- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

রাজ্য সরকারের সমালোচনাকারী গানের জন্য দক্ষিণ ভারতের গায়কের বিচার করা হয়েছে

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, ভারত, নাগরিক মাধ্যম, মানবাধিকার, লিঙ্গ ও নারী, শিল্প ও সংস্কৃতি, সেন্সরশিপ
Screenshot of Kovan Singing. Click image for the video. [1]

কোভানের গান গাওয়ার স্ক্রীনশট। ভিডিওর জন্য ছবির মধ্যে ক্লিক করুন।

দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্র তামিলনাড়ুতে সরকারের সমালোচনাকারী গান গাওয়ার জন্য গ্রেফতার হওয়া লোকগীতি শিল্পী এবং মানবাধিকার কর্মী কোভান [2]কে বর্তমানে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তার গ্রেফতার মানবাধিকার ও বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি বড় ধরপাকড়ের অংশ।

২০১৫-এর অক্টোবরের শেষে ৫২ বছর বয়েসী কণ্ঠ শিল্পী এস কোভানকে তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লি জেলায় তার বাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় দুই সপ্তাহের কারাভোগের পর তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়।

কোভান গ্রেফতার হয় তার সঙ্গীত ভিডিও [1]টি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর। নীচে ইংরেজী শিরোনামসহ ‘তাসমাক বন্ধ কর’ দেখুন:

তাসমাক বন্ধ কর [3]‘ গানটি রাজ্য-সরকার পরিচালিত মদের দোকানগুলো থেকে দরিদ্রদের টাকায় মুনাফা করার জন্য রাজ্য-সরকারের সমালোচনা করেছে। ভিডিওটিতে একটি পথ নাটক দেখানো হয় যেখানে মূখ্য মন্ত্রী জয়ললিতার মতো করে পোষাক পরিহিত একজন নারী একটি গ্লাসে মদ ঢালছে। ভারতের জাতিয় সংবাদপত্র হিন্দুর বরাত দিয়ে অজ্ঞাত পুলিশের সূত্র দাবী করেছে যে ‘যে কারও পান করার বিষয়ে সমালোচনা করার অধিকার আছে, তবে যারা তা করবে তাদের সীমা অতিক্রম করা উচিৎ নয়'। সীমাগুলো পরিষ্কার নয়।

কোভানকে ধারা ১২৪এ রাষ্ট্রদ্রোহ এবং “দাঙ্গা সৃষ্টি করার অভিপ্রায় নিয়ে খেয়ালীভাবে প্ররোচনা দেয়া’ এবং ৫০৫ অংশ ১, খ এবং গ ধারায় ‘জনগণের মধ্যে ভীতি বা শঙ্কা সৃষ্টি করার অভিপ্রায় নিয়ে গুজব প্রকাশ বা বিলি করা এবং তাদেরকে রাজ্য বা একটি শ্রেণী বা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করায় প্ররোচিত করাসহ বিভিন্ন ধারায় [4] গ্রেফতার করা হয়’, চেন্নাই কেন্দ্রীয় অপরাধ শাখা সূত্র [5] অনুযায়ী বলা হয়।

তার গ্রেফতারের পরপরই মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ-এর দক্ষিণ এশিয়া পরিচালিকা মীনাক্ষি গাঙ্গুলী বলেন যে গ্রেফতারটি তামিলনাড়ুর মূখ্য মন্ত্রী জয়ললিতা জয়রামকে সমালোচনা থেকে আড়াল করার একটি ‘একটি বিপথগামী প্রয়াসমাত্র’ এবং তার ততক্ষণাৎ মুক্তি দাবী করেন। ‘সঙ্গীত শিল্পী, কার্টুন শিল্পী এবং লেখকদেরকে অনবরত গ্রেফতার করার জন্য একটি আইন যার গণতন্ত্রে কোন স্থান নেই–এবং অবশ্যই বাতিল করতে হবে’, গাঙ্গুলী বলেন [6]

