বহু শতক ধরে শ্রীলংকার সুনাম রয়েছে জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা হিসেবে, এবং পর্যটকদের বৈদেশিক মুদ্রা স্থানীয় ব্যবসার উন্নয়নে এবং দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে। তবে দেশটির পর্যটন খাতকে বেশ ক্ষতিগ্রস্থ ও স্থবির করেছে ২৫ বছর ধরে চলা শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধ, যা ২০০৯ সালে শেষ হয়েছে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে দেশটির পর্যটন খাতে দারুন উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে। ইতিমধ্যে এ শিল্পে বেশ কয়েকটি বড় বড় উন্নয়নের কাজও শুরু হয়েছে। শ্রীলংকা সরকার প্রায় ৪০০০ একরের একটি পর্যটন উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করেছে কালপিতিয়া নামক স্থানে। রাজধানী কলম্বোর ১৭৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এ স্থানটি অসাধারণ সৌন্দর্যের জন্য সর্বজনবিদিত।
গ্রাউন্ডভিউজ ব্লগে রাইসা বিক্রমাতুঙ্গে সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে একটি লেখায় উল্লেখ করেন যে চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে আগস্ট পর্যন্ত শ্রীলংকায় লক্ষাধিক পর্যটক এসেছেন। এটাই একমাত্র খাত যা হাজারও লোককে চাকুরি দিতে পারছে সেটা সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে।
এই খাত প্রচুর চাকুরীর সৃষ্টি করলেও দেখা যাচ্ছে যে স্থানীয় অনেকেই পর্যটন খাতে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না। বিক্রমাতুঙ্গে স্থানীয় কিছু মানুষকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছেন যে তাদের নতুন এইসব পর্যটন স্থাপনা গুলোতে কাজ করার অনুমতি দেয়া হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ব্যক্তিগত ভাবে কেউ তাদের নিজের সেবা বা পণ্য সরাসরি পর্যটকদের কাছে বিক্রি করতে পারে না। এর মধ্যে আছে নৌকা ভ্রমণ এবং আতিথেয়তা সংক্রান্ত বেশ কিছু সেবা। কারণ, সামরিক বাহিনী বা বাণিজ্যিক সংস্থা কর্তৃক নতুন প্রতিষ্ঠিত অনেক হোটেল বা রিসোর্টের এধরনের নিজস্ব নানা সুবিধা রয়েছে পর্যটকদের জন্যে যাতে স্থানীয়দের কাজ করার সুযোগ নেই।
শ্রীলংকার সেনাবাহিনী অন্যদিকে পর্যটন ব্যবসায় ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। পর্যটকদের সুবিধা দিতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একাধিক হোটেল এবং রিসোর্ট, অসংখ্য রেস্টুরেন্টস এবং ক্যাফেসহ নানা ধরনের পর্যকদের সেবা তৈরি করা হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।
গ্লোবাল রিস্ক ইনসাইটসের সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য অনুযায়ী, জোর করে নিয়োগ করা সেনা সদস্যদের বিভিন্ন রিসোর্ট এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে কাজে লাগিয়ে নূন্যতম মজুরি দেয়া হচ্ছে। আর এ ধরনের রিসোর্ট এবং বিনোদন কেন্দ্রের বেশির ভাগের মালিকই সেনাবাহিনী। সোসাইটি ফর থ্রেটেন্ড পিপলসের প্রকাশিত “রৌদ্রালোক মাখা স্বর্গে কালো মেঘের আনাগোনা,” শীর্ষক এক রিপোর্ট অনুযায়ী সেনাবাহিনী পর্যটন খাতে সৈনিকদের এরূপ স্বল্প বেতনে কাজ করিয়ে ব্যবসায়িক সুবিধা নিচ্ছে যার জন্যে এ খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছে না।
শ্রীলংকায় প্রতিটি পর্যটক যে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করেন তার অনেকাংশ যায় সেনাবাহিনীকে পালতে-পুষতে। গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে বিশাল সেনাবাহিনীর তেমন কোন কাজ নেই। কিন্তু, সেনাসংখ্যা না কমিয়ে প্রায় দুই লাখ সেনাকে উত্তরের তামিল অধ্যুষিত এলাকায় নিয়োগ রাখা আছে। হিসেব করলে দেখা যায় যে সে এলাকায় রয়েছে প্রতি দশজন সাধারণ মানুষের জন্য একজন সৈনিক, যা অনেক বাহুল্য।
পর্যটন খাতের দ্রুত উন্নয়ন আরো বেশ কিছু সমস্যার জন্ম দিয়েছে। সেনাবাহিনী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন পর্যটন উন্নয়নের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশির ভাগই স্থানীয় মানুষরা বাসস্থান বা তাদের জীবিকা হারাচ্ছে বা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে স্থানীয়দের নিজেদের ঐহিত্যবাহী জমি হারাচ্ছে; তাদের প্রতিদিনকার জীবন যাপন, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানা বাধা তৈরি হচ্ছে। এ সমস্যায় বেশি পড়ছেন কুচ্চাভেলি, পাসিকুধ, কালপিতিয়া, জাফনা এবং পানামা এলাকার সাধারণ মানুষজন।
গ্রাউন্ডভিউজে ইয়েভস ভোয়ি স্থানীয় মানুষদের এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরেছেন, যেমন:
কুচ্চাভেলি শ্রীলংকার উত্তর-পূর্ব এলাকার একটি গ্রাম যেখানে মাছ ধরাই স্থানীয়দের প্রধান কাজ। এখানকার বেশির ভাগ মানুষই মৎস এবং কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত। গৃহযুদ্ধের সময় থেকে কুচ্চাভেলির বেশির ভাগ জমিই অধিগ্রহণ করে নেয় শ্রীলংকার নৌবাহিনী। সাধারণ মানুষদের নিজেদের জমি, ঘর, ফার্ম, মাছ চাষের এলাকা এখনো গ্রামটিতে রয়েছে তবে যুদ্ধ শেষ হলেও শ্রীলংকা নৌবাহিনী গ্রামের দখল ছেড়ে যায়নি – ফলে তারা সেগুলো ব্যবহার করতে পারছে না।
পাসিকুধ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের পেশাই মাছ ধরা। কয়েক দশকের বেশি সময় ধরেই তারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। সামরিক বাহিনী কর্তৃক সমুদ্র সৈকত লাগোয়া বিভিন্ন হোটেল তৈরির পর গ্রামবাসীদের গ্রামের এক কোনে ছোট একটি এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয় বসবাসের জন্য। সেখান থেকেও তাদের বিতাড়িত করার প্রক্রিয়া চলছে। তারা এখন তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রেই বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে আছে।
গ্রাউন্ডভিউজ ব্লগে রুকি ফার্নান্দা এবং হারম্যান কুমারলিখেছেন:
যুদ্ধ আক্রান্ত স্থানীয় মানুষদের পর্যটন খাতে চাকুরী দেয়া হলে তারা তাদের দুর্দশা থেকে ঘুরে দাড়াতে পারে। পর্যটনকে যদি শান্তি, তামিল-সিনহালা বিরোধ মিটমাট, এবং উন্নয়নের একটি চাবিকাঠি করতে হয় তাহলে স্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনা করাটা জরুরি। যে কোন নতুন উদ্যোগের ক্ষেত্রে তাদের কষ্ট ও দুর্দশা এবং আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় রাখতে হবে এবং সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামগ্রিক উন্নয়নকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে।
এবং পর্যটন ক্ষেত্রে উন্নয়ন যেন স্থানীয় অর্থনীতি, সংস্কৃতি নষ্ট করে না হয় বরং স্থানীয় মানুষদের এ ধরনের ঐহিত্যবাহী জীবনযাপনকে তুলে ধরে এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয়দের অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে বাদ দেয়া বা একঘরে করা যাবে না। [..]
সরকার এবং সেনাবাহিনী পর্যটন খাতের উন্নয়নকে রাজনৈতিক এজেন্ডা কিংবা প্রচারণা হিসেবে দেখলে হবে না। এক্ষেত্রে পর্যটন খাতের উন্নয়নের সময় স্থানীয় মানুষদের শোক প্রকাশ এবং সাধারণ জীবন যাপনের বিষয়গুলো তুলে ধরার গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই বরং করা উচিত সরকারের এবং যারা এ ধরনের কাজের উন্নয়নে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তাদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিৎ।