গত ৭ আগস্ট শুক্রবার আনুমানিক দুপুর ১:৪৫ মিনিটে নিজ বাড়িতে খুন হয়েছেন ব্লগার নিলয় নীল। পাঁচজন আততায়ী ঘরে ঢুকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ সময়ে তার স্ত্রী এবং বোন বাঁচাতে গেলে আততায়ীরা তাদেরও হত্যার হুমকি দেয়।
গত ছয়মাসে বাংলাদেশে ৪ জন ব্লগার খুন হয়েছেন। নিলয় নীল এ তালিকায় চতুর্থজন। নিহত সব ব্লগারই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তারা রক্ষণশীল ধর্মীয় রাজনীতির সমালোচনা করে লেখালিখি করেছেন। এ কারণে ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা অনেক ব্লগারকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে।
Blood on floor of blogger Niloy Chakrabarti's home after he was hacked to death in Dhaka. (Credit: Getty Images) pic.twitter.com/pPB0QhT9zv
— Sara Yasin (@missyasin) August 7, 2015
ব্লগার নিলয় চক্রবর্তী খুন হওয়ার পরে তার বাড়ির রক্তাক্ত মেঝে।
সৌজন্যে: গেটি ইমেজেস
I am #Niloy_Nil. Stop killing in the name of religion.
— Tapas K. Baul (@Tkbaul) August 7, 2015
আমিই নিলয়_নীল। ধর্মের নামে হত্যা বন্ধ করুন।
নিহত ব্লগার ইস্টিশন ব্লগে নিলয় নীল নামে রাজনৈতিক ও নানা সামাজিক ইস্যু নিয়ে লেখালিখি করতেন। ২০১৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন বলে প্রবাসী ব্লগার আরিফ রহমান উল্লেখ করেছেন।
নিলয় নীল ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি গণজাগরণ মঞ্চের সপক্ষে লেখালিখি করতেন। উল্লেখ্য, ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়েছিল। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার ফেসবুকে লিখেছেন:
#NiloyNeel was writing for women rights, indigenous peoples, even for all other minorities. He was critic of religious extremism that provoked bombing in mosque and killing thousands of civilians.
He was one of the voice for Social Justice, secularism, human rights and loud for #AvijitRoy justice. He frequently got threatened by islamic militants those are trying to destroy this country by terrorism.
নিলয় নীল নারী অধিকার, আদিবাসী, এমনকি অন্যান্য সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়েও লিখতেন। তিনি ধর্মীয় কট্টরপন্থার কঠোর সমালোচক ছিলেন। ধর্মের নামে মসজিদে বোমা হামলা, হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে হত্যার বিরুদ্ধে তার কলম সরব ছিল।
তাছাড়া তিনি সামাজিক ন্যায়বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার এবং অভিজিৎ রায় হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। ইসলামী জঙ্গীরা তাকে কয়েকবার হত্যার হুমকিও দিয়েছিল।
রক্ষণশীল মৌলবাদীদের একটি দল এর আগে সরকারের বিশেষ কমিটির কাছে ৮৪ জন ব্লগারের একটি তালিকা হস্তান্তর করে। তালিকায় উল্লেখিত ব্লগারদের তারা “নাস্তিক” এবং ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে লিখছেন বলে অভিযোগ করে। মৌলবাদীদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার শাহবাগ আন্দোলন চলাকালে কিছু ওয়েবসাইট ব্লক এবং কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে। তাছাড়া ডানপন্থী ব্লগগুলোর পাশাপাশি মুলধারার কিছু পত্র-পত্রিকা ব্লগাররা নাস্তিক এই ধারনার পক্ষে প্রোপাগাণ্ডা চালায়। ধর্মবিরোধী লেখা লিখে ব্লগাররা বাংলাদেশের মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করা হয়। গত দুই বছরে এই তালিকার ১১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এই লিস্টে নিলয়ও ছিলেন।
নিলয় ফেসবুকেও সক্রিয় ছিলেন। সেখানে নানা রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে তিনি মতামত শেয়ার করেছেন। তিনি যে হুমকির সম্মুখীন হয়েছিলেন, তার বর্ণনাও দিয়েছেন। ২০১৫ সালের ১৫ মে তারিখে তিনি লিখেন:
আমাকে দুজন মানুষ অনুসরণ করেছে গত পরশু। ‘অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার’ প্রতিবাদে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে যোগদান শেষে আমার গন্তব্যে আসার পথে এই অনুসরণটা করা হয়।
এজন্য তিনি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে থানায় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, তা নিয়ে লিখেছেন:
First, a police officer told me personally that the police do not usually register such GDs since the officer who registers it will be accountable for ensuring security of the justice seeker. And if the person faces any problem, that police officer may even lose job for negligence in duties.
প্রথমেই এক পুলিশ অফিসার ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছিল যে, এই ধরনের জিডি পুলিশ নিতে চায় না। কারণ ব্যক্তির নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে যে কর্মকর্তা জিডি গ্রহণ করবে তার দায়িত্ব থাকবে সেই ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। আর যদি ওই ব্যক্তির কোনো সমস্যা হয়, সেইক্ষেত্রে ওই পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব অবহেলার জন্য চাকরি পর্যন্ত চলে যেতে পারে।
আর এ্রর পরেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিলয় ফেসবুক থেকে তার সব পোস্ট মুছে ফেলেন।
ব্লগার হত্যার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা লিখেছেন:
ব্লগার বা অনলাইন লেখকদের ‘নাস্তিক’ হিসেবে চিহ্নিত করে হত্যা করা হচ্ছে। এই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া মানে ‘নাস্তিক’ হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। নাস্তিকদের যারা হত্যা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া মানে নাস্তিকদের পক্ষ নেয়া। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এরকমই। সরকার বক্তব্যে কোনো রাখঢাক নেই। স্পষ্ট বক্তব্য ‘আমরা নাস্তিক হিসেবে পরিচিত হতে চাই না।’
বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের সংগঠন হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের টার্গেট করেছে। তারা ধর্মে বিশ্বাস করেন না এমন ব্লগারদের ফাঁসি দাবিও জানিয়েছেন। তাছাড়া সংগঠনটি নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করার অধিকারের বিপক্ষেও সোচ্চার।
কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর ফেসবুকে লিখেছেন:
৮৪ জন কেন ৮৪০০ ব্লগারের জীবনের চেয়েও সরকার যে নাস্তিকদের সমর্থক নয় সেটার প্রমান দেওয়া জরুরী। ৮৪ জন ব্লগারের জীবনের বিনিময়েও যদি হাটহাজারীর হেফাজতওয়ালারা খুশি থাকে, সরকারকে হেফাজতে রাখে- সেটিই বরং দরকার।
আশ্চর্য! হাসপাতালের মর্গে একেকটা লাশ যেমন একেকটা নাম্বার, মানে সংখ্যা মাত্র।একেকজন ব্লগারও যেন কেবল নাস্তিক মাত্র। তারা রাষ্ট্রের নাগরিকক নন- কাজেই রাষ্ট্রের কোনো প্রটেকশন তারা পান না, তারা মানুষ নন- তাদের কোনো মানবাধিকার নেই। আর হ্যাঁ, খুন হয়ে যাওয়া ‘ব্লগারটি’ নাস্তিক ছিলেন- এই কথাটি একবার মুখ দিয়ে বের করা গেলে, সেটি প্রচারে হেফাজত আর সরকারের সমর্থকরাও একাকার হয়ে যান।'ব্লগার নামধারী নাস্তিকরা দেশের স্থিতিশীলতা নষ্টের চক্রান্তে লিপ্ত, সরকারকে বিব্রত করতে চায়’- নিকট অতীতে কোনো কোনো এমপিকেওতো এমন কথা বলতে শুনেছি।
আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্ট জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ব্লগারদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন:
রাস্তায় প্রতিবাদ করা ছাড়া আর কোন কাজে ব্লগারদের একাট্টা হওয়ার কোন ঘটনা এপর্যন্ত ঘটেনি। এটাই ব্লগারদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। একটি সংগঠিত দল বা গোষ্ঠী না হওয়া সত্ত্বেও তারা দল বা গোষ্ঠী হিসেবে টার্গেট।
তাই সংগঠিত হোন- নয়ত বাঁচবেন না। প্ল্যাটফর্ম তৈরি করুন। প্রতিরোধ করতে শিখুন। প্রতিবাদে কাজ হবে না। দেশে আইনের শাসন নেই, তাই চেঁচিয়ে লাভ হবে না।
সংবাদ মাধ্যমে তথ্য অনুসারে, আল্লাহ’র শত্রু আখ্যা দিয়ে ব্লগার নিলয় নীল হত্যার দায় স্বীকার করেছে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, খুনীরা যখন নিলয়ের বাসা থেকে বের হয়, তখন আল্লাহু আকবর বলে স্লোগান দেয়।
মিডিয়ার কাছে পাঠানো ইমেইলে বলা হয়েছে, “আলহামদুলিল্লাহ! আনসার আল ইসলাম (আল কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ, বাংলাদেশ শাখা) এর মুজাহিদিনরা হামলা চালিয়ে আল্লাহ তা’য়ালা এবং তাঁর রাসুলের (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) দুশমন নিলয় চৌধুরী নীলকে হত্যা করেছে।”
এদিকে ওইদিন (শুক্রবার) অন্য একটি ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের নেতা মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীকে পুলিশ আটক করেছে। তিনি চট্টগ্রাম ভিত্তিক ইসলামপন্থী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর। একই সঙ্গে ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। হেফাজতে ইসলামের অন্যতম মূল এজেন্ডা হলো, বাংলাদেশে ধর্মে অবিশ্বাসী ব্লগারদের ফাঁসির দাবি কার্যকরে ভুমিকা রাখা। যদিও বাংলাদেশে অন্যান্য নাগরিকদের মতোই ধর্মে অবিশ্বাসীদেরও সমান অধিকার রয়েছে।
গত মে মাসে গ্লোবাল ভয়েসেস একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের সরকারের প্রতি সকল ব্লগারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার আহবান জানানো হয়। নিলয় হত্যার ঘণ্টাখানেক পরেই কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। আরো অনেক ব্লগার ও মানবাধিকার কর্মীদের মতো আজকে তাদেরও জিজ্ঞাসা:
How many more bloggers must be murdered before the government of Prime Minister Sheikh Hasina acts decisively to stem the violence and impunity?
এই ভয়ংকর আর বর্বরতার অবসান ঘটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নিশ্চিত পদক্ষেপ নেয়ার আগ পর্যন্ত আর কতজন ব্লগারকে এভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হবে?