মানবাধিকার কর্মকাণ্ডের সংযোগ

কোন সাধারণ লোকসঙ্গীতকার নয়, কোভান গণ শিল্প ও সাহিত্য সমিতির (পিএএলএ) একজন নেতা যেটি একটি সাম্রাজ্যবাদী-বিরোধী প্রতিবাদ সংস্থা যারা সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো তুলে ধরতে শিল্প ও সাংস্কৃতি ব্যবহার করে থাকে। তাদের ফেসবুকের পাতা অনুযায়ী [7] পিএএলএ ব্রাহ্মণ্য সন্ত্রাস ও পুনউপনিবেশীকরণের মতো বিষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বিপ্লবী রাজনৈতিক গানের ১১টি গানের ক্যাসেটসহ সঙ্গীত প্রকাশ করে, ‘পুথিয়া কালাচরম’ (নতুন সংস্কৃতি) নামের মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে যা বর্তমানে ২০ বছরেরও বেশী সময় ধরে মুদ্রিত হচ্ছে, এবং নিউ ডেমোক্রেটিক লেবার ফ্রন্ট (এনডিএলএফ), পীজ্যন্ট লিবারেশন ফ্রন্ট (পিএলএফ), এবং রেভোলুশনারী স্টুডেন্টস ইয়ুথ ফ্রন্ট (আরএসওয়াইএফ) এর সাথে যুক্ত হয়ে বিশ্বায়ন, অনুভব বাগান [8], কোকাকোলা কারখানা, ছোটখাট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায় বন্ধ করা, এবং তামিল নাড়ুতে অন্যান্য সংগ্রামের বিরুদ্ধে ওকালতি করে।

‘আমরা কুদানকুলাম [9], অবৈধ বালু উত্তোলন এবং আরও বিভিন্ন সামাজিক মন্দতার বিষয়ে গান গেয়েছি’, দলটির একজন সদস্য ও বিগত ২৫ বছর ধরে কোভানের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী এম সাথীয়া বলেন। সংহতি [10]তে প্রকাশ করা একটি বার্তায় গণ শিল্প ও সংস্কৃতি সমিতি ‘এই বার্তা ও গানগুলোকে ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমে সকল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ফ্যাসিস্ট নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান করেছে'।

সংহতির বিবৃতিতে একজন পিএএলএ মূখপাত্র এ সারাভানান দাবী করেন যে তামিল নাড়ু রাজ্য বিপণন কর্পোরেশনের (তাসমাক) বিপণী বিতানগুলোর বিরুদ্ধে সংস্থাটির প্রচারণার কারণে রাজ্য সরকার এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাসমাক তামিল নাড়ু সরকারের [11] মালিকানাধিন একটি কোম্পানী যারা এ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ের একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। কোভান খ্যাদ্যের ঊর্ধ্বগামী মূল্য এবং কেরোসিন পাওয়ার অসুবিধা বনাম খুব সহজেই মদ ক্রয় করতে পারার বিষয়ে গান গেয়েছেন: ‘সে মাসে একবার কেরোসিনের যোগান দেয়, কিন্তু একটি দোকানের এই ভীতি প্রদর্শন মাত্র মধ্যরাতের পর বন্ধ হয়'।

সার্বিকভাবে এই গানটি মদের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করার একটি ব্যপক আন্দোলনের [12] অংশ। ১৯৩০ সাল থেকেই তামিলনাড়ুতে মদ বিতর্ক এবং নিষেধাজ্ঞার বিষয়টির একটি লম্বা ইতিহাস [13] রয়েছে। কন্যাকুমারীতে একটি তাসমাক দোকান বন্ধের দাবীতে ৫৯ বছর বয়সের গান্ধীয়া শশি পেরুমালের কথিত আত্মহত্যার [14] পর আগষ্ট ২০১৫ তে মদের দোকানগুলোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভগুলো, যার অনেকগুলোই শিক্ষার্থী [15] ও নারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, কোন কোন সময়ে তীব্র আকার ধারণ করে [16], পরিণতিতে সম্পত্তির ধ্বংস সাধনও হয়েছে।

মানহানি মামলা বৃদ্ধি

কোভানের ঘটনাটি প্রশাসনের কাছে ব্যতিক্রমী কোন বিষয় নয়। সর্ব ভারতীয় আন্না দ্রাবিড় উন্নয়ন সংগঠন [17] (এআইএডিএমকে)-এর বিগত চার বছরের শাসনামলেই শুধুমাত্র সরকার মানহানির ১১০টির অধিক মামলা [18] দায়ের করে। তার বিগত শাসনামলে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে জয়ললিতার নেতৃত্বাধীন সরকার প্রায় ১২০টি মানহানির মামলা দায়ের করে।

ইন্ডিয়া টুডে টিভির একজন সাংবাদিক শ্রীশা রেড্ডী টুইটারে কোভানের ছেলের একটি মন্তব্য প্রকাশ করেছেন:

লোক শিল্পী কোভানের ছেলে @ইন্ডিয়াটুডে [19]কে: সরকার যদি মনে করে যে এই গ্রেফতার আমাদেরকে থামিয়ে দেবে, তবে তা তাদের বোকামী। এটিকে আরও জনপ্রিয় করার জন্য আমরা তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।

বিরোধী দলের (ডিএমকে দল) একজন রাজনীতিবিদ ফেসবুক-এ একটি বিবৃতি [21] দিয়েছেন যা প্রায় ৩,০০০ জন পছন্দ করেছে এবং ৩০০ জন পুনরায় তা প্রকাশ করেছে:

Tamil Nadu is in a state of unannounced emergency. After arresting folk artist Kovan for criticizing the Jayalalithaa government, the atrocities continued at Egmore court yesterday. The police manhandled and assaulted media personnel when they attempted to cover the case. Tamil Nadu is seeing an unprecedented situation where human rights have become non-existent, there is no respect for law and order or the Constitution, and corruption has reached obscene levels. Neither Jayalalithaa nor Sasikala seem to be the least bit worried about the disproportionate assets case pending in the Supreme Court and are forcing businessmen to sell their assets to them. The recent Jazz Cinemas exposé by the media is one such instance that has come to light.

তামিলনাড়ু বর্তমানে অঘোষিত জরুরী অবস্থার মধ্যে আছে। জয়ললিতা সরকারের সমালোচনা করার জন্য লোক শিল্পী কোভানের গ্রেফতারের পর গতকাল এগমোর আদালতে নিষ্ঠুরতা অব্যহত থাকে। গণমাধ্যম কর্মীরা মামলাটি প্রচার করতে চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের সাথে রুক্ষ আচরণ করে ও তাদেরকে মারধর করে। তামিল নাড়ু নজিরবিহীন একটি অবস্থার সম্মুখিন হয়েছে যেখানে মানবাধিকার নিরস্তিত্ব হয়েছে, যেখানে আইন-শৃঙ্খলা বা সংবিধানের প্রতি কোন সম্মান নেই, এবং দুর্নীতি অশোভন মাত্রায় পৌঁছে গেছে। জয়ললিতা বা শশিকলার কাউকেই সর্বোচ্চ আদালতে ঝুলে থাকা অসমঞ্জস্য সম্পদের মামলাগুলো সম্পর্কে আদৌ চিন্তিত মনে হচ্ছে না এবং ব্যবসায়ীদেরকে তাদের সম্পদগুলো তারা তাদের কাছে বিক্রয় করতে বাধ্য করছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমগুলো দ্বারা জ্যাজ প্রেক্ষাগৃহের উৎঘাটিত বিষয়টি এধরনে একটি ঘটনা যা জনসমক্ষে আসে।

তামিল নাড়ুর ডিএমকে রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক দল বলে যে এটি অসহিষ্ণুতার একটি উদাহরণ এবং গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার একটি প্রয়াশ মাত্র। ‌‌‌‌'আমার পিতার গ্রেফতার তিনি যে সংস্থার হয়ে কাজ করতেন শুধু তার জন্য নয় বরং তামিল নাড়ুর জনগণের জন্য একটি হুমকিস্বরূপ‌‍’, কোভানের ছেলে চারুবহন বলেন [22]

কোভানের আইনজীবি জিম রাজ মিল্টন যুক্তি দিয়েছেন যে এই গানের মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কিছুই নেই। ‘কোভানের গানের মধ্যে ক্রোধ আছে, কিন্তু তার ক্রোধের পিছনে যুক্তিও আছে। এটি একটি শিল্পকর্ম। এটিকে শুধুমাত্র শিল্প হিসেবেই দেখা যেতে পারে। এমন কি মানহানি ধোপে টিকতে পারে না।’ তিনি বলেন।

কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ প্রায় ২৫জন লেখকের সাহিত্য পুরষ্কার ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্তের প্রাক্কালে কোভানের গ্রেফতারের ঘটনাটি ঘটলো। উদয় প্রকাশ নামের একজন হিন্দি লেখক কান্নাড়া সাহিত্য একাডেমী পুরষ্কারপ্রাপ্ত বাচনীক সাহিত্যের একজন প্রগতিশীল পণ্ডিত এম এম কালবুরগী হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ২০১৫ সালের ২৩শে নভেম্বর এই প্রথাটি চালু করেছেন। ২০১৫ নভেম্বরের ২৩ তারিখ পর্যন্ত অরুন্ধতী রায়সহ কমপক্ষে ৪২ জন লেখক, নিবন্ধকার এবং নাট্যকার তাদের পুরষ্কার ফেরত দিয়েছেন [23]

এই কাহিনীটি আর্টসফ্রিডম.অর্গ [24] এ প্রকাশের জন্য বিশ্বজুড়ে সঙ্গীতশিল্পীদের অধিকার রক্ষাকারী ফ্রিমিউজ [25], এবং গ্লোবাল ভয়েসেস লেখিকাকে তৈরী করতে অনুরোধ জানায়। এই নিবন্ধটি লেখিকা লক্ষ্মী সারাহ, ফ্রিমিউজ এবং গ্লোবাল ভয়েসেসকে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে এবং মূল লেখার সাথে সংযুক্ততা রেখে কোন অব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পুনপ্রকাশ করতে পারবে।