
জর্জিয়ান ভাষার বর্ণমালা।” জর্জিয়ান ভাষায় লিখুন প্রতিযোগিতা”-এর একটি ভুক্তি। ছবিটি ‘জর্জিয়ান ভাষায় লিখুন’ নামক প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট থেকে নেয়া।
নিচের লেখাটি ইউরেশিয়ানেট.অর্গ থেকে নেয়া হয়েছে অংশীদারিত্ব চুক্তির আওতায়। পোস্টটি লিখেছেন মনিকা ইলিনা এবং এটি অনুমতি সাপেক্ষে প্রকাশিত।
দাতো দোলিৎযিসের আঙ্গুলগুলো একটি পুরাতন হ্যান্ডসেটের উপর আস্তে আস্তে ঘুরছিলো, যখন তিনি তাঁর পুত্রকে ক্ষুদেবার্তা লিখছিলেন।
“আমার মুঠোফোনে শুধু ল্যাটিন বর্ণমালা আছে, তাই আমি যতোবারই ক্ষুদেবার্তা পাঠায় ততোবারই প্রথমে আমাকে জর্জিয়ান অক্ষরকে ল্যাটিনে অনুবাদ করতে হয়। এটা যন্ত্রণাদায়ক।” কথাগুলো বলছিলেন তিবলিসি সবজি-বাজারের পঞ্চাশোর্ধ এই কমলা বিক্রেতা।
যখন নতুন স্মার্টফোন জর্জিয়ান বর্ণমালা ব্যবহারের সুবিধা চালু করলো, তখন দাতো দোলিৎযিসের মতো জর্জিয়ার অনেকেই- যেখানে গড়পড়তা মাসিক বেতন ৩৩৩ ডলার- তাঁদের সস্তা, পুরনো মুঠোফোনেই আটকে রইলেন।
জর্জিয়ার এই অসাধারণ বর্ণমালার অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু এরকম ডিজিটাল আপোসের ফল।
জর্জিয়ান বর্ণমালার সর্পিলরূপ শত বছর ধরে পণ্ডিত এবং লিপি বিশারদগণকে আকৃষ্ট করে আসছে। অতিসম্প্রতি, গত ডিসেম্বরে জাতি সংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো জর্জিয়ান বর্ণমালাকে সংস্থারটির মানবতার বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শীর্ষক তালিকার অন্তর্ভূক্ত করেছে।
জর্জিয়ান ভাষায় প্রকৃতপক্ষে তিন ধরনের লিপি আছে– যার একটি ম্যাকাড্রুলি, বর্তমানে দৈনন্দিনের ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়, আর প্রাচীন আসমট্রাভরুলি ও নুশখুরি-এর প্রয়োগ মূলত ধর্মশাস্ত্র ও প্রাচীন পুঁথিপত্রে দেখা যায়। এই তিন লিপি সম্পর্কে ইউনেস্কো তার তথ্যপঞ্জিতে লিখেছে,“ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়েও তাদের এই সহাবস্থানকে ধন্যবাদ, এতে জর্জিয়ার সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ স্বাতন্ত্র্য প্রতিফলিত হয়েছে।”
জর্জিয়ান বর্ণমালার আসন্ন বিপদ কম। কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিক ভাবে এটি অবহেলিত, এটির প্রয়োগ শুধুই জর্জিয়ান এবং জর্জিয়ায় প্রচলিত মিনগ্রেলিয়ান ও সভানের মতো সংশ্লিষ্ট ভাষাগুলোতে হয়। উল্লেখ্য, এই ভাষাগুলোতে 3.7 মিলিয়ন বা পৃথিবীর জনসংখ্যার 0.06 ভাগ মানুষ কথা বলে। পৃথিবীব্যাপী গৌণ ভাষাগুলো প্রতি চৌদ্দদিনে একটি হারে মৃত্যুবরণ করছে। জর্জিয়ার কিছু মানুষ নিজেদের ভাষা বা বর্ণমালার দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিবলিসিত-এর ইলিয়া চ্যাভচ্যাভাদেয সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা শিক্ষা বিদ্যায়তন (ইনস্টিটিউট)-এর বিভাগীয় প্রধান নিনো দোব্রোজনিদয বলেন,“বিশেষভাবে গৌণ ভাষাগুলোর অবস্থা শোচনীয়, তাই তাদের এখনই সংরক্ষণ প্রয়োজন।” তিনি আরো বলেন, “জর্জিয়ানসহ এ ধরনের ভাষার জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবনের অভাব পক্ষান্তরে বিভিন্ন মিডিয়ায় অর্থাৎ মৌখিক, পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত অবস্থায় রক্ষিত মূল্যবান জর্জিয়ান ভাষার তথ্য আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচারের পথকে বাঁধাগ্রস্ত করছে।”
