- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

জাপানের মুসলমান বিরোধী প্রতিবন্ধকতা গুজব উন্মোচন

বিষয়বস্তু: পূর্ব এশিয়া, জাপান, ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজম, ধর্ম, নাগরিক মাধ্যম, সরকার
Mosque in Kobe, Kansai, Japan. Photo by Flickr user Aidan Wakely-Mulroney. CC BY-NC-ND 2.0 [1]

জাপানের কোবের মসজিদ, ছবি ফ্লিকার ব্যব্যহার কারী আইদান ওয়াকেইলি- মুলরোনেই। সিসি বাই-এনসি-এনডি।

গত নভেম্বরে প্যারিসে হামলার পর জাপানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরোপিত বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার একটি তালিকা বহুল প্রচারিত হয়। এতে আরও প্ররোচনা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের চলমান প্রচারণা, যে প্রচারণায় প্রার্থীরা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ক্রমাগত ইসলাম ভীতি এবং বর্ণবাদ ব্যবহার করছে।

বিগত কয়েক সপ্তাহে ইংরেজ ভাষার সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়া ছবি অনুসারে জাপান মুসলমানদের প্রবেশে কঠোর নীতি অবলম্বন করছে:

জাপানের প্রায় ১২ কোটি ৭০ লক্ষ নাগরিকের মধ্যে মাত্র ১০,০০০ মুসলমানের বাস, যারা মোট জন সংখ্যার মাত্র এক শতাংশের শতভাগের চেয়েও কম। এর একটি কারণ ইসলাম প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা কিন্তু সম্ভবত মুসলমান অভিবাসনের উপর নিষেধাজ্ঞা এর আসল কারণ।

কি সমস্যা? এই তালিকায় প্রতিটি চিহ্নিত/ বুলেট পয়েন্ট মিথ্যা

muslims in japan

স্টিভ রেইচার্ট-এর নিজস্ব ফেসবুক পাতা পোস্ট করা, রেইচার্ট জাতিয় বন্দুক সংস্থায় সভায় যোগ দেওয়ার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে।

এমনকি তাই, অবাস্তব বলে এমন ব্লগ যেমন ইনফো ওয়ারস [2] এবং দি কনজারভেটিভ ট্রিবিউন [3] উপরের বুলেট চিহ্নিত তালিকাটিকে বাস্তবতা বলে জানিয়েছেন।

এভাবেই ভাইরাল মিমটি ইন্টারনেটে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে যে বিষ্যটি কি সত্য নাকি সত্য নয়।

স্বাধীন সংবাদ সংস্থা এস এন এ জাপান উল্লেখ করেছে যে রাজনৈতিক কিংবা আদর্শগত ভাবে জাপানে কোন সহিংসতা নেই এবং জাপান হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র [4] যে দেশটি এক অরাজনৈতিক ব্যক্তি কর্তৃক সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকার হয়েছে। ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অম সিনরিকিও সারিন গ্যাস নামক “গণ বিধ্বংসী অস্ত্রের” ব্যবহার করে হামলা করেছিল।

গুজব উদঘাটন করা সাইট স্নোপস ঘোষণা প্রদান করেছে যে “জাপান ইসলামকে দূরে রেখে দিয়েছে” নামক মিমটি ভূয়া [5]। এদিকে তথ্য যাচাই করা সাইট পলিটি ফ্যাক্ট প্রতিটি পয়েন্ট ধরে একে উন্মোচন করেছে জাপানের বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করে যারা ব্যাখ্যা করছে যে এখানে উল্লেখ করা কোনটা সত্য নয় [6]

জনপ্রিয় জাপানি ভ্লগার কানাডাজিনি৩ (ওরফে মিরা) জাপানের ইসলাম বিরোধী গুজবের বিষয়টিকে উদ্দীপনার সাথে খণ্ডন করেন [7], যা ইতোমধ্যে ৬৫,০০০ বার পাঠ করা হয়।

এই মিমে অনেক ভুল তথ্য থাকা সত্ত্বেও ইসলামের প্রতি আসলে জাপানের সহনশীল মনোভাবের কারণ এখানে খুব অল্প সংখ্যক মুসলিম বাস করে।

কানাডাজিনির ভিডিওতে [8] যে সকল মন্তব্য রেখে যাওয়া হয় সেগুলোতে পরিষ্কার যে সেগুলো ঠিক জাপানী মনে হয় না এমন সব ধরনের সংস্কৃতির বিপক্ষে।

যেমন এর এক উদাহরণ হচ্ছে ইউটিউবে মন্তব্যকারী শি টাকার মন্তব্য [9]:

どこの国でもそうだと思うけど、帰化したいなら、その国の文化やルールに従い、自分勝手な行動を止め、秩序を乱さなければ誰だって歓迎されるでしょ。 ただ、自分勝手に、あれもくれこれもくれという移民に対しては、すごく嫌いになる。 日本は外国人の知らないようなマナーが多いからね。日本人でも分からないことだらけなんだ。来るなら、それを学んでから来てほしいね。

[যদি কোন এক বিদেশী নাগরিক কোন দেশে বাস করতে চায়], তাদের অবশ্যই সেই দেশের নিয়মনীতি এবং প্রথা মেনে চলা উচিত এবং অন্যদের মাঝে নিজেদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বন্ধ করা উচিৎ। জাপান যে কাউকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত যদি তারা এখানে আসে এবং বিদ্যমান ব্যবস্থাকে আহত না করে। আমরা জাপানিরা সত্যি এই বিষয়টিকে ঘৃণা করি যদি বিদেশীরা কেউ এখানে আসে এবং তাদের জন্য আলাদা বিশেষ ছাড় দেওয়ার জন্য আবদার করে। জাপানি নাগরিকদের নিজস্ব অনেক প্রথা রয়েছে যা বাকী বিশ্বের অনেক নাগরিক জানে না। জাপান বিভিন্ন রকমের প্রথায় পরিপূর্ণ যা অন্য অনেক দেশের জন্য একেবারে অচেনা। যদি আপনি এদেশে আসেন, তাহলে এখানে আসার আগে এদেশ অথবা আমাদের বিশেষ প্রথা সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে এদেশে আসবেন।

এদিকে ইসলামের সাথে জাপানের যোগাযোগের ইতিহাস এখন থেকে ১৫০ বছরের পুরোনো যা জাপানের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার সময়ে ইতি ঘটে। আজ জাপানে প্রায় ১০০,০০০ জন নাগরিক বাস করেন [10], যাদের মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এদের ১০ শতাংশ মাত্র জাপানের নাগরিক। অবশিষ্টরা অভিবাসী কিংবা দীর্ঘ সময় ধরে জাপানে বাস করা বিদেশী নাগরিক যারা ছাত্র কিংবা, প্রশীক্ষনার্থী অথবা বিদেশী কর্মী হিসেবে তুরস্ক, ইরান, নাইজেরিয়া কিংবা মালয়েশিয়া থেকে এসেছে।

একদিকে যখন অনেক মুসলমান টোকিওতে বসতি স্থাপন করেছে অন্যেরা জাপানের ইয়োকাহামা, নাগায়ো এবং কোবের [11] মত আন্তর্জাতিক নগরে বসতি স্থাপন করেছে, যেখানে বেশ কিছু মসজিদ রয়েছে যেখানে প্রাণোচ্ছল মুসলমান সম্প্রদায় নামাজ পড়ে থাকে।

অন্তত কিছু সময়ের জন্য, মুসলমানদের প্রতি জাপানের কর্মকর্তাদের মনোভাব দেশটির নাম পরিচয় গোপন রেখে ইন্টারনেট মন্তব্য করা ব্যক্তির সাথে সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য রয়েছে ।

এর এক উদাহরণ হচ্ছে ২০০৮ সালে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইংরেজি ভাষা বিভাগ থেকে ছাড়া একটি প্রবন্ধ [12] যা এর ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হয়। সেখানে জাপানের প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী এবং মধ্য প্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কাতাকারু মোতোকোর [13] একটি প্রবন্ধ ছিল যাতে জাপানে বাস করা মুসলমান এবং ইসলামের প্রতি সাধারণত সহনশীল স্বর গ্রহণ করা হয়েছে। :

এটা হচ্ছে পশ্চিমের বৈপরীত্য যেখানে ইসলামের হেজাব এক রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেক গবেষক এই বিষয়ে লিখেছে যে যদিও ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার শিকারের তালিকায় বেশ কিছু জাপানি নাগরিক ছিলেন, তারপরেও এখানে ইসলাম বিরোধী কোন আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েনি। জাপানে ইসলামকে হেয় করে কোন বিদ্রূপাত্মক কার্টুন প্রকাশ করা হয়নি।

যদিও জাপানে মুসলমানদের সংখ্যা নাটকীয় ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে মসজিদ নির্মাণ নিয়ে আশেপাশের বাসিন্দাদের কোন অভিযোগ নেই। কেবল কৌতূহল দেখা যাচ্ছে । স্থানীয় বাসিন্দারা দেখছে যে কিছু একটা নির্মাণ হচ্ছে এবং তাদের শুধু কৌতূহল হচ্ছে যে এরা আসলে কোন ধরনের লোক। কিন্তু এই সমস্ত এলাকার মুসলমানের তাদের প্রতিবেশীদের সোবা নুডুলস প্রদান করছে যা গৃহ অপ্রবেশের সময় জাপানের এক ঐতিহ্য, যা প্রতিবেশীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব নিশ্চিত করে।

এখানে উল্লেখনীয় যে, এই প্রবন্ধে কাতাকুরা বলছে, [জাপানে আমরা], এই সমস্ত গতানুগতিক বিষয়ে আমাদের মতামত প্রচারণা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে, তার বদলে ভদ্র আচরণ এবং সহনশীলতা প্রদর্শন করব।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে নিজেও ইসলামের প্রতি কাতাকুরার ২০০৮ সালে প্রবন্ধে যে মনোভাব উঠে এসেছে তার পুনরাবৃত্তি করেছেন। আবে ২০১৪ সালে আরবের উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর এক প্রতিনিধি দলকে আতিথ্য দিতে গিয়ে বলেন [14]:

আমি আবিস্কার করেছি যে ইসলামের মূল চেতনার ভিত্তি হচ্ছে ঐক্যতান এবং একে অন্যের প্রতি ভালবাসা। আমি বিশ্বাস করি যে এটি জাপানের যে চেতনার এক সাথে মিলে থাকার যে চেতনা তার মানে নিহিত, যা মিলে মিশে থাকার মাঝে পাওয়া যায়।

কাজেই, এখানে এই বিষয়ে যুক্তি প্রদান করা খুব কঠিন যে জাপান হয়ত এক বহুমাত্রিক, বহু সংস্কৃতিক রাষ্ট্র। একই সাথে জাপান দেশটির প্রতিদিনের জীবনে মুসলমানদের কর্মকাণ্ডের সীমাবদ্ধতা আরোপের চিন্তা করছে না, এবং দেশটি মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা গণতন্ত্রের চেয়ে মুসলমান উপ সংস্কৃতিকে তাদের গৃহের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করছে।