ভেনিজুয়েলার ‘এল কারাকাজো’ দাঙ্গা: এখনো বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু

ছবি: ফ্রান্সিসকো সোলোর্জানো। সিসি বাই-এনসি-এসএ ২.০ লাইসেন্সের আওতায় ফ্লিকারে ভাগাভাগি করেছেন বের্নার্ডো লন্দয়।

অনেক ভেনিজুয়েলাবাসীর স্মৃতিতে ক্ষত সৃষ্টি করা ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯ এবং এর পরের সপ্তাহের তারিখগুলোকে আধুনিক ভেনিজুয়েলার ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ মুহূর্ত বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হয়ে থাকে। তারপর থেকে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটানো এই দাঙ্গা, লুটপাট আর গুলিবর্ষণের ঘটনাটি এল কারাকাজো বা এল সাকুদোন (জাগরণ) নামে পরিচিতি লাভ করে, যাকে ‘“কারাকাস কঠোরব্যবস্থা” বা “কারাকাসের বড় ঘটনা” নামে ঢিলেঢালাভাবে অনুবাদ করা হয়েছে।

সরকারি নীতির কারণে গ্যাসোলিন এবং গণপরিবহনে তীব্র মূল্য বৃদ্ধি হতে পারে এই আশংকায় কারাকাসের বিক্ষোভগুলো থেকে দাঙ্গাটির জন্ম হয়।

২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে এল কারাকাজো’র ২৮তম বার্ষিকীটি ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করে ভেনিজুয়েলার টুইটারের অন্যতম প্রধান ঝোঁকের (ট্রেন্ডিং) বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। সাধারণ জনগণ দাঙ্গার স্মৃতি ভাগাভাগি করেছে, আর সরকারপন্থী ও বিরোধীদলীয় ব্যবহারকারীরা এল কারাকাজোকে হয় আজকের রাজনৈতিক বিভাজনের প্রারম্ভ নয়তো নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি জনপ্রিয় আন্দোলনের জাগরণ বলে পরস্পরকে বাক্যবাণে জর্জরিত করেছে:

২৮ বছর [পেরিয়ে গেছে] সামাজিক বিস্ফোরণটি এল কারাকাজো [নামে পরিচিত]। আরোপিত অর্থনৈতিক নীতি প্রত্যাখ্যান করে জন্ম নেয়া একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। #২৭ফেব্রুয়ারিবিদ্রোহীজনগণ।

এল কারাকাজো কোন সামাজিক বিস্ফোরণ ছিল না।  এটা একটা কাজে লাগানো সুযোগ যাতে অরাজকতা চাভিস্মো (বামপন্থী আদর্শের শ্যাভেজবাদ) বপণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারে।

“ভেনিজুয়েলাকে চিরদিনের জন্যে বদলে দেয়া বিশৃঙ্খলার ঝাঁকুনি”

এল কারাকাজো’র  কারণ ও পরিণতি ঘটানো পটভূমিটি আজো আলোচনা ও গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভেনিজুয়েলার সমসাময়িক ইতিহাস ও সংকটের ওপর দাঙ্গাটির প্রভাব মেনে নিয়ে সমষ্টিগত সাইট “কারাকাস ঘটনাপঞ্জী” স্মরণ, ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ করে পোস্টের একটি ধারাবাহিক “১৯৮৯ সালে ভেনিজুয়েলাকে চিরদিনের জন্যে বদলে দেয়া বিশৃঙ্খলার ঝাঁকুনি” উৎসর্গ করেছে।

সিরিজের তিনটি পোস্ট–কে এল কারাকাজো কী ছিল এবং আজকের রাজনৈতিক আলাপচারিতায় এর অবস্থান ব্যাখ্যায় নিয়োজিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রাফায়েল ওসিও কাব্রিসেস এবং সিনথিয়া রদ্রিগেজ মিলে দাঙ্গাটির আগের সময়, ঘটনাকাল এবং পরবর্তী সময় বুঝতে চেষ্টা করা রেফারেন্স বা উল্লেখ এবং প্রমাণাদি একত্র করেছেন:

পাঁচ বছর ধরে অর্থনৈতিক পতন ও দুর্নীতির কেলেংকারীর পর [ভেনিজুয়েলার সাবেক রাষ্ট্রপতি কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ] ভেনিজুয়েলাকে আবার মহান করার একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন […] যারা তাকে ভোট দিয়েছেন তারা ৭০-এর দশকে তার প্রথম প্রশাসনের সময়ে ভেনিজুয়েলায় উপভোগ করা আরেকটি ভোগবাদী উন্মাদনা প্রত্যাশা করেন। এটা আর হবে না। তেলের দাম প্রায় ১৯৭৭ সালের মতো একই হলেও আন্তর্জাতিক মজুদের আকারের তুলনায় জাতীয় ঋণ ছিল দ্বিগুণ এবং তাদের চারিদিকে আরো অনেক মানুষ ছিল।

সাবেক রাষ্ট্রপতি কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজের বেশিরভাগ পদক্ষেপ অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল। কিন্তু যেটা রাস্তায় আগুন জ্বালিয়েছিল সেটা হলো গ্যাসোলিনের ভর্তুকি বাদ দেয়া। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এটা গ্যাসোলিন এবং গণপরিবহনের খরচ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি করে রাজধানীর ভিতরে ও বাইরে বিক্ষোভ উস্কে দিয়েছিল:

আমরা এটাকে এল কারাকাজো বলতে পারি, কারণ রাজধানীটিই ছিল মূল মঞ্চ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রধান উৎস।  তবে ২৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে শুরু করে সংক্রমণটি [রাজধানীর চারপাশের শহরগুলোতে] বাণিজ্যিক এলাকায় ঘনীভূত আকার ধারণ করে। পুলিশ, [জাতীয় রক্ষীবাহিনী] এবং ডিআইএসআইপি [জাতীয় গোয়েন্দা এবং প্রতিরোধ পরিষেবা অধিদফতর] সেখানকার সহিংসতা বন্ধ করতে পারেনি […] ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে লুটেরারা পশ্চিম এবং কেন্দ্রীয় কারাকাসে ছড়িয়ে পড়ে। সংখ্যাধিক্যে স্পষ্টভাবে পিছিয়ে পড়ায় [মেট্রোপলিটন পুলিশকে] অকার্যকর মনে হয়, এভাবে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো রাজনৈতিক নেতাই সহিংসতাটি পরিচালনা করেননি।  কেন্দ্রীয় এবং পশ্চিম কারাকাসের কিছু রাস্তা ও রাজপথগুলো প্রতিবন্ধক অথবা জ্বলন্ত বাস ও ট্রাক দিয়ে আটকে দেয়া হয়। এটা ছিল বেপরোয়া দারিদ্র্য ও প্রায়োগিক সুবিধাবাদের ক্রোধ এবং আনন্দের একটি ভূরিভোজ। সেখানে পুলিশ ও সৈন্যরা থাকলেও কিছুই করছিল না; তারা আদেশের জন্যে অপেক্ষা করছিল। এদিকে কারাকাসে উপত্যকার পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের ঢালের ব্যারিও (দরিদ্র এলাকা)-গুলো থেকে দলে দলে দরিদ্র জনসাধারণ নিচে নেমে আসে। অবশেষে দুর্যোগের ভবিষ্যৎ বক্তারাই সঠিক প্রমাণিত হন: “এল দিয়া এন কে বাহারান লস সেরোস” [যেদিন বস্তিবাসী শহরে নেমে আসবে] এসেছিল।

ধারাবাহিকটি মানবাধিকারের প্রচার এবং লঙ্ঘন নথিভুক্ত করায় নিয়োজিত ভেনিজুয়েলার বেসরকারি সংস্থা প্রোভিয়া (ভেনিজুয়েলার মানবাধিকার শিক্ষা ও আন্দোলন কর্মসূচী) প্রদত্ত প্রতিবেদনগুলোর একটির উপর একটি ব্যাপক বিশ্লেষণ  উপস্থাপন করে। কারাকাজোর ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে তাদের কাজ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ঘটানো লংঘনের উপর নতুন অনুসন্ধানলব্ধ তথ্য সামনে নিয়ে আসে:

