আফগানিস্তানের একটি ফ্যাশন শো বিতর্ক সৃষ্টির পাশাপাশি উন্মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আশাও জাগিয়ে তুলেছে

Photo by Ryasat Ali. Used with permission.

ছবি তুলেছেন রায়সাত আলী। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের মানুষজন সবসময় নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। নিরাপত্তা শঙ্কার একঘেয়ে জীবনে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটিয়েছে একদল তরুণ মডেল। ঘটনা গেল সপ্তাহের। এই তরুণ মডেলরা র্যাধম্পে হাঁটেন সেদিন। তাদের ক্যাটওয়ার্ক যেমন তীক্ত বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, তেমনি অনেকের কাছে সেটা প্রশংসাও কুড়িয়েছে।

লামন নামের একটি ফ্যাশন হাউজ এই শোর আয়োজন করে। এই শোতেই একদল তরুণী ঐতিহ্যবাহী আফগান পোশাক পরে র‍্যাম্পে হেঁটেছিলেন। ফ্যাশন হাউজটি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আফগানদের পাশাপাশি বিদেশিরাও এই ফ্যাশন শোতে উপস্থিত ছিলেন।

পশ্চিমের দেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন এমন তিন তরুণ এই ফ্যাশন হাউজটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এদের একজন আবার মেয়ে।

প্রথম শো-এর পর গত ১৩ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ফ্যাশন শো অনুষ্ঠিত হয়। হাফ বার্গ-ই হোনার নামের এই শোটিতে ঐতিহ্যবাহী হাজারাগী পোশাক পরে মডেলরা র‌্যাম্পে হাঁটেন। এদের কেউ-ই পেশাদার মডেল ছিলেন না। অ্যাম্বডারি করা পোশাকগুলো ছিল দেখতে সত্যিই অসাধারণ।

এই শোটির উদ্দেশ্য ছিল সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের কারুশিল্প তুলে ধরা। উল্লেখ্য, আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষ। তালেবান ও অন্যান্য সরকারের আমলে এই সম্প্রদায়ের মানুষজন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

আফগান মডেলদের সাহসিকতার প্রশংসা করে অনেকে বৈষম্যহীন, সমঅধিকার ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। তবে অনেকেই এ ঘটনায় বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। যদিও বিরক্তি প্রকাশকারী দলে বেশিরভাগ আফগান রয়েছেন। এরা সবাই নারীদের প্রতি রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করে থাকেন।

টুইটারের চেয়ে ফেসবুকেই বেশি মতামত এসেছে। আফগানিস্তানের উদারপন্থী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুকেই বেশি সক্রিয় রয়েছেন।

ইসহাক আনিস টুইট করেছেন:

প্রথমবারের মতো কেউ কাবুলে ফ্যাশন শো করার সাহস পেল।

ফেসবুক ব্যবহারকারী সামি বাহা ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন:

I feel pity for you. You are prostitutes. First you adopted Western thoughts, and now you act like them. You have totally forgotten Allah’s sacred sayings in Holy Quran. May god bless your sins…”

আপনাদের জন্য আমার খুব দু:খ হচ্ছে। আপনারা সবাই বেশ্যা। প্রথমে আপনারা পশ্চিমা ধ্যানধারনা রপ্ত করেছেন, এখন তাদের মতো আচরণ করছেন। আল্লাহ কোরআনে কী বলেছেন, আপনারা সেটা ভুলে গেছেন। মহান আল্লাহ আপনাদের পাপ ক্ষমা করুন।

একই পোস্টে আলামীর আমিরি নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন:

Afghans get martyred every single day, but look at these whores. They are not Afghans, they are Westerners.

আফগানিস্তানেরা মানুষরা প্রতিদিন শহীদ হচ্ছে। কিন্তু এই বেশ্যাদের দিকে তাকান। এরা আফগান নয়। এরা সবাই পশ্চিমের বেশধারী মানুষ।

১৭৪৭ সালে আহমদ শাহ দুররানি আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময়ে কিছুদিনের জন্য আফগানিস্তানের নারীরা বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। তারপরে তারা দীর্ঘকাল নিষ্পেষণের শিকার হয়েছেন। বেশিরভাগ সময় তাদের ঘরের চার দেয়ালের মাঝে বন্দী হয়ে থাকতে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে সেটা ফলপ্রসু হয়নি।

১৯১৯ সালে আমানুল্লাহ খান দেশটির শাসনভার নেয়ার পর সংস্কারের পরিকল্পনা হাতে নেন। কিন্তু দেশটির মোল্লাতন্ত্র এর তীব্র বিরোধীতা করে। ফলে সে উদ্যোগও ভেস্তে যায়।

১৯৭৮-৯২ সালে দেশটিতে যখন গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা বজায় ছিল, সে সময়েও নারীদের অবস্থার উন্নতির জন্য বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। তবে একই সময়ে দেশটি জিহাদিদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। সোভিয়েত অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর নব্বই দশকের শুরুর দিকে আফগানিস্তানে নতুন অতি রক্ষণশীল দলের উদ্ভব হয়। এর নাম হলো তালেবান।

মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী কর্তৃক উৎখাত হওয়ার আগ পর্যন্ত তালেবানরা দেশটির ক্ষমতায় ছিল। এ সময়ে তারা নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নার্স এবং ধাত্রীরা নানা ধরনের প্রতিকুলতার সম্মুখীন হন। পাথর নিক্ষেপ এ সময়ে খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল।

তালেবানরা এখনো সরকারের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কার্যক্রম নিয়ে আফগানিস্তানের মানুষজন স্পষ্টত বিভক্ত। পত্রিকায় ফ্যাশন শো’র সংবাদ দেখে জাভেদ মারগির ফেসবুকে লিখেছেন:

Long live the Taliban.

তালেবান দীর্ঘজীবী হোক।

রামিন তানহা ক্ষোভের সাথে বলেছেন:

Once the Taliban get lost, our country will certainly progress.

তালেবানদের পতন হলে আমাদের দেশ উন্নতির দিতে অগ্রসর হবে।

নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তা বহর বাড়ানো হয়েছে। সীমিত পরিসরে হলেও জনসমুখে নারীদের উপস্থিতি বেড়েছে।

তবুও পুরোনো বাধাগুলো জাতির বৃহত্তর অংশ হিসেবে রয়ে গেছে।

কোরআন পোড়ানোর অভিযোগে গত মার্চে ফারখুন্দা নামের একজন নারীকে একদল উন্মত্ত জনতা পিটিয়ে হত্যা করে। পরে কাবুলের কেন্দ্রস্থলে তার মৃতদেহ পুড়িয়ে দেয়। ওই নারী মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে মাত্র কয়েকশ’ মিটার দূরে এই ঘটনা ঘটে।

অতি সম্প্রতি আরো একটি ঘটনা ঘটেছে। প্রেমিকের সাথে গোপনে পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে ১৯ বছর বয়সী রোকসানাকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়। এটি ঘুর প্রদেশের ঘটনা। প্রেসিডেন্ট ঘানি যে তিনজন নারীকে প্রাদেশিক গভর্নর করেছেন, এদের একজন হলেন এই ঘুর প্রদেশের।

২০১৩ সালে আফগান উইমেন ফর চেঞ্জ নামের একটি সংগঠন তালেবান যুগের অবসানের পর আফগানিস্তানে প্রথমবারের মতো কাবুলে একটি ফ্যাশন শো’র আয়োজন করেছিল। সে সময়ে দেশটির প্রভাবশারী ধর্মীয় নেতারা এই উদ্যোগের বিরোধীতা করেছিলেন।

একজন ধর্মীয় নেতা তার ব্লগে এই ধরনের ফ্যাশন শো’র আয়োজকদের পশ্চিমাদের হাতের পুতুল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এতে করে তারা তাদের সম্মানও হারিয়েছেন। তিনি মুসলমানদের এ ধরনের ঘটনায় নীরব না থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে যাই হোক না কেন, প্রতিকি হলেও এ ধরনের উদ্যোগ একটু একটু করে হচ্ছে। সামনের দিকে অগ্রযাত্রা অব্যাহতও আছে। যদিও পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার অনুসারী ধর্মীয় গোষ্ঠী এতে ক্ষুদ্ধ হচ্ছে।

নারীরা ঘরের কাজকর্ম করবে, এই ধারনা আফগানিস্তানে ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকলেও তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বিশ্বাস করেন, নারীদের আরো বেশি হারে সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা উচিত।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .