মাদক পাচারের দায়ে ইন্দোনেশিয়াতে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদন্ডের সারিতে সামিল হওয়ার গল্প বললেন একজন ফিলিপিনো নারী

Mary Jane (right) is reunited with her mother (left) during a prison visit in 2013. Photo from Migrante

২০১৩ সালের এক কারাগারে সাক্ষাতের সময় ম্যারি জেন (ডানে) তাঁর মায়ের (বামে) সাথে। মাইগ্রানটে থেকে পাওয়া ছবি।

মাদক পাচারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ইন্দোনেশিয়াতে একজন ফিলিপিনো কর্মীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করা হয়েছে। তাঁর কারাগারে পৌঁছার ঘটনা এক করুন গল্পের জন্ম দিয়েছে।

বিমান কর্তৃপক্ষ ম্যারি জেন ভেলোসোর মালামালের ভিতর ২ দশমিক ৬ কেজি হেরোইন খুঁজে পাওয়ার পর ইন্দোনেশিয়াতে ২০১০ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। ইন্দোনেশিয়ার সুপ্রিম কোর্ট তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। তিনি বলেছেন, স্যুটকেসের ভিতর কি ছিল তা না জেনেই তিনি সেটি সাথে নিতে রাজী হন।

গত পাঁচ বছর ধরে তাঁর জীবনের গল্পটি ফিলিপাইনের সংবাদ মাধ্যমের তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করতে না পারলেও একটি অভিবাসী গোষ্ঠী যখন তাঁর মামলাটি পুনরায় পর্যালোচনার জন্য আপিল করে এবং একটি বৈশ্বিক গোষ্ঠী যখন ইন্দোনেশিয়াকে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত সকল ধরণের মামলার ক্ষেত্রে মৃত্যদন্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত পুনরায় বিবেচনা করতে জোরালো সুপারিশ জানায়, তখন এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়।

ম্যারি জেনের মামলার হস্তলিখিত বর্ণনার একটি আক্ষরিক প্রতিলিপি তাঁর বোন শেয়ার করেছেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তিনি ২০১০ সালে তাঁর বোনের দেশ ছেড়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেনঃ

আমি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে কাজ করি। আমি এখানে একজন কর্মচারি হিসেবে আছি এবং দুই বছরের চুক্তিতে আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে আমি সেখানে ১০ মাস ধরে আছি। কারণ সেখানে আমাকে একজন ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে। তাই ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৯ তারিখে আমি ফিলিপাইনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিই। আমি আমার দেশে ফিরে এসেছি, তবে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ নিয়ে ফিরতে পারিনি। আমার ছেলে ইতোমধ্যেই বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করেছে… তাই আমাকে আবার কাজের সন্ধানে বের হতে হয়েছে…

তাঁর প্রতিবেশী ক্রিস্টিনো তাকে মালয়েশিয়াতে কাজ জোগাড় করে দিবে বলে কথা দিয়েছিল। তবে ক্রিস্টিনো এবং ম্যারি জেন যখন মালয়েশিয়াতে এলেন, তখন ম্যারি জেনকে বলা হয়, সে কাজে যোগ দেয়ার আগে তাকে ইন্দোনেশিয়াতে একজনের সাথে দেখা করে আসতে হবেঃ

তিনি আমাকে সাত দিনের ছুটিতে ইন্দোনেশিয়াতে যেতে এবং একজন বন্ধুর সাথে দেখা করতে বলেন। আরও বলেন, আমি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ফিরে আসলেই আমার কাজে যোগ দিতে পারব।

তাই আমার কোন উপায় ছিল না। আমাকে সেখানে যেতে হয়েছে এবং সেই সময়ে আমার নিজের বলে কিছু ছিল না… আমি যদি তখন ইন্দোনেশিয়াতে না যেতাম তবে আমি কাজ পেতাম না, তাই আমার বাচ্চার জন্য আমার সেখানে যাওয়া জরুরী ছিল…

তাঁর মালামালে মাদকদ্রব্য খুঁজে পাওয়ার কারণে ইন্দোনেশিয়াতে তাকে বিমান কর্তৃপক্ষ আটক করে। তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল এমনঃ

আমার সারা শরীর একেবারে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল… আমি তখন কিছুই বলতে পারিনি… অঝোরে কান্না ছাড়া আমার কিছুই করার ছিল না!!! কারণ আমি জেনেছি যে আমি এখানেই শেষ। কারণ মাদকদ্রব্য একেবারেই অবৈধ জিনিস… কেন আমি ক্রিস্টিনোকে বিশ্বাস করলাম, তাঁর জন্য নিজেকেই নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলাম… তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করার কোন কারণ আমার ছিল না… আর আজ আমি এখানে… তবে আমি এসবের কিছুই জানতাম না।

এই ভিডিওটিতে ম্যারি জেনের পরিবারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। তারা এটাই বলেছেন যে তিনি কাজের সন্ধানে দেশ ছেড়েছেন, মাদক দ্রব্য চোরাচালানের জন্য নয়ঃ

তাঁর গল্প জানার পর এবং তাঁর মামলাটি তদন্ত করে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা গোষ্ঠীটি মনে করে যে ম্যারি জেন মানব পাচারের শিকার। আর তাই তারা ইন্দোনেশিয়ার সরকারের কাছে তাঁর মামলাটি পুনর্বিবেচনা করতে আবেদন জানিয়েছে। তারা ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে এই চিঠিটি পাঠিয়েছেঃ

আমরা বিশ্বাস করি যে একটি বিরাট মাদক দ্রব্য সিন্ডিকেটের শিকার হয়েছেন ম্যারি জেন। সিন্ডিকেটটি তাঁর অসচেতনতা, দোদুল্যমান অবস্থা এবং হতাশ হয়ে আমাদের লোকজনের মরিয়া হয়ে যাওয়ার সুযোগ নিয়েছে। আমাদের যতোটা বলা হয়েছে, সত্যিকার অর্থে মাদক পাচারকারীদের বেশ বড় এক চালক এবং সিণ্ডিকেট যখন বহাল অবস্থায় তাদের পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তখন ম্যারি জেনের মতো অসহায় মহিলাকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেয়া হচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল এ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্র্যাটিক ল’ইয়ারস নামের জাতিসংঘের অধীনস্থ একটি গ্রুপও মনে করে যে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ম্যারি জেনের বিচার কাজ পরিচালনা করা হয়নি। কেননা অবিলম্বে তাঁর জন্য আইনানুগ প্রতিনিধি এবং পেশাদার অনুবাদক নিয়োগ দেয়া হয়নিঃ

মিস ভেলোসোকে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে তাঁর দেশের বাইরে কাজের সন্ধানে যেতে হয়েছে। ইন্দোনেশিয়াতে হিরোইন পাচার করার উদ্দেশ্যে তিনি দেশ ছাড়েননি। দেশটিতে পৌঁছানোর পর তাকে কেবল চোরাচালান পাচার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, এরপর তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল কাজের সন্ধান করা। মিস ভেলোসোকে যথেষ্ট পরিমাণ আইনি সহায়তা অথবা অনুবাদকের সহায়তা নেয়ার অধিকার এবং তাদের বিচারকার্যের সকল স্তরে তাঁর জন্য বৈধ প্রতিনিধি সহায়তা প্রদান করা হয়নি।

Mary Jane's parents appeal for clemency during a visit to the Indonesian Embassy in Manila. Photo from Facebook

ম্যানিলাতে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ান দূতাবাসে গিয়ে সাক্ষাতের সময় ম্যারি জেনের অভিভাবক সহানুভূতির জন্য আকুল আবেদন করেছেন।

তবে মাদক সংক্রান্ত অপরাধের জন্য প্রদত্ত মৃত্যুদন্ডাদেশ পুনরায় বিবেচনা করার জন্য করা সকল আবেদন ইন্দোনেশিয়া ফিরিয়ে দিয়েছে। দেশটি বলেছে, মাদক চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এই চোরাচালানকারীরা ইন্দোনেশিয়াকে তাদের অন্যতম এক মাদকদ্রব্য পাচারের কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
এরপর সমগ্র বিশ্বজুড়ে ফিলিপিনো অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন গ্রুপ, বিভিন্ন মানবাধিকার আইনজীবী এবং ইন্দোনেশিয়ার সুশীল সমাজের কয়েকজন সদস্য ম্যারি জেনের জীবন বাঁচাতে প্রচেষ্টা চালাতে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছেন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .