বাংলাদেশকে শিশুবান্ধব দেশে পরিণত করতে কয়েকটি উদ্যোগ

বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তাদের ওপরই দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। তাই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শিশুদেরকে বৈষম্য ছাড়াই সমতার সাথে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ছবি তুলেছেন মাহবুবুর রহমান খোকা। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (১০/১২/২০১৩)।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তাদের ওপরই দেশটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। তাই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শিশুদেরকে বৈষম্য ছাড়াই সমতার সাথে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ছবি তুলেছেন মাহবুবুর রহমান খোকা। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (১০/১২/২০১৩)।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ। দেশটিতে শিশুদের সংখ্যা ৬ কোটি ৩০ লাখ। যা মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ।

তবে এই বিপুল সংখ্যক অপ্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী অনেক কঠিন চ্যালেঙ্গের মোকাবেলা করে।

দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৪৫ লাখ। ৫ বছর পর্যন্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪০% অপুষ্টিতে ভুগে। দেশে প্রচুর বাল্য বিবাহ হয় এবং সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। গত সাড়ে তিন বছরে ৯৬৮ জন শিশুকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য ধরনের নির্যাতন তো আছেই।

ফলে পৃথিবীতে এমন দেশ পাওয়া বিরল যেখানে শিশুরা এত সমস্যার মধ্যে দিয়ে বড় হয়।

তবে বাংলাদেশকে শিশুবান্ধব দেশে পরিণত করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তার কয়েকটি রইলো এখানে:

স্কুল ব্যাগের বোঝা কমানো

আপনি যদি সকালবেলা বাংলাদেশের কোনো স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ান, তাহলে অসংখ্য ছেলেমেয়েকে বিশাল সাইজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যেতে দেখতে পাবেন।

ব্লগার টুটুল চৌধুরী তার ছেলে রিহানের ব্যপারে ফেসবুকে লিখেছেন:

গতকাল ঋহান বলে “বাবা এই ব্যাগটা আমি নিতে পারি না, অনেক ওজন… কাধের এইখানটায় ব্যাথা হয়ে যায়।”
এইটুকুন পিচ্চি একটা বাচ্চা ব্যাগের ভারে জর্জরীত। ছোট ছোট কোমলমতি শিশুদের ব্যাগে বহন করা একগাদা স্কুল/হোমওয়ার্কের চাপায় হারিয়ে ফেলছে তার আনন্দময় শিশুকাল।

আইন করে সকল স্কুলে জরুরী ভিত্তিতে সেই আইন বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

সম্প্রতি স্কুলগামী শিশুদের ব্যাগের ওজন কমানোর ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত। পাশাপাশি শিশুর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি নয়, এমন ওজনের ব্যাগ বহনের বিষয়ে আইন, নীতিমালা বা বিধিমালা প্রণয়নেরও নির্দেশ দিয়েছে।

দৈনিক প্রথম আলো’র সাংবাদিক শেখ সাবিহা আলম ঢাকার কয়েকটি স্কুল ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণি’র শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন মেপেছেন। সেখানে তিনি যে চিত্র পেয়েছেন, তাই তুলে ধরেছেন তার প্রতিবেদনে:

ওয়ারীর কিন্ডারগার্টেন স্কুলের এক ছাত্রের ব্যাগের ওজন ছিল সাড়ে চার কেজি। ইস্কাটনের একটি স্কুলের প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রের ব্যাগের ওজন পাওয়া যায় তিন কেজি। ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কে অবস্থিত একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া এক ছাত্রের ব্যাগের ওজন সাড়ে ছয় কেজি। নিউমার্কেট-সংলগ্ন একটি বিখ্যাত সরকারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রের ব্যাগের ওজন ছিল সাত কেজি। শেরেবাংলা নগরের একটি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীর ব্যাগের ওজন পাওয়া যায় সাড়ে সাত কেজি।

আদালতের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন নেট নাগরিকেরা।

ইমদাদুল হক ভারতেও এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন:

ভারতের মতো বাংলাদেশের স্কুলের বাচ্চারাও ইনজুরি প্রতিরোধে তাদের শারীরিক ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন করতে পারবে না।

শিক্ষার্থীদের সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ বাস করেন গ্রামে, নদীর খুব কাছাকাছিতে। ছোটবড় অসংখ্য নদী রয়েছে দেশজুড়ে। নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় সাতশ’র মতো। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নদ-নদী পানিতে ভরে উঠে। এসময়ে অনেক শিশুই পানিতে ডুবে মারাও যায়।

ইউনিসেফের তথ্য মতে, সাঁতার না জানার কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৮ হাজারের বেশি ছেলে-মেয়ে পানিতে ডুবে মারা যায়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে দেশের সব স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীকে সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক পরিপত্রের মাধ্যমে সরকার দেশের সব স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের জন্য সাঁতার শেখার ব্যবস্থা করতে বলেছে৷

সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংনীয় বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। এদের মধ্যে আছেন তিনটি অলিম্পিক সোনাজয়ী মার্কিন সাঁতারু নাথান অ্যাড্রিয়ানও। তিনি টুইটারে লিখেছেন:

সাঁতার জীবন বাঁচায়। মানুষজন এটা উপলদ্ধি করছে দেখে খুব ভালো লাগছে।

বিবিসি’র সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট ফারহানা হায়দার টুইট করেছেন:

বাংলাদেশে সাঁতার শিখতে আইন করা হচ্ছে। কেন না, সাঁতার না জানার কারণে প্রতিবছর ১৮ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।

পানিতে ডুবে মরার হাত থেকে বাঁচাতে ইউনিসেফ সুইমসেইফ প্রোগ্রাম চালু করেছে। ইউটিউবে তারা সাঁতার শেখার একটি ভিডিও শেয়ার করেছে:

প্রথমবারের মতো শিশু বাজেট

চলতি অর্থ বছর থেকে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিশু বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। আর এতে বরাদ্দ করা হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। যা জাতীয় বাজেটের ৮.৭৬ শতাংশ। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ২ লক্ষ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

এই শিশুদের বাজেট মূল বাজেটের থেকে আলাদা নয়। এটিকে এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে নীতিনির্ধারকরা বাজেটের অর্থ বরাদ্দের সময় শিশুদের অধিকারের দিকে খেয়াল রেখে তাদের গুরুত্ব দেন।

একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগের মাধ্যমে একটি বড় পদক্ষেপ? বাংলাদেশের শিশু বাজেট দেশের শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ রাখতে পারে।

শিশুদের জন্য আলাদা বাজেট কেন, সে প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বাজেট ভাষণে বলেছেন:

এটা প্রকৃত পক্ষে একটা কাঠামো, যা শিশুদের আর্থ-সামাজিক অধিকার বাস্তবায়নে সরকারি ব্যয়/বিনিয়োগের প্রকৃতি ও ব্যাপ্তিকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করবে; যার ফলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই মানবিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

শিশু অধিকার কাজ করেন এমন সংগঠনগুলো সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর আবদুল্লা আল মামুন দৈনিক প্রথম আলোর সাথে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন:

সরকারের এ ধরনের উদ্যোগের জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে শিশু বাজেট কে সমন্বয় করবে, বাজেট যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলো কি না তার জবাবদিহি কার কাছে থাকবে তাও নির্ধারণ করতে হবে।

নাবিলা মাহবুব টুইট করেছেন:

বাংলাদেশে শিশুদের অধিকার রক্ষা ও কল্যান নিশ্চিত করতে সামনের অর্থবছরে শিশুদের জন্য আলাদা বাজেট করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা, মনে হচ্ছে, এতদিনে দেশের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জীবন উন্নত করার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এসব উদ্যোগ আদৌ বাস্তবে রূপ নেবে কি না।

2 টি মন্তব্য

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .