পৃথিবীর যেসব দেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম হলো ভারতের রেল ব্যবস্থা। প্রতিদিন এ পথে ১২ হাজারেরও বেশি ট্রেন চলাচল করে। যাত্রীর সংখ্যা ২.৩ কোটিরও বেশি। আর রেল জংশনের সংখ্যা ৭,১১২টি। ভারতীয় রেলে করে কোথাও যাওয়ার কথা মনে এলেই এক ধরনের রোমান্টিসিজম ঘিরে ধরলেও যাত্রাপথটা সবসময় আনন্দময় হয়ে উঠে না।
বিশ্বাস না হলে রেল যাত্রীদের একবার জিজ্ঞেস করেই দেখুন না:
The Train#12488is running 12 hrs late. and you are talking bullet trains. oh please stop dreaming sir @sureshpprabhu sir. #IndianRailway
— Amit Kumar Ranjan (@akranjan_86) October 18, 2015
১২৪৮৮ নম্বর ট্রেনটি ১২ ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। আর আপনি কীনা কথা বলছেন বুলেট ট্রেন নিয়ে। দয়া করে এইসব আজগুবি স্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন। @সুরেশপ্রভু স্যার
@sureshprabhu @NarenderModi Onboard Amritsar Shatabdi..#SwachhBharat in #IndianRailway D8 of travel: 20.10.15 pic.twitter.com/GNdSVbYqsg
— Chaitanya Mahajan (@mahajantalks) October 21, 2015
@সুরেশপ্রভু এবং @নরেন্দ্র মোদী, দেখুন অমৃতসর ট্রেনের ভিতরের অবস্থা কেমন! স্বচ্ছ ভারতের রেল।
We really don't deserve to live in India. RIP Indian railway…. Waiting on an unknown station for more than hour…. RIP
— Nilabh choudhary (@NilabhC) October 16, 2015
আমরা সত্যি সত্যি ভারতে বসবাসের উপযুক্ত নই। বিদায় ভারতের রেলওয়ে… অপরিচিত একটি জংশনে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছি…
শতাব্দী প্রাচীন ভারতীয় রেল ব্যবস্থার জন্য নতুন করে পুনর্গঠন করা খুব দরকার। কারণ এতে নানা ধরনের সমস্যা যেমন অত্যাধিক ভিড়, দেরি করে ছাড়া, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য এবং নানা ধরনের দুর্ঘটনা লেগেই আছে। ২০১৫ সালে ইতোমধ্যে ১০টির বেশি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। এতে মারা গেছে ১১৫ জন, আহত হয়েছে ৩৯০ জনের বেশি মানুষ। তাছাড়া নতুন করে রেল লাইন সম্প্রসারণে ভুমি অধিগ্রহণের সমস্যা এবং তহবিলের স্বল্পতা তা রয়েছেই।
সেবা এবং রেলের ভিতরের পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। নিকিতা জৈন তার অভিজ্ঞতা কথা আইবিএন লাইভ ব্লগে শেয়ার করেছেন:
Life in India doesn't stop for a train journey, it invades it. The train is a meeting place, a marketplace, a hotel and a restaurant. People seem to materialise from nowhere. They're selling drinks, food, newspapers, kids’ toys.
ভারতীয় জীবনে রেল ভ্রমণ বন্ধ করা সম্ভব নয়, এটা এসেই পড়বে। কেননা, আড্ডার জায়গাই বলেন, কিংবা কেনাকাটার স্থানই বলেন কিংবা হোটেল বা রেস্টুরেন্ট যাই বলেন, সব আছে রেলওয়েতে। মানুষের আর কোথাও যাওয়ার দরকার পড়বে না। নানা ধরনের পানীয়, খাবার, পত্রপত্রিকা, খেলনা সব কেনাবেচা হয় সেখানে।
নিকিতা কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন। এর একটি হলো রেলে খাবার সরবরাহের বিষয়। বিক্রেতারা বিষয়টিকে গভীরভাবে বিবেচনা করতে পারে:
One of the biggest contract in Indian Railways is possibly turning out to be the biggest pain for passengers travelling on long distance journeys. While the passenger has to trust (and in many cases has no other option) the pantry car for supplying hygienic food, the contractors are doing their best to squeeze out money and serve just bearable food. All this under the nose of the government.
