
প্যারিসে সন্ত্রাসী আক্রমণের প্রতিবাদে বিশ্বব্যাপী ভাবনাগুলো
আমি লেবাননের একটি বনেদি ফরাসি ভাষী সম্প্রদায় থেকে এসেছি। এর মানে হচ্ছে আমি সবসময় আমার দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে ফ্রান্সকে দেখেছি। বৈরুতের রাস্তাগুলো আমার যত পরিচিত, প্যারিসের রাস্তাও তেমনি পরিচিত। এইতো কয়েক দিন আগেই আমি প্যারিসে ছিলাম।
সন্ত্রাস ও সহিংসতার দুটি ভয়ঙ্কর রাত কাটালাম। প্রথমটিতে ৪০ জনেরও বেশী লোক বৈরুতে জীবন দিয়েছে। দ্বিতীয়টিতে প্যারিসে ১২০ জনেরও বেশী মারা গিয়েছে – যে সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
আমার কাছে এখন স্পষ্ট যে বিশ্ববাসির কাছে বৈরুতে আমার দেশী লোকের মৃত্যু আর প্যারিসে আমার আরেক দেশের লোকের মৃত্যু একই গুরুত্ব বহন করে না।
‘আমরা’ (বৈরুতের জন্যে) ফেসবুকে একটি নিরাপদ বাটন পাব না। ‘আমাদের’ জন্যে লক্ষ লক্ষ অনলাইন ইউজার আবেগ ভরা স্ট্যাটাস বা গভীর রাতে ক্ষমতাশালী নেতা নেত্রীরা বাণী দেবে না।
‘আমরা’ কোন নীতি পরিবর্তন করতে পারি না যা অগণিত নির্দোষ উদ্বাস্তুদের জীবন প্রভাবিত করবে।
এর চেয়ে এটা পরিষ্কার হতে পারে না।
আমি এটা কোন রাগ বা বিরক্তি থেকে বলছিনা, শুধু বিষণ্ণতা থেকে।
উপরের কথাগুলো থেকে এটা অনুধাবন করা কষ্টের যে প্রগতিশীল চিন্তাধারার মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে আমরা বিশ্বব্যাপী একটি একীবদ্ধ কণ্ঠস্বর তৈরি করতে পারলেও এই অদ্ভুত প্রজাতির মানবজাতির অধিকাংশই এখনও ক্ষমতাধর বিশ্ববাসির কাছে অপাংক্তেয়, তাদের উদ্বেগের অংশ নয়।
এবং জানি যে আমি যে ‘বিশ্বের’ কথা বলছি, তার মধ্যে আসল বিশ্বের অনেক মানুষকেই ধরা হয়নি। এভাবেই যে ক্ষমতা কাঠামোগুলো কাজ করে।
আমি কোন ব্যাপার না।
আমার ‘মৃতদেহ’ ‘বিশ্বের’ কাছে কোন ব্যাপার না।
আমি মারা গেলে কোন কিছু হবে না।
আবারও বলছি, আমি কোন বিরক্তির সাথে এটি বলছিনা।
এই বিবৃতি নিছক একটা সত্য। এটি আসলে হয়ত একটি রাজনৈতিক বক্তব্য, কিন্তু তবু তো একটা সত্য।
হয়তো আমার মধ্যে কিছু বিরক্তিভাব থাকা উচিত, কিন্তু আমি খুব ক্লান্ত। এটি বোঝার জন্যে খুব কঠিন একটি বিষয়।
আমি জানি যে আমি এতটাই সৌভাগ্যবান যে আমি মারা গেলে আমার বন্ধু এবং ভালোবাসার জনরা স্মরণ করবে হয়ত। আমার ব্লগ এবং একটি অনলাইন উপস্থিতির কারণে হয়ত সারা বিশ্বের মানুষের কিছু চিন্তা অর্জন করতে পারি। এটাই ইন্টারনেটের সৌন্দর্য যদিও তা অনেকের নাগালের বাইরে।
সাংবাদিক তা-নেহিসি কোটস আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের মৃতদেহর ব্যপারে যা বলেছিলেন তা এর চেয়ে পরিষ্কারভাবে আগে বুঝিনি কখনও। আমার মনে হয় পাশাপাশি আরব মৃতদেহর একটি গল্পও আছে মনে হয়। আদিবাসী আমেরিকানদের মৃতদেহ। অন্যান্য আদিবাসীর মৃতদেহ। ল্যাটিন আমেরিকান মৃতদেহ। ভারতীয় মৃতদেহ। কুর্দি মৃতদেহ। পাকিস্তানি মৃতদেহ। চৈনিক মৃতদেহ এবং অন্যান্য অনেক মৃতদেহ।
মানব দেহ এক নয়। এটা মনে হয় যে এতদিনে এটা হয়ে যাবার কথা ছিল। হয়তো এই ভাবনাটাই একটি বিভ্রম। কিন্তু হয়তো এই বিভ্রমটা পুষে রাখা দরকার, কারণ অপরের শরীরের কোন অংশকেও যদি এক ভাবার আকাঙ্ক্ষা না থাকে আমি জানিনা কোন জগতে আমরা বাস করছি এখন।
কিছু মৃতদেহ বৈশ্বিক হয়, কিন্তু অধিকাংশ হয়ে যায় ‘জাতিগত’, ‘আঞ্চলিক’ বা স্থানীয়।
আজকের এবং গতকালের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকার সকলের প্রতি আমার ভাবনা রইল। এবং আমার চিন্তা রইল সেই সব মানুষের প্রতি, যারা কতিপয় গনহত্যাকারির কার্যকলাপের জন্যে গুরুতর বৈষম্য এবং নিপীড়নের শিকার হবে। আমি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি নিজেদের এক ভাবতে না পারা নিয়ে মানব সভ্যতার ব্যর্থতাকে।
আমার একমাত্র আশা যে আমরা হয়ত সাহস ও শক্তি পাব এই অপরাধীদের যে খারাপ উদ্দেশ্য ছিল, তার বিপরীতে কিছু প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে। আমি যথেষ্ট আশাবাদী হতে চাই এই বলে যে আমরা হয়ত সেই খানে পৌছুচ্ছি, সেটা যেখানেই হোক না কেন।
আমাদের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে কথা বলার প্রয়োজন, বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন। আমাদের বলতেই হবে।