গত ১৪ এপ্রিল ২০১৫ বাংলাদেশের ঢাকায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে বেশ কয়েকজন নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। দলবদ্ধভাবে যৌন আক্রমণের ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তবে এখন পর্যন্ত পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
নারীর উপর যৌন নিপীড়ন বাংলাদেশে নতুন নয়। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বাংলাদেশে জানুয়ারি-মার্চ ২০১৫ সময়কালের মধ্যে সংঘটিত নারী নিপীড়ন পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে। সেই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এই সময়কালের মধ্যে ৪০ জন নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে দুইজন আত্মহত্যা করেছেন। আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১২৩টি। ১৫ জন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া ধর্ষিত নারীদের ২১ জনের বয়স ৭-১২ বছর।
তবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে দলবদ্ধভাবে যৌন আক্রমণের ঘটনা (৩০-৪০ জন যুবক কর্তৃক ২০ জন নারীর অবমাননা) এবারই প্রথম।
এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলা ব্লগ সচলায়তন বাংলাদেশে নারীদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পহেলা বৈশাখে নারীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ‘নারী সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা দেয়। আর ‘নারী সপ্তাহ’ পালন উপলক্ষ্যে সবার কাছে নারীর ওপর যৌন ও অন্যান্য নির্যাতন বিষয়ক লেখা আহ্বান করে। সে আহবানে সাড়া দিয়ে অনেক নারীই তাদের ওপর হওয়া যৌন বা অন্যান্য নির্যাতন এবং নানা প্রতিকূলতা ভেদ করে উঠে আসার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।
একেবারে ছোটবেলা থেকেই যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। আর সেই আক্রমণ আসে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেই। নন্দিনী তিলোত্তমা লিখেছেন:
এক মামা আসতো বাসায়। ৯/১০ বছর বয়সের সময় একদিন একটা ঘরে আমাকে চেপে ধরে আদর করতে যেয়ে ঠোঁটে চুমু খায়। আমি জোর করে ছাড়িয়ে চলে আসি। কিন্তু এরপর থেকে বাড়িতে এলেই সে সুযোগ খুঁজে নিয়ে অমনটা করার চেষ্টা করতো।
একজন অতিথি লেখকও পারিবারিক পরিমণ্ডলে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা লিখেছেন:
আমার বয়স যখন চার বছর। আমি আমার তেইশ বছরের (আন্দাজ) কাজিনের যৌন লালসার শিকার হই। লোকটির যৌনাঙ্গ আমার শিশু যোনীতে প্রবেশ করেনি। কিন্তু স্পর্শ করেছে, একই সময়ে একের অধিকবার।
স্কুল কিংবা কোচিং-এও অনেক নারী শিক্ষার্থী যৌন নিপীড়নের শিকার হন। ফেরিওয়ালা ও লেভেল পড়ার সময়কালীন তার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন:
সেদিন প্রাইভেট ক্লাসে স্যার এসে একগাদা হাবি-যাবি কথা বলতে বলতে এক ফাঁকে আমাকে বললো উনার কোলে উঠে বসতে। তাহলে নাকি উনার কথা বুঝতে সুবিধা হবে, মিন মিন করে আমি বললাম এখানেই ঠিক আছি। একটু পরে নানা কথার ফাঁকে আরও ২-৩ বার একই কথা বললো। আমি আর কোনো উত্তর দিলাম না।
আফরোজ কর্মক্ষেত্রে নারী হিসেবে তার মা কী ধরনের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গেছেন, সেটা তুলে ধরেছেন:
ডিভোর্সি হবার কারণে কলিগ/ইন্সট্রাক্টর/ম্যানেজার অনেকেই বিভিন্নরকম বাজে ইঙ্গিত দিত। কেউ কেউ চাইতেন আম্মা তাদের সাথে ফোনে কথা বলুক কিংবা ঘুরতে যাক। এদের মধ্যে একজন একটা সাহায্যের বিনিময়ে আম্মাকে রীতিমতো পার্মানেন্ট মিস্ট্রেস হবার প্রস্তাব করেছিলেন। …
আফরোজ নিজেও একটি এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু হিসেবে যে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেটাও তার পোস্টে তুলে ধরেছেন।
এক সহকর্মী লুকিয়ে ভিডিও করে তাকে কেমন লাঞ্চনার মুখে ফেলে দিয়েছিল দস্যি জানিয়েছেন সে কথা:
স্বনামধন্য পারটেক্স ফার্নিচার লিমিটেড এ চাকরি নিলাম। সেখানকার এক কর্মচারী আমাকে লুকিয়ে আমার একটা ভিডিও করলো। সব শোরুমে সবার মোবাইল এ সেই ভিডিও। জানতে পারলাম, অভিযোগ করলাম। লোকটা ছিল সামান্য লেকার পলিশার। কিন্তু জন্মেছিল তো পুরুষ হয়ে! তাই আমার অভিযোগ টিকলো না।
মাতৃত্বের দায় মেটাতে গিয়ে নারী কীভাবে কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে যায়, তাই তুলে ধরেছেন ব্লগার বুনোহাঁস:
আমাদের দেশে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাট চুকতে বয়স পঁচিশ হয়ে যায়। চাকরি খুঁজে ক্যারিয়ার গড়তে গড়তে ত্রিশ। এদিকে প্রকৃতিগত হিসেব কষে নারীকে ত্রিশের আগেই সন্তান ধারণ করতে বলা হয়। তাই বিয়ের হুড়ো লেগে যায় পাশ করতে না করতেই। এরপর আসে সন্তান নেওয়ার তাড়া। সন্তান একবার এসে গেলে তার প্রতিপালনের দায়ও নারীর ওপর বর্তায়। প্রকৃতি, পরিবার ও সমাজের চাহিদা মেটাতে গিয়ে হাতে গোনা কজন নারী হয়ত কাজের বাজারে ঠাঁই করে নিতে পারে। তুলনামূলকভাবে কম সুবিধা ও সৌভাগ্যের অধিকারী নারীরা পিছিয়ে পড়ে কিংবা ঝরে পড়ে।
আনিকা আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নেমেছেন। ব্যবসা করতে এসে নারী হিসেবে তিনি যেসব প্রতিবন্ধকতা সম্মুখীন হয়েছেন, তাই তুলে ধরেছেন তার লেখায়:
কাজ শুরু করার পর থেকে একটু একটু করে নানা রকমের অদ্ভুত বিপত্তির সম্মুখীন হতে থাকলাম। পরিবারের ভিতরেও প্রথমে কেমন একটা ভাগাভাগি তৈরি হয়ে গেল, যদিও আমার বাবাকে বাদ দিয়ে ভাই-বোন কিংবা মা এই ব্যাপারে সমর্থন দিয়ে এসেছে একদম গোড়া থেকেই। আপত্তি এসেছে মূলত extended family থেকে। আর যারা আপত্তি করছিলেন তাদের বেশিরভাগেরই আপত্তির বিষয়বস্তু ছিলো, ‘তুমি মেয়ে হয়ে ব্যবসা করবে?’
সচলায়তনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও কলম ধরেছেন। ব্লগার হাসিব কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নারী-পুরুষের বৈষম্য বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি বাংলাদেশের সবচে’ জনপ্রিয় চাকরি বিষয়ক ওয়েবসাইট বিডিজবস থেকে ডেটা নিয়ে অ্যানালাইসিস করে দেখিয়েছেন:
পুরুষদের জন্য চাকরিতে ২০% এর মতো পদ বরাদ্দ থাকে। নারীদের থাকে ৩-৪%। অর্থাৎ কার্যত পুরুষদের জন্য দেশে ২০% কোটা সংরক্ষিত ও নারীদের জন্য এটা ৩/৪%।