ভারতে রেলে করে দূরের যাত্রাপথটি যাত্রীদের জন্য বেদনাদায়ক হয়ে উঠে। যাত্রীরা যখন বিশ্বাস করে (যদিও অন্য কোনো বিকল্প থাকে না) ভাঁড়ার গাড়ির সরবরাহ করা পরিচ্ছন্ন খাবার নেন, সেটা শুধু ঠিকাদারদের পকেটই ভারী করে তোলে। কারণ সেটা নামকাওয়াস্তে খাবার, সেখানে পরিচ্ছন্নতার কোনো বালাই নেই। আর এর সবকিছুই সংঘটিত হচ্ছে সরকারের নাকের ডগায়।
আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ কী আছে?
যদিও সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করার জন্য নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ডমিনোজ’স পিজা এবং কেএফসি রেলে খাবার সরবরাহ করা শুরু করেছে। গুগলের সহযোগিতায় আগামী বছরের মধ্যে ৫০০টি রেলওয়ে জংশনে ওয়াইফাই দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাছাড়া রেলওয়ে অ্যাপ-ও বানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই অ্যাপের মাধ্যমে যাত্রীরা খুব সহজেই আসন বুকিং এবং টিকিট কাটতে পারবেন।
Solar power generation at the vaishnodevi railway station! Suresh Prabhu is showing what the Indian railways can be! https://t.co/x7rZEfGAQH
— Dhishan Kande (@nanokande) October 18, 2015
বিষ্ণুদেবী রেলওয়ে জংশনে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে! সুরেশ প্রভু দেখিয়ে দিলেন ভারতীয় রেল কী করতে পারে!
জাপানের সহযোগিতায় ভারতে প্রথমবারের মতো বুলেট রেললাইন স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ২০১৭ সালের মধ্যে কাজ শুরু হয়ে ২০২৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ হবে। খুব আনন্দদায়ক ব্যাপার তাই না? সম্ভবত। কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে এটা ভারত। এখানে ‘পরিকল্পনা’ এবং ‘সম্পাদনের’ মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। অতীতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেক অনেক পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে সেগুলো আর আলোর মুখ দেখেনি।
ভারতীয় রেলওয়ের বয়স ১৬২ বছর। তবে এত বছর হলে কী হবে, এর নগদ-নারায়ণের খুব অভাব। কারণ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর ৪.৫ বিলিয়ন ডলার লোকসান দেয়। মূলত যাত্রীদের ভাড়ার ওপর ভর্তুকি দেয়ার কারণে এটি হয়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতীয় রেলওয়েকে আধুনিকায়নের জন্য রেলমন্ত্রী দিনেশ ত্রিবেদী একটি বিশেষ কমিটি নিয়োগ করেন। কমিটির নাম হলো স্যাম পিত্রোদা কমিটি। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কমিটি একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে কমিটি আগামী বছরে ভারতীয় রেলে আধুনিকায়নের জন্য ৯০ বিলিয়ন ডলারের দরকার বলে জানায়। এই অর্থ ব্যবহার করে রেলওয়ের অবকাঠামো আধুনিকায়ন, রেললাইন সম্প্রসারণ এবং নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার রেলওয়ে বাজেট দিয়েছে। সেখানে সরকার রেলওয়ে খাতে ১৩৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার কথা বলেছে। আগামী পাঁচ বছরে রেললাইনের অবকাঠামো উন্নয়নে এই অর্থ ব্যবহার করা হবে।
