সরাসরি সম্প্রচারিত টেলিভিশন-অনুষ্ঠানে মানবাধিকার কর্মীকে ধর্ষনের হুমকি দিলো পাকিস্তানি সিনেটর

Senator Hamdullah, Barrister Masroor and Marvi Sirmed during the argument. Screenshot from Dawn News video.

তর্করত সিনেটর হামিদুল্লাহ, ব্যারিস্টার মনসুর, মারভি সিরমদ। ছবি: ডন নিউজ

একটি টিভি শো চলাকালীন পাকিস্তানি সিনেটর হাফিজ হামিদুল্লাহ অনুষ্ঠানের অপর আলোচক মানবাধিকার কর্মী মারভি সিরমদকে মৌখিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। ১০ জুন শুক্রবার সরাসরি প্রচারিত সে অনুষ্ঠানে তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে সিনেটর হামিদুল্লাহ মারভি সিরমদকে ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দিয়ে বসেন। উল্লেখ্য, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামিয়াতুল-ই-উলেমা-ই-ইসলাম ফজল (জেইউআই-এফ) এর প্রতিনিধিত্বকারী হামিদুল্লাহ ইতঃপূর্বে ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরাসরি সম্প্রচারিত টিভি অনুষ্ঠানে লাঞ্ছিত করেছেন।

অনুষ্ঠান রেকডিং শেষ হবার কিছুক্ষণ পরেই সিরমদ ফেসবুকে নিজের আভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। এরপর চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ফলশ্রুতিতে পুলিশকে বিষয়টিকে জানানো হয় এবং বিভিন্ন মহল থেকে সিনেটর হামিদুল্লাহর বিচার দাবি করা হয়।

আমি এইমাত্র নিউজ ওয়ান-এর একটি অনুষ্ঠানে (নাদিয়া মির্জা শো) এক যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। ব্যারিস্টার মাসরুরের একটি মন্তব্যে জেইউআইএফ এর হাফিজ হামিদুল্লাহ রাগান্বিত হয়ে পড়লে ঘটনার সূত্রপাত হয়। অনুষ্ঠানে আমার বলার পালা আসলে আমি বলি, “আমি মাসরুর সাহেবর সাথে একমত…” এইটুকু বলার পর হামিদুল্লাহ আমাকে তার দম্ভ ও কর্কশ আচরণ দিয়ে থামিয়ে দেন। আমি একই সুরে পাল্টা জবাব দিলে তিনি আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। এমনকি আমাকে ‘পতিতা’ আখ্যায়িত করে বলেন, “তুমহারি সালওয়ার উতার দুংগা অর তুমহারি মা কি ভি” (তোমার পাজামা খুলে নিবো, সাথে তোমার মায়েরও)। আমি সেই কথাগুলো তাঁর পরিবারের নারীদের প্রতি ফিরিয়ে দিলে তিনি আমাকে প্রহার করার চেষ্টা করেন। সবকিছু ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। এরপর হামিদুল্লাহ আমার দিকে ঘুষি চালালে ফাইয়াজ উল হাসান চৌহান তাঁকে ধরে ফেলেন, যাতে ঘুষি আমার পর্যন্ত না পৌঁছাতে পারে।

এবং এই ধর্ম ব্যবসায়ী যখন এসব করছিলেন তখন তিনি নাকি রোজা ছিলেন।

পরিহাসের বিষয় হলো, ঘটনাটি এমন একটি অনুষ্ঠান রেকডিং-এর সময় ঘটে যেটির বিষযবস্তু ছিলো পাকিস্তানে প্রথায় পরিণত হওয়া তথাকথিত “অনার কিলিংস” (এটি একটি প্রচলিত প্রথা যাতে পরিবারের কোনো সদস্যকে বিশেষত কন্যা বা মহিলাকে বংশের সম্মানহানির জন্য স্বজনেরা হত্যা করে।) এবং উল্লিখিত বিষয়ে কাউন্সিল অফ ইসলামিক আইডিওলজি (সিআইআই)-এর নীরব ভূমিকা। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত সিআইআই একটি সাংবিধানিক সংস্থা যা কুড়ি জন সদস্য নিয়ে গঠিত। এই সংস্থাটির কাজ হলো সরকারকে আইন ও সমাজের ধর্মীয় পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করা। উল্লেখ্য, সংস্থাটির দিকনির্দেশনা অনুসরণ করা সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। সিআইআই'কে বিশেষভাবে নারীর উপর হওয়া সহিংসতা বন্ধে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হয়।

কাউন্সিল অফ ইসলামিক আইডিওলজি সম্প্রতি স্বামী কর্তৃক “স্ত্রীকে হালকা প্রহার” এর অনুমতি দিয়ে একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করে এবং ব্যপক সমালোচিত হয়। দৈবাৎ, হামিদুল্লাহ সিনেটের ধর্ম ও বিভিন্ন বিশ্বাসের সহাবস্থান বিষয়ক কমিটির সভাপতি ছিলেন।

সেই টিভি শোতে আলোচক ব্যারিস্টার মাসরুর বিদ্রুপ করে বলেন- সিআইআই এর সভাপতি আলেম মাওলানা শিরানি এবং সিনেটর হামিদুল্লাহ“ পি কে শোয়ে হুয়া হে” (মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে আছেন)। মনসুর, নারীর উপর ঘটে চলা সহিংসতার জন্য ‘সিআইআই'র সমালোচনা করেন। এরপর অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা নারীর অধিকার এবং ‘অনার কিলিং’ বিষয়ে সিআইআই-এর নীরব ভূমিকা প্রসঙ্গে সিরমদের মতামত জানতে চান। সিরমদ মাসরুরের বক্তব্য সমর্থন করেন। এতে হামিদুল্লাহ রাগান্বিত হয়ে চিৎকার শুরু করে দেন। তর্কবিতর্ক ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে হামিদুল্লাহ সিরমদকে ধর্ষণের হুমকি দেন।

হাফিজদের মধ্যে লড়াই,ভিডিও:শোয়েব ভিডিও

সম্পাদনা করা ভিডিও থেকে ধর্ষণের হুমকি এবং অশালীন শব্দগুলো মুছে ফেলা হয়। সিরমদ নিজ ফেসবুক পেজ ও অন্য একটি টিভি শোতে হামিদুল্লার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনেন এবং তাঁর উপর শারীরিক হামলা প্রচেষ্টা প্রসঙ্গে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। যদিও শারীরিক হামলা প্রচেষ্টার ভিডিও এখনো প্রকাশ করা হয়নি। ব্যারিস্টার মাসরুর টুইট করে সিরমদের বক্তব্যকে সমর্থন ও জোরালো করেন:

আজ @নাদিয়া__এ_মির্জা উপস্থাপিত @10পিএমউইথনাদিয়ামির্জা অনুষ্ঠানে @মারভিসিরমদ-এর সঙ্গে হাফিজ হামিদুল্লাহ যে জঘন্য আচরণ করলেন তা দেখে আমি হতভম্ব। হামিদুল্লাহ সিরমদকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করেন (শারীরিকভাবে আক্রমণের চেষ্টাও করেন)

মারভি সিরমদ ঘটনাটি শেয়ার করার পর অন্যরা তাদের অভিজ্ঞতা- হামিলুল্লাহ'র নোংরা আচরণের মুখে পতিত হবার- নিয়ে মুখ খোলেন।

সাংসদ ড.আরিফ আলভি সিরমদের সমর্থনে নিজ অভিজ্ঞতা ভাগ করেন:

আমি হতভম্ব। এই ইতর লোকটি আমাকে একবার অনুষ্ঠান সম্প্রচার চলাকালীন হুমকি দিয়ে বলেছিলো: “তোমার জিহ্বা কেটে নিবো।”, লজ্জাকর। তাঁকে টিভিতে নিষিদ্ধ করা উচিত।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রানা ওয়ালিদ ইতঃপূর্বে হামিদুল্লাহর হাতে লাঞ্ছিতদের একটি তালিকা দেন। উল্লেখ্য, হামিদুল্লার হাতে লাঞ্ছিতদের মধ্যে অনেক টিভি উপস্থাপকও র‍য়েছেন:

আজ পর্যন্ত যাঁরা হাফিজ হামিদুল্লাহ'র হুমকি পেয়েছেন বা অশ্লীল গালি শুনেছেন:
১) @আমিরলিয়াকত
২) @আরিফআলভি
৩) @ফারিহা
৪) @মারভিসিরমদ

সিরমদ এর আগেও অনেক অনুষ্ঠানে হামিদুল্লার সঙ্গে অংশ নিয়েছেন এবং প্রতিবারই কোন রাখঢাক ছাড়াই হামিদুল্লার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এবার তিনি সিরমদকে কথাই বলতে দেননি এবং শেষপর্যন্ত হুমকি দিয়েছেন। টিভি স্টুডিওর ফুটেজ দেখার পরেও অনলাইনে অনেকেই দাবি করেছেন- সিরমদ-ই লড়াইয়ের উস্কানিদাতা । ইতোমধ্যে সিরমদের সমর্থকেরা এই বক্তব্যের বিরোধিতা শুরু করেন:

বিশ্বাস করতে পারছি না, মানুষ মারভি সিরমদ বনাম হাফিজ হামিদুল্লার লড়াইয়ে নিপীড়িতকেই দোষ দিচ্ছে। অথচ ফুটেজে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সে বিষয়টিতে উস্কানি দেয়নি। অসুস্থ!

সুতরাং, বোঝাতে চাচ্ছেন যে মারভি সিরমদকে অমানবিক এবং ইসলামিক-বিধি বর্হিভূত ভাবে হাফিজ হামিদুল্লাহ লাঞ্ছিত করতে পারেন?

@মারভিসিরমদ আপনি সমানতালে তাঁকে জবাব দিয়ে এখন কেনো নিষ্পাপ সাজছেন? নারী-পুরুষ কি সমান নয়??

তিনি আক্রমণকারী, আমি নই। তিনিই আমাকে ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি দেন, আমি দিইনি। তিনিই সে যিনি আমাকে ঘুষি মারার চেষ্টা করছেন, আমি চেষ্টা করিনি।

সিনেটর শেরি রেহমান ঘটনাটির নিন্দা এবং সিনেটর হামিদুল্লাহ'র বিচারের জনদাবির প্রতি নিজের সমর্থন জ্ঞাপন করেন:

হ্যাঁ @মারভিসিরমদ ইতোমধ্যে আমি বিষয়টি সিনেটের সভাপতিকে জানিয়েছি। কোনো সিনেটরকেই পার পেতে দেওয়া হবে না।

প্রখ্যাত নারীঅধিকার কর্মী গুলালি ইসমাইল দাবি করেছেন সিরমদকে হুমকি দেবার জন্য সিনেটর হামিদুল্লার ফৌজদারি আইনে সাজা হওয়া উচিত। একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি সিনেটরের আচরণ সম্পর্কে নিজের ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেন:

মোল্লা হাফিজ হামিদুল্লাহ তাঁর বক্তব্যে শুধু “অবমাননাকর যৌনাবেদনপূর্ণ”, শব্দই প্রয়োগ করেননি, তিনি মারভি ও তাঁর মাকে ধর্ষণের হুমকিও দিয়েছেন। তাঁর পুরো বক্তব্যে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন যে, তিনি একজন পুরুষ এবং তাঁর সাথে একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সমর্থন রয়েছে। তাই সে নারীকে প্রহার এবং ধর্ষণ করতে পারে। তাঁকে শুধু গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ করলে হবে না, সারা জীবনের জন্য জেলে পাঠাতে হবে। কারণ সকল নারীর জন্য হুমকি স্বরূপ ।

এই পোস্টের পূর্ববর্তী সংস্করণে সিনেটর হামিদুল্লাকে ভুলক্রমে হামদানি উল্লেখ করা হয়েছিল। ভুল সংশোধন করে পোস্টটি হালনাগাদ করা হয়েছে।
এই জবাবটি দিতে চাই না

আলোচনা শুরু করুন -> Anonymous

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .