- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

ইরানের শিশুশোষণ নিয়ে ক্ষোভ নেই কেন?

বিষয়বস্তু: মধ্যপ্রাচ্য ও উ. আ., ইরান, প্রতিবাদ, মানবাধিকার, যুবা, শরণার্থী, শ্রম
Unidentified child workers in Iran. Photo courtesy of International Campaign for Human Rights in Iran

ইরানের অজ্ঞাত শিশু শ্রমিকেরা। ছবি হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর ইরান এর সৌজন্যে: Photo courtesy of International Campaign for Human Rights in Iran

সারা পৃথিবী জুড়ে বিরাজমান একটি ভয়াবহ সমস্যা হলো শিশুশ্রম এবং শোষণ। শিশুপাচার ও শোষণ মূলত সরকারি অবহেলাজনিত কারণে তৈরী হওয়া ঝুঁকি, যা প্রযোজ্য বিশেষত সেসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য, যেসব সমাজে স্বচ্ছতা এবং সামাজিক সমর্থনজনিত অভাব প্রকট।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং বাইরের বিশ্বের চোখে অননুসন্ধিত রয়ে গেলেও এই শিশু শোষণের হার ইরানে ক্রমেই আশংকাজনক ভাবে বাড়ছে।

শিশুশোষণের সাম্প্রতিক এই উর্ধ্বগামীতার পেছনে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং উদ্বাস্তু সংকট, একই সঙ্গে সু-শাসনজনিত সরকারী ব্যাপক ব্যর্থতার মিলিত প্রভাব। একেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর সংযোগপথে ইরানের ভৌগলিক অবস্থান, সেইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাব; সবকিছু মিলিয়ে ইস্যুটি মোড় নিয়েছে চরম অরাজকতার দিকে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের তালিকায় ‘মানব পাচারের জন্য টায়ার তিন’ [1]দেশগুলোর একটি হিসেবে ইরানের অন্তর্ভুক্তি অনেকদিনের। এমনকি ইরানী শাসকগোষ্ঠীর একাংশ নিজেরাই মানব পাচার [1]ও শিশুশোষণে লিপ্ত।

দুর্ভাগ্যবশত, শিশুশ্রম ইরানে নূতন কিছু নয়। একাধিক শিশুবিশিষ্ট নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো ঐতিহ্যগতভাবেই সন্তানসন্ততিদের শ্রম ও আয়ের উৎস ভাবতে অভ্যস্ত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্বেচ্ছায় পাঠানো হয় ধনী ইরানিদের বাড়িতে, দাস হিসেবে।

নিজস্ব সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সীমানা ছাপিয়ে সমস্যাটি এখন পৌঁছেছে শোষণ এবং অবহেলার চরম প্রান্তে। ২০১২ সালে শিশু অধিকার রক্ষা সমিতির প্রধান আলী আকবর ইসমাইলপুর [2], আমস্টারডাম ভিত্তিক ফার্সি ভাষাভিত্তিক রেডিও জামানেহকে বলেন:

আমাদের হাতে আছে শুধুমাত্র পথশিশু সংক্রান্ত পরিসংখ্যানগত তথ্য, কারণ সেসব সহজলভ্য। কিন্তু এটি তো সম্পূর্ণ চিত্র নয়।

নিয়মানুগভাবে শিশুশ্রম আইন কার্যকরের ক্ষেত্রে শ্রম মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কথা  উল্লেখ করে ইসমাইলপুর জানান, “এমনকি নামমাত্র নিরাপত্তাহীন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কিছু কিছু সময়ে শিশুরা টানা ১২ থেকে ১৬ ঘন্টাও কাজ করছে।”

ইরানের আইন অনুযায়ী ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও আইনী বেড়াজালের ফাঁকফোঁকর গলিয়ে শোষণ চলছেই। গার্হস্থ্যকাজে সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করছে ১৫ বছরের কম বয়সী অনেক শিশুই। আনুষ্ঠানিক কর্মীর তকমা না পেলেও ঠিকই তাদের হতে হচ্ছে নানা ধরনের অত্যাচার এবং দূর্ব্যবহারের স্বীকার। সুশীল সমাজের এক প্রতিনিধি সংগঠন [3] সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানায়, ২০১১ সালের জাতীয় আদমশুমারি অনুযায়ী ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৬৮,৫৫৮জন এবং ১৫-১৮ বছর বয়সী শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ছিলো ৬৯৬,৭০০জন।

শিশুশ্রমিকদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিয়ে থাকে এমন এক এনজিওর প্রধান আকবার ইয়াজদি ইরান থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ফিনান্সিয়াল ট্রিবিউনকে বলেন [4]:

এটি এমনই এক সমস্যা যেটা সরকার শুধু উপেক্ষা নয়, স্রেফ অস্বীকার করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো শিশুশ্রম ইরানের অন্যতম প্রধান জাতীয় সমস্যা, যা দ্রুততম মনোযোগ এবং প্রতিকারের দাবি করে।

‘আমার প্রতিটি সকাল শুরু হয় কান্নাভেজা হয়ে’

বিষয়টি এখন শুধুমাত্র আর শিশুশ্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইরানের রাস্তায় আনুমানিক ২০০,০০০ পথশিশুর [5] বসবাস। ধারণা করা হয় [6], এদের অর্ধেকই আফগানী। এসব শিশুদের মধ্যে অনেকেই এসেছে আফগানিস্তান বা ইরাক থেকে পালিয়ে, শরণার্থী হিসেবে, দুঃসহ সব পরিস্থিতি পাড়ি দিয়ে। এসব উদ্বাস্তু শিশুদের সামাজিক ভূমিকা বিশেষত খুবই নাজুক।

স্থানীয় সাংবাদিক ও নাগরিককর্মীদের সমর্থনকারী স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ওয়্যার অ্যান্ড পিস রিপোর্টিং ইনস্টিটিউট ২০১১র মার্চে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জানায় [7]– নিরাপত্তা বাহিনী আফগান শিশুদের তুলে নিয়ে আফগানিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। এমনো অনেক বহিষ্কৃত শিশু আছে যাদের জন্মই ইরানে। অচেনা অজানা আফগানিস্তানের পথে তাদের এভাবে পাঠানো হচ্ছে পিতামাতার অজ্ঞাতসারেই।

ইরানে থাকা পরিবারকে কিছু না জানিয়েই ১২ বছর বয়সী শরণার্থী আবদুল মজিদকে একা ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয় আফগানিস্তানে । হেরাত প্রদেশের এক আনসার শরণার্থী ক্যাম্পে সাক্ষাৎকারের সময় মজিদ জানায় [7] পুলিশের দৈহিক অত্যাচারের কথা।

তারা জানতে চেয়েছে আমি কোন সন্ত্রাসী দলের সাথে জড়িত কিনা। শপথ করে বললাম, আমি কখনোই এরকম কোন নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত ছিলাম না। আট দিন আটকে রাখার পর অবশেষে তারা আমাকে ছেড়ে দেয় এবং আফগানিস্তানে ফেরত পাঠায়।

আইনি পরামর্শ থেকে বঞ্চিত করে, অবৈধ অধিবাসী হিসেবে জোরপূর্বক দেশে ফেরত পাঠানো শত শত আফগান বংশোদ্ভুত শরণার্থীদের মধ্যে আব্দুল মজিদের ঘটনাটি শুধু একটি উদাহরণমাত্র। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীও এরকম বহিষ্কার বৈধ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই শিশু শরণার্থীদের নিরাপত্তা হেফাজতের নামে শারিরীক নির্যাতন করা হয়, দেশে ফেরত পাঠানোর আগের সময়টুকুতে রাখা হয় অনাহারে। অস্ফুট কান্নার ফাঁকে মজিদ জানায় –

রোজ রাতে স্বপ্নে দেখি  বাবা-মা ও ভাই-বোনরা আমাকে খুঁজছে। আমার প্রতিটা সকাল শুরু হয় ভেজা চোখে।

ইরানের বিস্মৃত শিশুরা

পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে মানব পাচারের জন্য মূল একটি কেন্দ্রপথ হলো ইরান। জাতিসংঘের মতে, ইরানের আইন অনুযায়ী মাদক পাচারের চেয়েও কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে দক্ষিণী মাদক চোরাচালান পথের অপরাধীদের কাছে অতি আকর্ষণীয় বিকল্প ব্যবসা হয়ে উঠেছে মানবপাচার। (জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ, ইরান রিপোর্টের চতুর্থ পাতা [8] দেখুন)

জনশ্রুতি আছে, নারী পাচার অবৈধ হলেও ইরানী প্রবিধানুযায়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাচারকৃত নারীকেই ব্যভিচারের অভিযোগে [9] শাস্তি পেতে হয়। এমনকি ভুক্তভোগী নারীদের করতে হয় হাজতবাস।

শিশু অধিকার রক্ষাজনিত আন্তর্জাতিক নিয়ম এবং আইনের বিপরীতমুখী ইরানের সরকারী নীতিমালাসমূহ দেশের অভ্যন্তরে নিয়মবহিভূত মানব পাচার প্রতিরোধকে জটিলতর করে তুলছে। মানবপাচার নীতি লঙ্ঘন ও দমনে শাসনব্যবস্থায় [10] কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও সেগুলোর নীতিগত ব্যবহার বিপরীতমুখী [11]

শরণার্থী ও অভিভাবকহীন শিশুদের স্বার্থরক্ষায় প্রণীত শিশু অধিকার কনভেনশনের সদস্য [12] হলেও ইরানের নিজস্ব আইন কনভেনশনের নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাছাড়াও ইরান এখনো আন্তর্জাতিক মানব পাচার প্রতিরোধে সাক্ষরিত গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ইউএন ট্রাফিকিং প্রোটোকল ২০০০ [13] এর সদস্য নয়।

গণতান্ত্রিক নিয়ম ও সামাজিক স্বচ্ছতার অভাবে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করা দেশীয় এবং  আর্ন্তজাতিক কর্মীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইরানের  সাংবাদিক ও শিশু অধিকারকর্মীদের মধ্যে যাঁরা সরাসরি বিরুদ্ধ প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শুধু অসহযোগিতাই পাননি, পেয়েছেন  হুমকি, [14] মুখোমুখি হতে হয়েছে গ্রেফতারের [15]

বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মনোযোগ যখন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে, ইরানের শিশুরা তখনো রয়ে যাচ্ছে চোখের আড়ালেই, উপেক্ষিত হয়ে।

এই বিষয়ের ওপর ফার্সি ভাষায় লেখা প্রতিবেদনগুলো পড়তে চাইলে দেখুন [16] এখানে।