বক্ষ বিভাজন ও নির্বাচনী নীতির মধ্যে একে অন্যের সাথে কী সম্পর্ক আছে? হয়তো আপতদৃষ্টিতে যা দেখা যায় তার থেকে আরও বেশী কিছু।
চীনের মূলভূখণ্ডে যখন দর্শকরা চীন দেশের সম্রাজ্ঞী নামের এই জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক নাটক দেখে, তখন তারা নারী শিল্পীদের বক্ষ বিভাজন দেখতে পায় না, যেমনটি উপরের ছবির প্রথম অংশে দেখানো হয়েছে। বিষয়গুলোকে ‘শালীন’ রাখার জন্য সেন্সর করে ছবিগুলোকে এমনভাবে কর্তন করা হয়েছে যে দর্শকরা নারীদের গলার নীচে খুব সামান্য অংশ পর্যন্ত দেখতে পায়।
এই অনুষ্ঠানটি বর্তমানে হংকং-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় বানিজ্যিক টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে। ত্বক প্রদর্শন করা মূল সংস্করণ ও কর্তন করা সংস্করণের কোনটিই চয়ন না করে হংকং টেলিভিশন সম্প্রচার (টিভিবি) নাটকটির সম্পাদনা করে অভিনেত্রীদের বক্ষ বিভাজন ঢেকে দেবার একটি সুক্ষ্ম প্রচেষ্টায় ট্যাং সাম্রাজ্যের আদি পরিচ্ছেদের উপর ডিজিটালভাবে এক টুকরো কাপড় জুড়ে দিতে ১৫০ লক্ষ হংকং ডলার (প্রায় ২০ লক্ ইউএস ডলার) খরচ করেছে (উপরের ছবির শেষ ফ্রেমটি দেখুন) ।
সকল চৈনিকভাষী সমাজের মধ্যে এখন শুধুমাত্র তাইয়ান চীন দেশের সম্রাজ্ঞীর সেন্সর না করা সংস্করণটি সম্প্রচার করবে।
চীনের টেলিভিশনের ইতিহাসে যে কোন ধারাবাহিক নাটকের চেয়ে এই অনুষ্ঠানটির নির্মাণ বাজেট সর্ব বৃহৎ এবং চীনের ইতিহাসের একমাত্র জানা সম্রাজ্ঞী উ জেটিআন-এর ভূমিকায় তারকা হিসেবে অভিনয় করেছে মহা-খ্যাতিমান অভিনেত্রী ফ্যান বিংবিং। এটিকে পুনসম্পাদনা করতে উঠিয়ে নেবার আগে ডিসেম্বরের ২১ তারিখ পর্যন্ত সর্বপ্রথম হুনান স্যাটেলাইট টিভিতে সম্প্রচারিত করা হয়। জানুয়ারী মাসের ১ তারিখে আসা নতুন সংস্করণটি অভিনেত্রীদের বক্ষ বিভাজন ঢাকার জন্য অপরিপক্কভাবে কর্তন করা হয়েছে। বার্তা, প্রকাশনা, বেতার, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যাখ্যা দিয়েছে যে এই নাটকটিতে ‘অরুচিকর ছবি’ বিদ্যমান রয়েছে।
এই সেন্সর করার ফলে ধারাবাহিকের লং শটগুলোর প্রেক্ষাপটে চমৎকার সব প্রাসাদের ছবি দিয়ে বিকৃত করা হয়েছে যেহেতু তারা অভিনেত্রীদের মুখমণ্ডলের ক্লোজআপ দেখাতে গিয়ে ফ্রেমটিকে সংকীর্ণ করে ফেলেছে। ৩০ কোটি ইউয়ানে (৪৮০ লক্ষ ডলার) নির্মীত নাটক যার মধ্যে ট্যাং সাম্রাজ্যের পোষাক শৈলী যথাযথভাবে ধারণ করতে যত্নশীলভাবে তৈরী করা ৩,০০০-এরও বেশী পোষাক ছিল তার পুরোটাই এভাবে জলে গেলো বলে চৈনিক টেলিভিশন প্রেমীরা ক্ষিপ্ত হয়েছিল।
যদিও হংকং-এ এমন কোন আইন নেই যাতে টেলিভিশনে বক্ষ বিভাজন দেখানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তারপরও টিভিবি মূলভুখণ্ডের সূত্র ধরেই এই অনুমিত সমস্যার এই অনন্য ডিজিটাল সমাধান গ্রহণ করেছে। এই সম্পাদনা এতোই সুক্ষ্ম যে সাধারণ জনগণ বুঝতেই পারবে না যে এগুলোকে নির্মাণ-পরবর্তী সময়ে সম্পাদনা করা হয়েছে।
উপরের ছবিটি টিভিবি এর ব্যয়বহুল সেন্সর কাজ আর ২০১৭ সালে তাদের ভোট দেবার অধিকার-এর পরিবর্তে জনগণকে শহরের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়নে তাদের অধিকার ত্যাগ করায় প্ররোচিত করতে হংকং সরকারের চাপ এর মধ্যে একটি তুলনা করে। এই ছবিটি এটাই নির্দেশ করে যে টিভিবি এবং সরকার উভয়ই বেইজিং এর নির্দেশে আত্ম-সেন্সর করছে ও স্ব-সীমিত হচ্ছে।