ভারত চীনের মতো উত্পাদন কেন্দ্র হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অবকাঠামো উন্নয়নে তারা ব্যাপক পিছিয়ে রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন দেশটির রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ৫৪ হাজার কিলোমিটার। আর সে সময়ে চীনের রেলপথের পরিমাণ ছিল এর অর্ধেক। অথচ এখন চীনে ১,১০,০০০ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। আর স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ভারতে মাত্র ১০ হাজার কিলোমিটার রেলপথ বেড়েছে।
ভুমি অধিগ্রহণ ও আমলাতান্ত্রিক বাধা
ভারতীয় রেলওয়ের মালিক রাজ্য সরকারগুলি। তারাই এটি পরিচালনা করে। ভারতীয় রেলওয়ের নিরাপত্তা এবং উন্নতি পর্যালোচনার জন্য ড. অনিল কোকোদকারকে সভাপতি করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কোকোদকার কমিটি স্বাভাবিক কার্যক্রমে ক্ষমতায়নের অভাব এবং অদক্ষ কর্মক্ষমতার সমালোচনা করেছে। রেলওয়ের একটি নিজস্ব মন্ত্রণালয় রয়েছে। তবে তারা জাতীয় পর্যায়ে নামমাত্রই সংস্কার করতে পারে। বিষয়টি সঠিকভাবে তদন্ত করে দেখা উচিত। তাছাড়া রাজনৈতিক চক্কর এবং লেনদেনের ব্যাপার তো রয়েছেই।
রেলওয়ে কার্যক্রমে গতি আনতে স্যাম পিত্রোদা কমিটি প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের সুপারিশ করে। এতে করে কর্মকর্তারা যখন যেটা দরকার, সেটা বাস্তবায়নের ক্ষমতা পাবেন। ফলে কার্যক্রমে গতি ফিরে আসবে।
তবে ব্লগার রাজ ভারথের কাছে এটাই যথেষ্ট নয়। তিনি রেলওয়েকে বেসরকারিকরণের পরামর্শ দিয়েছেন। বেসরকারিকরণ হলে প্রতিযোগিতা বাড়বে। যার ফলে তারা অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং হাইজেনিক সুবিধা দিতে সচেষ্ট হবে:
Our Country has a very good experience of Privatization in Aviation Industry and that should be a good enough experience and reason to give it a try in Railways also.
আমাদের দেশে বিমান শিল্পকে বেসরকারিকরণ করার ভালো উদাহরণ রয়েছে। এই একটি ভালো উদাহরণই যথেষ্ট। রেলওয়েতে আমরা এটা চেষ্টা করে দেখতে পারি।
ভারতে যেকোনো প্রকল্পের জন্য ভুমি অধিগ্রহণ করা সবসময়ই সমস্যাজনক। এই অবস্থার পরিবর্তন এবং দেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবিত করতে সরকার ১৯৮৪ সালের ভুমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধনের চেষ্টা করছে। সংশোধিত বিল অনুমোদিত হলে ভুমি অধিগ্রহণ করা আরো সহজ হবে। সংশোধিত বিলে বলা হয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা অথবা গ্রামীণ এবং সামজিক অবকাঠামোর নির্মাণের উদ্দেশ্যে যদি ভুমি অধিগ্রহণ করা হয়, সেক্ষেত্রে সম্মতি এবং সামাজিক প্রভাব মূল্যায়নের দরকার হবে না।
ভারতে বেশিরভাগ ভুমির মালিকই কৃষক। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা বিষয়টিকে খুব ভালো ভাবে নেয়নি। কারণ বিলটি অগণতান্ত্রিক এবং কৃষকবিরোধী। কৃষকরা মাসব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশ ও র্যালি করে। পরে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে বিলটি লোকসভায় উঠে। কিন্তু বিরোধী দলের বাধার মুখে অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হয়।
এনডিটিভি’র তথ্যমতে, ভুমি অধিগ্রহণ সমস্যার কারণে ৯ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পটি বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।