- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে চাকমা ভাষায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশ, অ্যাক্টিভিজম, আইন, আদিবাসী, চলচ্চিত্র, জাতি-বর্ণ, নাগরিক মাধ্যম, প্রতিবাদ, ভাষা, শিল্প ও সংস্কৃতি, সেন্সরশিপ
মর থেঙ্গারি সিনেমার প্রমো।

মর থেঙ্গারি সিনেমার প্রমো।

সম্প্রতি বাংলাদেশে চাকমা ভাষায় একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। সিনেমাটির নাম মর থেঙ্গারি। যার বাংলা মানে দাঁড়ায় আমার বাইসাইকেল। এটি পরিচালনা করেছেন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা অং রাখাইন। ছবিটিতে [1] বাংলাদেশে বসবাসকারী চাকমা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা উঠে এসেছে। তবে ছবিটি সেন্সরের জন্য আটকে থাকায় বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শন করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশ মানুষই বাংলা ভাষাভাষী। তবে বাংলা ছাড়াও এখানে ৪৫টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। সেসব জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা চলচ্চিত্রে খুব কমই উঠে এসেছে। এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড আপাতদৃষ্টিতে শুধুমাত্র বাংলা এবং ইংরেজি সিনেমার সেন্সর দিয়ে থাকে।

সেন্সর বোর্ডের কারো মতামত না জানা গেলেও বিভিন্ন জন বলেছেন, সেন্সর বোর্ড যদি অন্যান্য ভাষার সিনেমা রিভিউও করতো, তাহলেও এই সিনেমা ছাড়পত্র পেত না। তখন নিরাপত্তা আইনে একে আটকে দেয়া হতো।

চাকমা ভাষায় প্রথম সিনেমা

পরিচালকের মাথায় মর থেঙ্গারি সিনেমার আইডিয়া প্রথম এসেছিল ১০ বছর আগে। কিন্তু বিনিয়োগকারীর অভাবে কাজ শুরু করতে পারেননি। পরে পাণ্ডুলিপি কারখানা এগিয়ে আসে। তারা ৩০ জন বিনিয়োগকারী জুটিয়ে দেয়। এরপরে ২০১২ সালে সিনেমার কাজ শুরু হয়। সিনেমার গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে [1] কমল নামে একটি চরিত্র। সে শহরে চাকরি করে। কিন্তু একদিন তার চাকরি চলে যায়। চাকরি হারিয়ে সে গ্রামে ফিরে আসে। সাথে করে নিয়ে আসে তার বাইসাইকেল। তাদের গ্রামে সেটিই ছিল একমাত্র বাইসাইকেল। আর এই বাইসাইকেলে করে যাত্রী ও মালপত্র বহন করে আয় রোজগারের চেষ্টা করে। কিন্তু এখানেও ঘটে বিপত্তি।

মর থেঙ্গারি সিনেমার প্রমো।

মর থেঙ্গারি সিনেমার প্রমো।

৬৩ মিনিটের পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা মর থেঙ্গারি। পুরো সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। চাকমা সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষই বসবাস করেন এখানে। সিনেমায় অভিনয় করেছেন চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষজনই। এরা কেউই পেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রী নন। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন কমল মণি চাকমা। আর তার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ইন্দিরা চাকমা। তাদের দুজনের অভিনয় দর্শক এবং সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। আদিবাসী ভাষাগুলো যেখানে হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে এই ধরনের সিনেমা নির্মাণ ভাষাবিদ, সংস্কৃতি কর্মী, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন এমন মানুষদের মনোযোগ [2]কেড়েছে।

বাংলাদেশে চাকমা ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ [3]। কিন্তু বর্তমানে চাকমা ভাষা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে চাকমা ভাষায় ছবি নির্মাণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় [4]:

It is a great attempt, particularly in the present time as the Chakma language is dying and the government is doing nothing about it.

যখন চাকমা ভাষা মরে যাচ্ছে, সরকার কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না; ঠিক সেই সময়ে চাকমা ভাষায় সিনেমা নির্মাণ খুব ভালো একটি উদ্যোগ।

ভাষা বিপত্তিতে সেন্সর বোর্ড
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড প্রতিষ্ঠিত [5] হয় ১৯৭৮ সালে। এর মূল কাজ হলো সিনেমা রিভিউ করে সার্টিফিকেট প্রদান করা। তারা ঢাকাই সিনেমার পাশাপাশি আমদানিকৃত বাণিজ্যিক এবং অবাণিজ্যিক সিনেমাগুলো বাংলাদেশের হলগুলোতে প্রদর্শনের অনুমতি দিয়ে থাকে। সিনেমা সেন্সরশিপ অ্যাক্ট ১৯৬৩ সালের নীতিমালা অনুযায়ী তারা এই কাজ করে থাকে। ১৫ সদস্য [6] নিয়ে এই বোর্ড গঠিত। সেন্সর বোর্ডের জন্য সরকার বিভিন্ন সেক্টরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মনোনীত করে থাকেন।

ব্লগার মারজিয়া প্রভা [7] জানিয়েছেন, সেন্সর বোর্ড শুধুমাত্র বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় নির্মিত ছবির সনদ দিয়ে থাকে। প্রভা লিখেছেন, “ইংলিশ বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আমাদের সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দেয় না। ইহজগতে এইরকম আজিব বাত আসলেও শুনি নাই। এইগুলা বঙ্গদেশেই সম্ভব। যেখানে পাশের দেশ ভারতে হিন্দি, ইংলিশ, তামিল, মালায়াম, বাংলা ভাষায় ছবি প্রত্যেক বছরেই গণ্ডায় গণ্ডায় ছাড় পাচ্ছে।”

বাংলামেইলে ডানা বড়ুয়া [8] লিখেছেন, ভাষা বৈষম্যের কারণেই চলচিচ্চত্রকে ছাড়পত্র দেয়া হয়নি:

প্রতিবেশী দেশের হিন্দি ভাষায় করা মুভি পর্যন্ত আমাদের দেশে যেখানে ছাড়পত্র পায় সেখানে শুধুমাত্র চাকমা ভাষায় নির্মিত হওয়ার কারণে এই মুভিটিকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় নি। কথিত আছে নীতিমালায় নাকি ইংলিশ আর বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষার মুভি ছাড়পত্র দেওয়া হয় না। যদি শুধুমাত্র এই কারণেই মুভিটির প্রচারে বাধা থাকে তাহলে সেটা হবে নীতিমালার প্রচণ্ড একটা দুর্বলতা।

তবে ভাষা এই সিনেমার একমাত্র প্রতিবন্ধক নয়। প্রভা জানাচ্ছেন, “আমাদের দেশে ছবি ছাড়পত্র পেতে পরিচালককে ডিরেক্টর অ্যাসোসিয়েশন এবং প্রযোজককে প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হতে হয়। আর এই সদস্য হতে লাখ খানেক টাকা লাগে। এমনি এমনি হওয়া যায় না!”

অন্য একটি প্রতিবেদনে [9]বলা হয়েছে, ছবিটির সেন্সর শো অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়েছে। এরপর নতুন করে আর সেন্সর শো অনুষ্ঠিত হয়নি। কবে হবে সেটাও জানানো হয়নি। তবে অনেকে বলছেন, সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার কারণে ছবিটি আটকে দেয়া হয়েছে।

মানবাধিকার লংঘন

এই সিনেমা কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানোর পরে সেনাবাহিনী ছবিটির ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়ে ১৪ পাতার চিঠি লেখে। সেখানে তাদের কার্যক্রম দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ করে। ব্লগার মারজিয়া প্রভা লিখেছেন, “আর্মিরা পাহাড়ি জীবনকে কিভাবে বিপর্যস্ত করে তা সিনেমায় তুলে ধরলে কি হপে? সবাই সব কিছু জেনে যাবে না? কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বের হবে না! বিগ প্রব্লেম, সো ছবি আটকাও।”

মর থেঙ্গারি সিনেমায় পাহাড়ে চাকমা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা তুলে ধরার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের [10] চিত্রও উঠে এসেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ সরকার আর জনসংহতি সমিতির মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সংঘর্ঘের ঘটনা [11] ঘটেছিল। এ কারণে সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছিল। ১৯৯৭ সালে দুপক্ষের মধ্যে শান্তি চুক্তির [12] ফলে সংঘর্ষের অবসান ঘটে। তবে এখনো মাঝে মাঝে মানবাধিকার লংঘনের খবর পাওয়া যায়।

রাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে মতভেদ আছে এমন অনেক কারণে নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে সিনেমা সেন্সর করা হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রতিরক্ষা বাহিনী অথবা দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নিয়োজিত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো বাহিনী অথবা দায়িত্বশীল অন্য যেকোনো বাহিনীর অবমাননা করা দেখালে; কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো বিষয়ে বাংলাদেশ এবং এর মধ্যে বিবাদ বা বিতর্কমূলক কিছু থাকা সত্ত্বেও এর পক্ষে প্রচারণা দেখানো হলে অথবা বিদেশী কোনো বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিনষ্টকারী কোনো প্রচারণা বা কার্যক্রম দেখানো হলে সেন্সর বোর্ড ছবিটি সেন্সর করতে পারে।

দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শন

সেন্সর বোর্ডের [13] ছাড়পত্র ছাড়া বাংলাদেশে কোনো ছবিই প্রদর্শন করা যায় না। তবে এই ছবি বিদেশের বেশ কয়েকটি উৎসবে [14] প্রদর্শিত হয়েছে। উৎসবগুলোর মধ্যে রয়েছে ইতালির রিলিজিয়ন টুডে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, যুক্তরাজ্যের ১৬তম রেইনবো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল [15]। এই উৎসবগুলোতে ছবিটি বেশ প্রশংসিতও হয়েছে। তাছাড়া দেশের ভিতরে সাউথ এশিয়ান ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ১৩তম বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও উন্মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া প্রদর্শনীর ব্যাপারে রাখাইন আইনের ফাঁকের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, অবাণিজ্যিক প্রদর্শনের জন্য সেন্সর সার্টিফিকেটের দরকার নেই।

চাকমা ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য পরিচালককে প্রশংসা জানিয়ে ব্লগার মোরতাজা [16]সামহোয়্যারইনব্লগে লিখেছেন:

রাষ্ট্র অংদের মেধার লালনে এগিয়ে আসবে- দর্শকরা তাদের চলচ্চিত্র দেখে উৎসাহ যোগাবে। এটাই আশা করি। অং রাখাইনের জন্য শুভকামনা। ‘মর থেংগারি’ এর গতি পাবে।

সিনেমার ট্রেইলার রইলো এখানে: