তাজিকিস্তানে ইসলাম ধর্মের রীতি-নীতি পালন দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। যদিও দেশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু দেশটির সোভিয়েত পরবর্তী সময়ের নেতাদের কাছে ধর্মের নতুন “অ-ঐতিহ্যবাহী” রূপ ক্রমশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে।
বর্তমান সরকারের ইচ্ছে হলো, সাবেক সোভিয়েত আমলে ইসলাম ধর্মের অনুশীলন যেভাবে ছিল সেভাবেই রাখা। সেসময়ে ধর্মকর্ম ঘরের ভিতরেই পালন করতে হতো। বাইরে করা যেত না। সম্প্রতি রাষ্ট্র হিজাব, দাড়ি, ‘মদ্যপান নিষেধ’ লেখা হোটেল, হজ্জ্ব পালন-সহ ব্যক্তির নামের সাথে ধর্মীয় অংশ যুক্ত(প্রত্যয়) করার বিরুদ্ধে গোপনে অভিযান পরিচালনা করছে। তবে তাজিকিস্তানের তরুণ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা সরকারের এমন কাযক্রম নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করার সাথে সাথে অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করেছেন।
ইরান ও আফগান রীতির পোশাক নয়
দীর্ঘদিন ধরেই তাজিকিস্তানের স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি অফিসে হিজাব নিষিদ্ধ। তবে এখন আর একে দিনের আলোতে দেখা যাবে না।যদিও ইসলামী প্রথা অনুযায়ী ঘরে নয়, বাইরে হিজাব পরাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
হিজাব পরার উপরে প্রথম চাপ আসে মা দিবসের পরে (তাজিকিস্তান আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে মা দিবস হিসেবে পালন করে)। সেদিন নারীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে দেশটির রাষ্ট্রপতি ইমোমালি রাখমোন বিদেশি হিজাব পরার পরিবর্তে বর্ণবৈচিত্র্যময় জাতীয় পোশাক পরার জন্য নারীদের প্রতি আহ্বান জানান।
তাজিক কর্তৃপক্ষ একে বার্তা হিসেবে গ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পরেই তাজিক স্টেট টিভি হিজাব পরা ও বেশ্যাবৃত্তির মধ্যে একটি অবাস্তব যোগসূত্র বের করে। অন্যদিকে তাজিকিস্তানের রাজধানী শহর দুশানবের মেয়র নগর কর্তৃপক্ষের জন্য একটি আদেশ জারি করেন, যেখানে নারীদের ‘চরমপন্থা’ থেকে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খুজান্দের মেয়রও “ইরান ও আফগানের” পোশাক বিক্রি বন্ধ এবং পুলিশ ও ট্যাক্স কর্তৃপক্ষকে যেসব দোকানে ইসলামিক পোশাক বিক্রি হয় সেগুলো পরিদর্শনে যাওয়ার আহ্বান জানান।
সরকারের হিজাব খুঁজে বের করা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে কয়েকশ মন্তব্য পড়েছে। অনেকে দুশানবের তেহরান কিংবা কাবুল হওয়ার বিরোধীতা করেছেন। বেশিরভাগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হওয়ায় কর্তৃপক্ষের নিন্দা করেছেন।
‘আরবীয় রীতি'র দাড়ি নয়
সম্প্রতি খুজান্দ বাইরের উপস্থিতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি করেছে। গত ৩১ মার্চে একজন পর্যটক খুজান্দে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেন। তখন তিনি রাস্তা খুঁজে পেতে স্থানীয় পুলিশের শরণাপন্ন হন। ৩৮ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির মুখে দাড়ি ছিল। তিনি পাঁচ বছর আগে হজ্জ্ব করতে গিয়েছিলেন, তখন থেকেই দাড়ি রাখছেন।কিন্তু পুলিশের কাছে যাওয়াটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি অভিযোগ করেছেন, সেখান থেকে তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে মারপিট করা হয়। পরে জোর করে তার দাড়ি কেটে দেয়। রেডিও ওযোডি খুজান্দের ওই থানায় যোগাযোগ করে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেখানকার পুলিশ প্রধান মারপিট করার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন:
“…вале агар ин одам намуди зоҳириашро ба шакли арабӣ карда бошаду як метр риш монда бошад, ҷомеаи мо исломӣ нест ва қабул надорад”
…তবে ওই লোক যদি আরব রীতিতে দাড়ি রাখে এবং তা যদি এক মিটার লম্বা হয়, আমাদের সমাজ ইসলামিক নয় এবং তারা সেটা গ্রহণ করে নিবে না।
এ ঘটনার দুইদিন পরে এপ্রিলের দুই তারিখে পুলিশ জনপ্রিয় ব্লগার ব্লগিস্টন.টিজে-এর প্রতিষ্ঠাতা রুস্তম গুলভের দাড়িও কেটে দেয়।
Вот и до меня добрались …Сегодня не с того, ни с сего, отвезли трое “оперативников” в худжандский отдел милиции и принудительно побрили бороду. У этой страны нет будущего!
তারা আমার সাথেও একই ঘটনা ঘটিয়েছে… তিনজন পুলিশ আজকে আমাকে খুজান্দ থানায় ধরে নিয়ে যায়। তারপর জোর করে আমার দাড়ি কেটে দেয়। এই দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই!
পুলিশ স্টেশনের বিনামূল্যের নাপিতগিরি গুলাভের পছন্দ হয়নি। তাই তিনি তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ করে খোলা চিঠি দিয়েছেন।
তবে বিষয়টি নিয়ে মজা করতে ছাড়েনি তাজিকিস্তানের নেটিজেনরা। তারা জাতীয় মুদ্রার ওপর খোদাই করা ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর দাড়ি ফেলে দিয়ে মিম বানিয়েছেন, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হচ্ছে। গ্লোবাল ভয়েসেস তাজিক আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে মিম থেকে বাক্যগুলো মুছে দিয়েছে। মিমে তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি অপমানকর বাক্য রয়েছে।
‘মদ্যপান নিষেধ’ সাইনবোর্ড আর নয়
খুজান্দের আরেক নতুন প্রবণতা সম্পর্কে মানুষদের প্রথম অবহিত করেন তাজিক আইনজীবী ফাইজিনিসো ভোহিদভা। সেখানকার যেসব খাবারের দোকান জাতীয় খাবার পরিবেশন করে, সেখান থেকে ‘মদ্যপান নিষেধ’ সাইনবোর্ড তুলে নিতে বলা হয়। কারণ এটা নাকি মদ্যপানকারীর অধিকার লংঘনের পর্যায়ে পড়ে।
Акнун дар нуктахои савдои хуроки умум фуруши машруботи спирти ичборан ба рох монда мешавад. Ахиран имруз чанд нафар сохибони ошхонахо ба ман мурочиат карданд, ки масъулини макомотхои давлати онхоро мачбур карда истодаанд, ки фуруши нушокии спиртиро хатман ба рох монда, хатто мизочро барои нушидан ва харидани он хавасманд кунанд, то ки бо ин рох накшаи андоз ичро шавад. Хатто бахона пеш оварданд, ки азбаски солхои ахир намозхон зиед шуда, шумораи майнушон кам шудааст, ба бучаи давлат зарар расидааст.
এখন খাবারের দোকানগুলোতে মদ জাতীয় পানীয় বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। সম্প্রতি কয়েকজন দোকান মালিক আমাকে বলেছেন যে, কর্তৃপক্ষ মদ বিক্রি করতে তাদের ওপর জোর-জবরদস্তি করছে, সেগুলো ক্রেতাদের কিনতে এবং পান করতে উত্সাহিত করছে, যাতে তারা পরিকল্পনামাফিক ট্যাক্স পান। তারা এও বলেছে যে, ইবাদতকারী লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং পানকারী লোকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় রাষ্ট্রীয় বাজেটে বিপর্যয় ঘটেছে…
তরুণদের জন্য হজ্জ্ব নয়
গত ১৩ এপ্রিল ধর্ম বিষয়ক রাষ্ট্রীয় কমিটি একটি বিবৃতি দেয়। সেখানে তারা এই বছরে ৩৫ বছরের নিচের তরুণদের জন্য হজ্জ্বে যাওয়া কেন নিষিদ্ধ করেছেন, তার ব্যাখ্যা দেন। উল্লেখ্য, আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের জন্য হজ্জ্ব পালন ফরয:
ин тасмим танҳо ба хотири эҳтироми бузургсолон гирифта шудааст, ки синнашон алакай ба ҷое расидааст ва тавону орзуи адои зиёрати хонаи Худоро доранд.
এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বৃদ্ধদের প্রতি সম্মান দেখাতে, তাদের বয়স, সামর্থ্য এবং খোদার ঘর পরিদর্শনের ইচ্ছার কথা বিবেচনা করে।
তাজিকিস্তানের সবচে বড়ো ফেসবুক গ্রুপের একটিতে মিজগোনা সাইডোবা নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেন:
Агар насибамон ба 35 расидан набошад чи кор кунем?
ভাগ্য যদি আমাদের সহায় না থাকে, আমরা যদি ৩৫ বছরে না পৌঁছাই, তাহলে আমরা কি করবো?
নামের আগে কিংবা পরে শ্রেণি নির্দেশক শব্দ ব্যবহার কি বৈষম্যমূলক হতে পারে?
তাজিকিস্তানের নামের পরে ধর্মীয় দিক নির্দেশক শব্দ ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। তবে সেটাই এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাজিকস্তানের আইন মন্ত্রণালয় রেডিও ওযোডিকে বলেছে যে তারা এক্ষেত্রে সমতা আনতে চান। এজন্য তারা নতুন একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছেন, সেখানে মোল্লা, খলিফা, তাওরাহ, খোঁজা, শেখ, আমির, সুফি ইত্যাদি ধর্মীয় শ্রেণিবিভেদমূলক শব্দ নামের শেষে ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে।
উপরে উল্লেখিত শব্দগুলো ইসলাম ধর্মের সাথেও সম্পর্কযুক্ত। এই খসড়া আইনটি যদি তাজিকিস্তানের রাবার-স্ট্যাপ সংসদে পেশ করা হয়, তাহলে এর পাশাপাশি ‘ভিনদেশি সংস্কৃতি’ থেকে আসা প্রাণি ও পণ্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
তাছাড়া যেকোনো নতুন উদ্যোগের ছিপি আঁটার প্রথম জায়গা হলো খুজান্দ। ব্লগার রুস্তম গুলাভ ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেছেন, সেখানে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দেখা যাচ্ছে। আগে এটি হোজি আবদুলআজিজ নামে পরিচিত ছিল। এখন এটিকে শুধুই আবদুলআজিজ বলা হয়।
ধর্মকর্ম পালনের ওপর যখন নানা বিধিনিষেধ আসছে, সেই সময়েই তাজিক কর্তৃপক্ষ কাতারের টাকায় মধ্য এশিয়ার সবচে বৃহত্তম মসজিদ নির্মাণ করছে। তাছাড়া দেশটিতে মধ্য এশিয়ার সবচে বড়ো পাঠাগার ও থিয়েটার রয়েছে। আবার রাজধানী দুশানবেতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পতাকাদন্ড ও রয়েছে।