ভারতের জনসংখ্যা ১২০ কোটি। এর অর্ধেকই আবার গ্রামে বাস করেন। এদের বাড়িতে ফ্লাশ টয়লেট সুবিধা নেই। বাধ্য হয়েই তারা খোলা মাঠে কিংবা অস্বাস্থ্যকর শুকনো গর্তে শৌচকর্ম করেন। গ্রামের ৭২ শতাংশের বেশি মানুষ খোলা মাঠে কিংবা গর্তে শৌচকর্ম সারেন।
পানীয় জল ও স্যানিটেশন মন্ত্রণালয়ের ২০১২ সালের বেইজলাইন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওড়িশায় ৮৮ শতাংশ, বিহারে ৭৯ শতাংশ, ঝাড়খণ্ডে ৭২ শতাংশ, জম্মু ও কাশ্মিরে ৭৫ শতাংশ এবং তেলাঙ্গানায় ৭৪ শতাংশ বাড়িতে শৌচাগার নেই। বাড়ির বাইরে খোলা আকাশের নিচে মল ত্যাগের কারণে ভারতে সামাজিক সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০১৫ সালের ৪ জুলাই ঝাড়খণ্ডে ঝুমকা নামের ১৭ বছরের এক কিশোরী আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে জানা যায়, সে বাইরে শৌচকর্ম করা নিয়ে লজ্জিত ছিল। সেজন্য বাবা-মাকে অনুরোধ করেছিল বাড়িতে শৌচাগার নির্মাণ করতে। কিন্তু বাবা-মা সেটা না করায় সে আত্মহত্যা করে। গত বছর উত্তর প্রদেশের কাটরা বাদায়ুন জেলায় দুই কিশোরীকে গণধর্ষণেরপর গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। প্রতিবেদনে জানা যায়, কিশোরীদ্বয় রাতে মলত্যাগের উদ্দেশ্যে বাইরে গিয়েছিল। পরে আর ফিরে আসেনি।
কিশোরী ও নারীদের হয়রানীর প্রধান একটি কারণ হলো খোলা আকাশের নিচে শৌচকর্ম করা। গাছপালা কাটার কারণে একটু আড়ালে যে করবে, সেটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। তরুণীরা এর সমাধান খুঁজতে সবার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।
২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের কথা বলেছেন। সেখানে তিনি ভারতের প্রতিটি স্কুলে স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন:
This is a shame for a country that has global aspirations and that the lack of sanitary conveniences is demeaning to women.
এটা দেশের জন্য খুব লজ্জার। আমরা একদিকে বৈশ্বিক সক্ষমতা অর্জনে স্বপ্ন দেখছি, অন্যদিকে স্যানিটারি সুবিধার অভাবে নারীরা পিছিয়ে পড়ছে।
ভারতের কোনো কোনো রাজ্য বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। যেমন লুধিয়ানা। তারা ২০১৭ সালের মধ্যে ১০০টি গ্রামের লোকজন যাতে আর খোলা আকাশের নিচে শৌচকর্ম না করে সেই উদ্যোগ নিয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগে ‘নির্মল ভারত অভিযান’ নামের আরেকটি প্রচারণা কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল, ঘরে ঘরে শৌচাগার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সেটা সফলতার মুখ দেখেনি।
মোদীর উদ্যোগ নিয়ে মূলধারার মিডিয়াতে যে আলোচনা হচ্ছে, তাতে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার আলোচনা থেকেও এটা স্পষ্ট যে, এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে:
#ShamelessBJD 88%household in Odisha don't have toilet. http://t.co/B1aJRgWqdh
— Srilok Nath Ratha (@snrath) June 30, 2015
#লজ্জাহীনবিজেপি, ওডিশার ৮৮ শতাংশ বাড়িতে টয়লেট নেই।
Peeing in public lands 109 in jail for 24 hrs. Not very viable cure in India where 635 million have no access to toilet.
— Silva Paananen (@SilvaPaananen) June 27, 2015
জনসম্মুখে মূত্রত্যাগের জন্য ১০৯ ধারায় ২৪ ঘণ্টা জেলের বিধান রয়েছে। অথচ ভারতের ৬৩৫ মিলিয়ন লোকের টয়লেটে প্রবেশাধিকার নেই।
নয়া দিল্লির ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো সেন্টার একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। সেখানে ওয়াটার এইড নামের একটি এনজিও’র পানি ও স্যানিটেশন বিভাগের পলিসি বিষয়ক প্রধান নিত্য জ্যাকব ভারতীয়দের প্রতিদিনের জীবনে পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধিকে প্রাধান্য দিতে বলেছেন। স্বাস্থ্যকর শৌচাগার থাকা সত্ত্বেও খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে। অন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সেটা হলো বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের সুযোগের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করানো। শুধু শৌচাগার বানিয়ে সবার স্বাস্থ্যবিধি’র পরিবর্তন ঘটানোর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান রয়েছেন।
জ্যাকবের পাশাপাশি সাহায্য এবং উন্নয়ন বিষয়ক সফটওয়্যার কোম্পানি অ্যাভকোস এশিয়া হাবের প্রকল্প পরিচালক অমিতাংশু আচার্য হাফিংটন পোস্ট ইন্ডিয়ায় সমস্যার অন্য একটি দিক তুলে ধরেছেন:
Most engineers in government departments are men, while women are the demographic that predominantly support the building of toilets. Male engineers tend to focus more on technical accuracy than on women's (and other users’) need for design that caters to their privacy and menstrual hygiene management needs.
সরকারি দফতরের বেশিরভাগ প্রকৌশলীই পুরুষ। অন্যদিকে নারী যারা আছেন, তারা টয়লেট নির্মাণের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। পুরুষ প্রকৌশলীরা কারিগরি দিক দিয়ে ঠিক হচ্ছে কীনা সেটার উপর গুরুত্ব দিলেও নারী প্রকৌশলীরা টয়লেটের ডিজাইনের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, যাতে নারীদের গোপনীয়তা রক্ষা হয় এবং ঋতুকালীন সময়ের প্রয়োজনগুলোও মেটে।
এরপরে মানসম্পন্ন যেসব শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো ব্যবহারের অসুবিধার দিকগুলো তুলে ধরেছেন:
The angle of the toilet pan is not steep enough, or the pipe that connects the pan to the pit is not sloped properly, or the pit collapses on its own weight.
টয়লেট প্যানের অ্যাঙ্গেলগুলো যথেষ্ট খাড়া নয়। আবার গর্তের উপরে প্যানের সাথে যুক্ত করতে যে পাইপটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটার ঢালুও ঠিকমতো হয়নি। আবার দেখা গেছে, পিট তার নিজের ভারেই ভেঙ্গে পড়ে।
ভারতজুড়ে স্বাস্থ্যবিধি’র প্রতি এই যে আচরণ, তা আসলে বৈষম্যমূলক জাতিভেদপ্রথা থেকে প্রভাবিত। অপ্রতুল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে ভারতে নিম্নবর্গের একটি জাতিই তৈরি হয়েছে। এরা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানব বিষ্ঠা পরিষ্কার করে। এদেরকে ‘অস্পৃশ্য’ বলে দূরে রাখা হয়।
সমীর কামাট এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন:
There are documented cases of manual scavenging even in big towns/villages. For example in a sample survey in Delhi in 2008, 13 people working as manual scavengers were identified. Another example is Meerut, one of the prime towns of UP, only 60kms from the National Capital. During a Sample Survey in Meerut in 2010, 392 Manual Scavengers were documented.
বড় শহর ও গ্রামে মানব বিষ্ঠা হাতে পরিষ্কার করার ঘটনা রয়েছে। ২০০৮ সালে দিল্লিতে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়েছিল। সেখানে ১৩ জনকে পাওয়া যায়, যারা হাত দিয়ে মানব বিষ্ঠা পরিষ্কারের কাজ করেন। ২০১০ সালে উত্তর প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর মিরাটের একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়েছিল। সেখানেও ৩৯২ জনকে পাওয়া গিয়েছিল যারা হাত দিয়ে মানব বিষ্ঠা পরিষ্কারের কাজ করেন।
জ্যাকুলিন সিস্ল্যাক নামের একজন পিএইচডি গবেষক ভারতে ধর্ম এবং টয়লেট ব্যবহারের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। আর এজন্য তিনি জনসাধারণকে যেখানে-সেখানে প্রস্রাব করা থেকে বিরত রাখতে উদ্ভাবনী উপায় বাতলে দিয়েছেন:
[…] the practice of affixing pictures of gods on the walls of public buildings in India to prevent men from urinating on them. This is a kind of proxy faith in other people’s beliefs and their readiness to change their behaviour for those beliefs — in other words, one doesn’t have to believe in Hindu gods to believe that people who do believe in them won’t urinate on them.
… পুরুষদের প্রস্রাব করা থেকে বিরত রাখতে ভারতে সরকারি ভবনের দেয়ালে [যেসব জায়গায় মানুষজন প্রস্রাব করে] দেবতাদের ছবি টাঙ্গাতে হবে। এটা এক ধরনের প্রক্সি বিশ্বাস, যা অন্যরা ধারণ করে। এতে করে তারা তাদের আচরণ পরিবর্তন করবে। অন্যদিকে যারা হিন্দু দেবতাদের বিশ্বাস করে না, তারাও অন্যদের দেখাদেখি মূত্র ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকবে।
পরবর্তীতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা গেছে, উচ্চবর্ণের লোকদের এই পরিকল্পনা থেকে সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই আচরণের পরিবর্তন আনতে ব্যক্তির শৌচাগারের স্বাস্থ্যবিধির উপর গুরুত্ব আরোপ করার পাশাপাশি সম্প্রদায়ের সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। স্বচ্ছ ভারত অভিযান পরিচালনা করতে স্বাস্থ্যকর শৌচাগারের চাহিদা সৃষ্টির চেয়ে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। এবং সেটার ফলাফল কেমন হচ্ছে, সেটার জন্য কার্যকরী মনিটরিং ব্যবস্থা করতে হবে।