ফেসবুক ও ইউটিউব-এর ভিত্তি করে একটি নাগরিক মাধ্যম কেন্দ্র দ্যা আর্ম চ্যানেল টিভি, এই ছবিটি প্রকাশ করেছে যেখানে চীন দেশের সম্রাজ্ঞীর তিনটি সংস্করণ দেখানো হয়েছে –উপরেই রয়েছে মূল অসেন্সরকৃত সংস্করণ, তার নীচেই চীনের কর্তন করা সংস্করণ, এবং পরিশেষে হংকং-এর সম্পাদনা করা অংশ যার শিরোনাম হলো ‘সর্বাগ্রে-পকেটস্থ-করুন'।
‘সর্বাগ্রে-পকেটস্থ-করুন’ মানে ‘যা পাওয়া যাচ্ছে তাই নিয়ে নিন’ হলো হংকং সরকারের ব্যবহার করা একটি রাজনৈতিক বুলি যা তারা একটি নির্বাচনী সংস্কার প্যাকেজ-এর প্রসারের জন্য ব্যবহার করেছে, যেটিতে ১,২০০ সদস্যের মনোনয়ন পরিষদের কাছে মেয়র প্রার্থী মনোনয়নের অধিকার সীমিত করা হয়েছে। এই ছবিটি অনলাইনে ব্যাপক ছড়িয়ে পড়েছে, এবং মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ছবিটি ৬,০০০ লাইক পেয়েছে এবং এটিকে ৮০০ বার শেয়ার করা হয়ছে।
২০১৪ সালের আগষ্টে জারি করা বর্তমান নির্বাচনী প্রস্তাবনা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে যে প্রধান নির্বাহীদেরকে অবশ্যই মনোনয়ন কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে, এবং প্রার্থীর মোট সংখ্যা ৩-এর কম হতে হবে। বেইজিং-ঘেসা রাজনীতিক এবং হংকং সরকার উভয়ই জনগণকে বলেছে যে তারা এই প্রস্তাবনা গ্রহণ করতে পারে অন্যথায় তারা তাদের ভোট দেবার অধিকারই পুরোপুরিই হারাবে।
প্যান ডেমোক্রাটরা বিধান পরিষদে তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করার অঙ্গীকার করেছে, কারণ প্রার্থীদেরকে এখন মনোনয়ন কমিটির কাছ থেকে প্রায় ৬০০ ভোট পেতে হবে, যার পূর্বের কোটা ছিল ১৫০। এছাড়াও যেহেতু সরকার বারবার বলছে যে ৩১শে আগষ্টের নিরূপণের জন্য আর কোন বিকল্প নেই ফলে ‘সর্বাগ্রে-পকেটস্থ-করুন’ হয়ে দাঁড়াবে ‘চিরকালের-জন্য-পকেটস্থ-করুন’।
বিগত কয়েক দিন ধরে, এমনভাবে নির্বাচনী সংস্কার প্যাকেজ উপস্থাপন করার জন্য শীর্ষ সরকারী কর্মকর্তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোকে পরিদর্শন করেছে যেন মনে হয় এটি সত্যিকারভাবেই সার্বজনীন ভোটাধিকারের প্রতিনিধিত্ব করে। প্যান-ডেমক্র্যাটরা এই পরিদর্শনগুলোর সমালোচনা করেছে এই বলে যে এগুলো জনগণকে ধোঁকা দেবার উদ্দেশ্য একটি রাজনৈতিক তামাশা। স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সম্পদিত বেশ কয়েকটি মতামত জরীপে দেখা গেছে যে প্রায় ৪৭% উত্তরদানকারী সরকারের এই নির্বাচনী প্রস্তাবনার সমর্থন করেছে যেখানে ৩৮% এর বিরোধীতা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী বেশীরভাগ উত্তরদাতাই এই নিবার্চনী প্রস্তাবনার বিরোধীতা করেছে।
ঐতিহাসিক নাটকের সম্প্রচার শুরু হবার সময় যখন রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ হলো তখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা সরকারের রাজনৈতিক চরকী ঘুরানোর কায়দার সাথে টিভি কোম্পানীগুলোর সত্যিকারের বক্ষ বিভাজনের সেন্সর করাকে তুলনা করেছে – এদের উভয়ই ব্যয়বহুল, অপ্রয়োজনীয়, কৃত্রিম এবং বেইজিং-এর রাজনৈতিক ইচ্ছার বশবর্তী।