2015সালে প্রকাশিত ইউনোস্কোর এক প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সাত হাজার একশতটি ভাষা ব্যবহৃত হয়- এর মধ্যে পাঁচশতটি অনলাইনে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এই পাঁচশত ভাষার মধ্যে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় সার্চ ইঞ্জিন গুগল সমর্থন করে কেবল 348টি ভাষা। যে ভাষাগুলো ইন্টারনেটে স্থান করতে পেরেছে তাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে: উদাহরণ স্বরূপ জর্জিয়ান ভাষার কথা বলা যেতে পারে, মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে ভাষাটির প্রতিনিধিত্ব করছে কেবল একটিমাত্র ফন্ট।
জর্জিয়ান ভাষার সীমিত অনলাইন উপস্থিতির ফলশ্রুতিতে, জর্জিয়ান লিপির পরিবর্তে ল্যাতিন লিপি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচারণা-কার্যে ব্যবহৃত রচনায় ল্যাটিন বর্ণমালা ব্যবহারের প্রবণতা পরিলিক্ষত হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ: “25% ფასდაკლებას ახალ ჩამოსვლის” এর পরিবর্তে ল্যাতিন ভাষায় “25% p’asdaklebas akhal ch’amosvlis (২৫% পাসদাকলেবাস আখাল ছামোসোভিস)”(নবাগত দ্রব্যের উপর ২৫% ছাড়।) লেখার প্রবণতা রয়েছে।
জর্জিয়ার ওয়েব উপস্থিতি বৃদ্ধিতে সমর্থন দেবার জন্য বেসরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। ২০১৫ সালে শিল্প পরিকল্পনাবিদ যাভিয়াদ তিসিকোলিয়া জর্জিয়ার বৃহৎতম ঋণ প্রদানকারী সংস্থা টিবিসি ব্যাংক-এর সাথে যৌথভাবে #জর্জিয়ানভাষায়লিখুন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তিনি স্বেচ্ছাসেবীদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে নতুন শৈলীর বর্ণ সৃষ্টির আহ্বান জানান। জর্জিয়ানরা খুব উৎসাহের সাথে সে আহ্বানে সাড়া দেন, মাত্র পাঁচ সপ্তাহে ১৬০টি নতুন ফন্ট জমা হয়।
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক তিসিকোলিয়া ব্যাখ্যা করেন, “আমাদের ভাষা ও বর্ণমালা আমাদের ঐতিহ্য – একটি মূল্যবান সম্পদ । একে শুধু সংরক্ষণ করলেই চলবে না, একে জীবিত ও হালনাগাদ রাখতে হবে।” তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদিনের কাজে ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যমে হিসাবে জর্জিয়ান ভাষা ব্যবহারের একজন সমর্থক। তিনি আরো বলেন, “পৃথিবী ক্রমাগত ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের লিপিকে দ্রুত মানিয়ে নিতে হবে। আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে- শুধু কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না।”
তিসিকোলিয়া বলেন, মার্চ মাসের মধ্যে সবগুলো ফন্ট প্রতিযোগিতার ওয়েবসাইটে বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাবে। তিনি মন্তব্য করেন, “আমাদের ভবিষ্যৎ হলো গ্লোকাল, একজন বিশ্বনাগরিক যিনি জাতীয় ঐতিহ্যকে মূল্য প্রদান করেন। তিসিকোলিয়া জানান, “জর্জিয়ান কিবোর্ডে স্থানান্তরিত হতে মাত্র দুই সেকেন্ড সময় লাগে, কিন্তু অনেক মানুষ এই কষ্টটুকুও করতে রাজি নন।”
প্রতিবেশী আর্মেনিয়া একই ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করছে। কারণ আর্মেনিয়াতে এককভাবে আর্মেনিয়ান ভাষা এবং তার বর্ণমালা প্রচলিত রয়েছে।
মিডিয়া ডিসকাশন প্লাটফর্ম মিডিয়া.এএম-এর সম্পাদনা পর্ষদের প্রধান জেগম ভারদানিয়ান ব্যাখ্যা করেন,“ইসরায়েলের বাইরে বসবাসরত বিপুল সংখ্যক ইহুদিদের মধ্যে প্রতিবর্ণীকরণ সাধারণ ব্যাপার হলেও তারা এক্ষেত্রে একা নন।” তিনি আরো বলেন,“প্রতিবর্ণীকরণে শুধু ল্যাতিন লিপি ব্যবহৃত হয় না, রাশিয়ায় বসবাসরত আর্মেনিয়ানরা আর্মেনীয় ভাষায় যোগাযোগ করতে সিরিলিক লিপি ব্যবহার করেন। ফলে এক কিম্ভূতকিমাকার অবস্থার সৃষ্টি হয়, যার কোন কিছুই আপনার বোধগম্য হবে না।”
জর্জিয়ার মতো এখানেও উৎসাহীরা এগিয়ে আসছেন। আর্মেনিয়ার মানবাধিকার ন্যায়পালের প্রেস কর্মকর্তা যোহরাব ইয়াগাইয়ান ওয়েবে আর্মেনীয় ভাষা যে দুর্ব্যবহার পাচ্ছে তা দেখতে দেখতে তিনি ক্লান্ত। তিনি নিজের মনোভাব ফেসবুক পেজে ব্যক্ত করেছেন। তিনি ২০১২ সালের একটি পোস্টে লিখেছেন, “আসুন ফেব্রুয়ারির 7 তারিখকে ইন্টারনেটে আর্মেনিয়ান লিখি দিবসে পরিণত করি।” এতে আর্মেনিয়ান এবং ইসরায়েলের বাইরে বসবাসরত ইহুদিদের মধ্যে থেকে আশাব্যাঞ্জক সাড়া পাওয়া গিয়েছে।
ইয়েগানিয়ান ইয়েরেভান থেকে ইউরোশিয়ানেটকে জানান,“সেখানে এমন মানুষ আছেন যারা শুধু আর্মেনীয় ভাষায় কথা বলেন। তারা এই ভাষায় কীভাবে লিখতে হয় তা শেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর্মেনীয় ভাষায় পোস্ট দেবার মাধ্যমে সেটি শুরু করেছেন।” ইয়েগানিয়ান বলেন যে, আর্মেনিয়ার সরকার বর্ণমালাকে সহায়তা দেবার ব্যাপারে তুলনামূলকভাবে নিষ্ক্রিয়। অন্যদিকে বেসরকারিখাতের প্রতিষ্ঠানগুলো যে আমজনতার মনোভাবকে সম্মান করছে তার লক্ষণ নজরে আসতে শুরু করেছে। তিনি বলেন,“ সম্প্রতি একটি মুঠোফোন কোম্পানি আর্মেনীয় লিপিতে নিজ গ্রাহকদের কাছে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো শুরু করেছে। পূর্বে তারা এক্ষেত্রে রোমান বর্ণমালা ব্যবহার করতো।”
জনপ্রিয় এই উদ্যোগ জাতীয় লিপিকে পুনরায় ফ্যাশনেবল করে তুলছে। ইয়েগানিয়ান যুক্তি দিয়ে বলেন, মানুষ ক্রমশ: অনুভব করছে যে, তাদের নির্ধারিত বর্ণমালা তাদের ভাষার ধ্বনিগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অতুলনীয় রূপে উপযুক্ত।
ইয়েগানিয়ান বলেন,“প্রতিবর্ণীকরণ এখন আর কোনো হাল-ফ্যাশন দুরস্ত বিষয় নয়। বর্তমানে এটি কোনো কিছুকে বা কাউকে উপহাস করার জন্য প্রয়োগ করা হয়।”