
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি’র ওপর ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদ করছেন। ছবি তুলেছেন রেজা সুমন। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (১০.০৯.২০১৫)।
শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপের কথা আপনি কি কখনো শুনেছেন? বর্তমানে বাংলাদেশে সেটা নিয়েই তুমুল আলোচনা হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি’র ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ভ্যাট এবং শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা গত ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫-এ ঢাকা-সহ দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। তাদের বিক্ষোভ কর্মসূচির কারণে দেশটির রাজধানী ঢাকা ছাড়াও আরো কয়েকটি শহরে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। কয়েকটি স্থানে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি’র ওপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে গত ৯ সেপ্টেম্বর শতাধিক শিক্ষার্থী বাড্ডা লিংক রোডের কাছে আফতাবনগরে রাস্তা অবরোধ করে। এ সময়ে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ২৩ শিক্ষার্থী ছাড়াও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্টার আহত হন।
East West Students report disproportionate use of force by police #NoVatOnEducation protests #Bangladesh @Saimum12 pic.twitter.com/OGa9wyvUwx
— Chaumtoli Huq (@lawatmargins) September 10, 2015
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, তাদের ‘শিক্ষার উপর ভ্যাট নয়’ আন্দোলনে পুলিশ ব্যাপকমাত্রায় বলপ্রয়োগ করেছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছর থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি’র ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আরোপ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী প্রথমে ১০ শতাংশ আরোপ করার কথা বললেও প্রধানমন্ত্রী পরে সেটাকে কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশের প্রস্তাব করেন। তারপর থেকেই “শিক্ষার উপর কোনো ভ্যাট নয়” স্লোগান নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৮৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আর অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ১৪ হাজার ৬৪০ জন।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনিতে পড়ার খরচ খুব বেশি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের কোর্স শেষ করতে আনুমানিক ৭ লাখ টাকা লাগে। আর মেডিক্যাল কলেজে এর দ্বিগুণ খরচ পড়ে, প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এই টাকার ওপর ভ্যাট আসে ৫২,৫০০ টাকা। তাই নতুন করে ভ্যাট আরোপ তাদের শিক্ষা খরচ আরো বাড়িয়ে দিবে।
ওসামা বিন নূর টুইট করেছেন:
My father is not an ATM booth! We demand "NO VAT ON EDUCATION". #education #vat #Bangladesh #protest pic.twitter.com/q879mBIBAZ
— Osama Bin Noor (@OsamaBinNoor) July 6, 2015
আমার বাবা এটিএম বুথ নন! আমরা শিক্ষার উপর কোনো ভ্যাট চাই না।
রাইসুল শিক্ষা যে মৌলিক অধিকার সেটা মনে করিয়ে দিয়েছেন:
Applying 7.5% Vat on Education Is a foolish action.
Education is basic right not a Product !!
#NoVatOnEducation pic.twitter.com/3Hax6DRFCi
— Ràí Sùl (@sul_rai) September 10, 2015
শিক্ষার ওপর সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট আরোপ একটি বোকার মতো কাজ। কারণ শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, মৌলিক অধিকার।
আরেকজন লিখেছেন:
#Bangladesh Constitution requires free universal education, but #govt proposes tax on education #NoVatOnEducation pic.twitter.com/ZWfKcLYPsZ
— Chaumtoli Huq (@lawatmargins) September 10, 2015
সংবিধানে শিক্ষাকে সার্বজনীন বলা হলেও সরকার শিক্ষার উপর কর আরোপের প্রস্তাব করছে।
"Education is an investment, not a kg of roshogollas" #NoVatOnEducation
— Imran Rahman (@imran_r) September 10, 2015
শিক্ষা একটি বিনিয়োগ। কেজি দরে কেনা রসগোল্লা নয়।
ভ্যাটের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকার কত টাকা আয় করতে পারবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নাজিম ফারহান চৌধুরী:
A question to ask is how much actually is the government hoping to earn from this levy? Could we not get that from somewhere else? Like if we stopped pavement beautification work, or not buying fancy SUVs for ministers, or even deciding we rather have a educated nation opposed to a warship?
আমার একটা জিজ্ঞাসা, এই খাতে ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে সরকার আসলে কত টাকা আয় করতে পারবে? এই টাকা কি আমরা অন্য কোথাও থেকে সংগ্রহ করতে পারি না? যেমন আমরা ফুটপাতের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ বন্ধ, অথবা সরকারের মন্ত্রীদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কেনা বাদ দিতে পারি, কিংবা যুদ্ধজাহাজ না কিনে শিক্ষিত জাতি গড়ার দিকে যেতে পারি?
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অন্যরাও সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ ফেসবুকে লিখেছেন:
ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মালিকানাধীন বাণিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন ফি অনেক বেশি। তার মানে এটা নয় যে, এখানে যে শিক্ষার্থীরা পড়ে তারা সবাই স্বচ্ছল বা বিত্তবান পরিবারের সন্তান। বরং অধিকাংশই মধ্যবিত্ত নিম্ন মধবিত্ত পরিবার থেকে আগত। সর্বজন বা পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থান সংকুলানের অভাবে এসব প্রতিষ্ঠানেই ভর্তি হচ্ছে তারা, বাজার বুঝে এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। ধারদেনা করে, জমিজমা বেচে, বাড়তি কাজ করে অভিভাবকেরা সন্তানকে পড়াচ্ছেন যাতে সন্তানের অবস্থা বদলায়, তাদের মতো না থাকে।

টিউশন ফি’র ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫-এ বনানি সড়ক অবরোধ করে। ছবি তুলেছেন সৌরভ লস্কর। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (১০/৯/২০১৫)।
টিউশন ফি’র উপর ভ্যাট আরোপের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে দেশটির অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। তার বক্তব্য মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের হাত খরচ এক হাজার টাকা। সেখানে ৭৫ টাকা কর বড় কিছু নয়। তবে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নাজিয়া মানজুর যুক্তি দিয়েছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সবাই ধনীর দুলাল নন:
I have students who struggle to pay the tuition fee–after giving tuitions, working two jobs and working the graveyard shift at call centers. I have had kids beg me or another faculty member for that A because without it they'd miss that scholarship and will just not be able to continue their education. I have seen kids walk around the corridors of our office rooms with an application in hand asking for financial assistance from us. Kids drop out. Often enough. The university doesn't officially allow students to sit for exams unless they've paid their dues. […]
আমার এক ছাত্র আছে, যার টিউশন ফি যোগাড় করতে খুব কষ্ট হয়। সে দু’টি টিউশনি করে। পাশাপাশি একটি কল সেন্টারেও কাজ করে। একবার আমার এবং আরেক কলিগের কাছে কিছু ছাত্র এলো। খুব করে অনুরোধ করলো তাদের যেন এ গ্রেড দিই। কারণ এ গ্রেড না পেলে তারা শিক্ষাবৃত্তি হারাবে। আর শিক্ষাবৃত্তি না পেলে তাদের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর হবে। আমি প্রায়ই কিছু ছাত্রকে দেখি যারা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসের সামনে ঘুরঘুর করে। তাদের হাতে বেতন মওকুফের আবেদনপত্র। তারা আগের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। তাদের সংখ্যা কম নয়। কারণ বেতন না দিতে পারায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের পরীক্ষা নেয়নি। […]
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ছাত্রছাত্রী নয়,বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভ্যাট দেয়ার কথা উল্লেখ করেছে। পরে দেশটির প্রধানমন্ত্রীও সংসদে একই কথা উল্লেখ করেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভ্যাট নিতে হলে আইন পরিবর্তন করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন সফটওয়্যার ব্যবসায়ী ফাহিম মাশরুর:
কেউ যদি বলে যে ‘ভ্যাট’ শিক্ষার্থীরা দিবে না বিশ্ববিদ্যালয় দিবে, তাদের আর যাই হোক ‘ভ্যাট’ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ‘তাত্বিক’ বা ‘ব্যবহারিক’ জ্ঞান নেই। যদি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো টাকা সরকারকে দেয় সেটি কোনভাবেই ‘ভ্যাট’ নয় – সেটি ‘আয়কর’ (যেটি ‘মুনাফা’ বা ‘লাভের’ উপর হয়)। এটি করতে হলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইন পরিবর্তন করতে হবে – ‘অলাভজনক’ থেকে ‘লাভজনক’ করতে হবেI আর যদি এটিকে ‘ভ্যাট’ বলা হয় – তাহলে সেটি যেই দেকনা কেন সেটি ছাত্রদের উপরেই বর্তাবে।
শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপের বিরোধীতা করার পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে টাকা আদায় করা নিয়ে রাজেশ কর্মকার প্রশ্ন তুলেছেন:
কিন্তু কিছু প্রশ্ন থেকে যায় এরপরও;
# বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যখন প্রতি বছর ১০ থেকে ২০ পারসেন্ট হারে কোর্স ফী বাড়ায় তখন কেন চুপ থাকি আমরা?
# এই ফী, সেই ফী, এটা সেটার নামে টাকা আদায় করে তখন কেন রাস্তা আটকাই না?
# চার বছরের কোর্সে বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে চার লাখ থেকে পনের লাখ টাকা পর্যন্ত লাগে। এত বিরাট ফারাক নিয়ে কোন কথা তুলিনা কেন? এটা কি একটা যৌক্তিক জায়গায় থাকতে পারেনা?

ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে সিলেটের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যোগ দিয়েছেন। ছবি তুলেছেন এইচ এম শহিদুল ইসলাম। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (১২/৯/২০১৫)।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভ্যাট প্রত্যাহার এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য টিউশন ফি নির্ধারণের নীতিমালা প্রণয়নের দাবিতে তিন দিনের ছাত্র ধর্মঘট ও অবস্থান কর্মসূচি দিয়েছে। এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিক সমিতিও ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
#NoVatOnEducation Protest of All Private University Students for Removing 7.5% Vat on Dhaka from Tomorrow 10 A.M Onwards!!
— Manik Farhan (@Manik_Farhan) September 12, 2015
শিক্ষার উপর থেকে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে আগামীকাল থেকে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র ধর্মঘট চলবে।
এর আগে ২০১০ সালেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ৪.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তা বাতিল করা হয়।
সর্বশেষ: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে মুখে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি’র ওপর আরোপিত ৭.৫% ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিয়েছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫, সোমবার সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। এরপরেই শিক্ষার্থীরা তাদের অবস্থান কর্মসূচি তুলে নেয়।