এই সময়কালে বেশিরভাগ মৃত্যুই ঘটেছিল সান্ধ্য আইন চলালাকালীন রাতে কোমর থেকে উপর দিকে চালানো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বুলেট সৃষ্ট ক্ষত থেকে। নিহতদের আত্মীয়দের প্রতিবেদন অনুসারে কারাকাসের জনপ্রিয় অঞ্চলগুলোতে চালানো সামরিক যুদ্ধকৌশলটি […] ছিল গুটিকয়েক লক্ষভেদীর গুলি চালানোর প্রতিক্রিয়ায় এ্যাপার্টমেন্ট এবং ঘরগুলোর দিকে নির্বিচারে গুলি করা, যার ফলে এদের অনেকগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

মৃত্যুর সংখ্যা সম্পর্কে প্রতিবেদনটি বলেছে:

তৎকালীন প্রসিকিউটর জেনারেলের দেয়া প্রতিবেদনে মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক সংখ্যাটি ২৭৬ জন হলেও ঐ প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে পরিপূর্ণ কোন তদন্ত করেনি। প্রাতিষ্ঠানিক গোপণীয়তা, সংবাদমাধ্যমের উপর আরোপিত সীমাবদ্ধতা এবং কঠোর অবদমন হতাহতের সংখ্যা উপযুক্তভাবে গণনা এবং নথিভুক্ত করায় বাঁধা সৃষ্টি করেছিল।

অপরপক্ষে মৃত্যুর ধরনটি এক হাজার জন, দশজন বা এমনকি শুধু একজনকে শিকারে পরিণত করেছে কিনা সেটা বিবেচনা নির্বিশেষে মৃত্যুর অগ্রহণযোগ্য ধরনটি বিবেচনা করার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত গণনার কোনো প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে কিনা সেটা ভেবে আমাদের অবাক হতে হয়। ভেনিজুয়েলার সংবিধান জীবনের অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তাকে স্থগিত করার অনুমতি দেয় না। তারপরও সবসময় একটি অনুভূতি বিরাজ করে যে হত্যা করার সুযোগ লাভের জন্যেই বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী কিছু কিছু নিশ্চয়তাকে স্থগিত করে নেয়। একটি সংবাদ প্রতিষ্ঠান একজন ক্যাপ্টেনের কথা রেকর্ড করেছিল, তিনি বলছিলেন: “এখানে যখন সৈনিক নিহতের ঘটনা ঘটবে, আমরা আমাদের কাজ আরো জোরদার করবো… [হত্যা করা] কঠিন নয়, কারণ আমরা ইতোমধ্যেই  প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অভ্যস্ত এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত।”

এল কারাকাজো নিয়ে জনগণের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, মানবাধিকার লংঘন এবং বিভ্রান্তিকর বর্ণনাগুলো – বিশেষ করে যারা বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী দিনগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করে দেখেন তাদের কাছে – আজকের ভেনিজুয়েলাকে বিভক্তকারী একটি বিষয় হয়ে থাকবে।

গিয়ানমার্কো গ্রেসি “এল কারাকাজোর মুখোমুখি” ধারাবাহিকে তার লেখা অংশে যুক্তি করেছেন যে এটা দেশটির ইতিহাসের এমন একটি বেদনাদায়ক এবং বিভ্রান্তিকর অংশ যে কাউকে অবশ্যই এটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে, অথবা শুধু এটা সম্পর্কে চিন্তা করা বন্ধ করে দিতে হবে:

প্রতিক্রিয়াগুলোকে দু’টি সর্বব্যাপ্ত আখ্যানে বিভক্ত করা যায়: একদিকে এস্তাইদো সোসিয়াল [একটি সামাজিক বিস্ফোরণ] অনেক প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোকে বুঝতে না পারা একদল অদূরদর্শী মানুষ যারা অসভ্য বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে অন্য কিছু আশা করেছিল। অন্যদিকে, দেস্পার্তার দে উন পুয়েব্লো [জনগণের জাগরণ] আখ্যানটি ঘটনাবলীকে অসংহত চাভিস্মো (বামপন্থী আদর্শের শ্যাভেজবাদ) – সাম্রাজ্যবাদী নব্যউদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলনের সচেতনতা তৈরির মুহূর্ত – হিসেবে রাজনৈতিকীকরণ করে। দু’টি পাঠ, দু’টি ভেনিজুয়েলা।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .