুশ্রমের মাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে স্থানীয় পর্ষদ এবং সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর সাহায্য করা সম্পর্কে অকথিতসিরিয়া’-এর সঙ্গে কথা বলেছেন।

“এতিমদেরকে আর্থিক সহায়তার জন্যে কিছু সমিতি ও সংগঠন কিছু সাহায্য করে। কিন্তু যুদ্ধ ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে এই একই সময়ে দারিদ্র্য এবং অভাব গভীরতর হয়েছে। (তবে) আসলেই সাহায্যের প্রয়োজন এমন সব পরিবারকেই এর আওতায় নিয়ে আসার কোন উপায় নেই।”

সিরিয়া ত্রাণ ও উন্নয়ন-এ কর্মরত মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শক ফাতেন আল-সুউয়িদ অকথিতসিরিয়া’কে জানিয়েছেন যে শিশুশ্রম সব স্তরেই শিশুদের জন্যে ধ্বংসাত্মক। “শিশুরা  তাদের ভাল আর মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা হারায়, এবং নিয়োগকর্তার দূর্ব্যবহারের কারণে তারা ক্রমেই আগ্রাসী হয়ে ওঠে […] শিশুরা স্কুল ছেড়ে দিলে তাদের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ হারানোর ফলে তাদের সৃজনশীল ক্ষমতার উপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।”

এই পরামর্শকের মতে শিশু এবং সমাজ উভয়ের উপরে শিশুশ্রমের দীর্ঘমেয়াদী বিপদ সম্পর্কে পিতা-মাতা সচেতন না হলে কেউ এই ঘটনাটিকে কমাতে পারবে না। সচেতনতা বাড়ানোর জন্যে তিনি সেমিনার, সম্মেলন এবং আলেপ্পোসহ শাসকগোষ্ঠী-নিয়ন্ত্রিত অনেক শহরে ইউনিসেফ (জাতিসংঘ শিশু তহবিল)-এর মতো শিক্ষা অধিবেশন আয়োজনের প্রস্তাব করেছেন। আল-সুউয়িদ বলেছেন যথেষ্ট না হলেও এটিই সিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়া শিশুশ্রমের মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা হতে পারে।

ইউনিসেফ তার শিশুশ্রম বন্ধের প্রচেষ্টায় সফল না হওয়া পর্যন্ত সিরিয়ায় এই ঘটনাটি শুধু বেড়েই চলবে বলে মনে হয়। এটা পুরো একটা প্রজন্মকে অজ্ঞতা এবং নানামূখী শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সমস্যার ঝুঁকির মুখোমুখি করেছে, যা হাতের কাছে থাকা সমস্যাটি মোকাবেলা এবং বন্ধ করার জন্যে সিরিয়ার প্রাসঙ্গিক ভূমিকা-পালনকারীদের সম্মিলিত পদক্ষেপ দাবি করে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .