কারাকাসে আমি তেহরানকে খুঁজে পেয়েছি

Bikinis vs Chadors in Venezuela and Iran: "After acclimatizing to Venezuela, even some of the Iranian women would adopt the more revealing dress style of their Venezuelan peers." Shiraz street scene photo by Flickr user Gabriel White (CC BY-SA 2.0). Images remixed by Georgia Popplewell.

ভেনিজুয়েলা ও ইরানে বিকিনি বনাম চাদর: ‘ভেনিজুয়েলার আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেয়ার পর কোন কোন ইরানী নারীও এমনকি তাদের ভেনিজুয়েলিয় সঙ্গীদের খোলামেলা পোষাক শৈলী ধারণ করতেও রাজী।’ ফ্লিকার ব্যবহারকারী গ্যাব্রিয়েল হোয়াইট এর সৌজন্যে শিরাজ সড়কের দৃশ্যের ছবি (CC BY-SA 2.0). জর্জিয়া পপেলওয়েল ছবি পুনর্মিশ্রণ করেছে।

আমি মনে মনে ভাবছিলাম যখন প্রেসিডেন্ট শ্যাভেজ ও আহমেদিনেজাদ রাজনৈতিকভাবে উষ্ণ হতে শুরু করেছিল, এবং ভেনিজুয়েলিয় ও ইরাকী কর্মীরা করাকাস ও তেহরানে আসা-যাওয়া করতে শুরু করেছিল তখন বেশীরভাগ ভেনিজুয়েলিয় ইরান সম্পর্কে কতটুকু জানতো। 

আমার নিজের কল্পনায় ইরান প্রথম প্রবেশ করে একটি বিশ্ব মানচিত্রের মাধ্যমে যেটা দিয়ে আমর মা আমাদের ছোট বেলায় খেলতে ভালবাসতো। মানচিত্রটি–প্রচলিত একটি মার্কেটর প্রক্ষেপণ ধরনের ছিল যা সেইসময় পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আকৃতি দিয়েছেল–আমার ভাইয়ের শোবার ঘরের দেয়ালের প্রায় অর্ধেকটাই দখল করে ছিল, এবং ইরান বলে একটি দেশকে সেখানে দেখাতো, ঠিক তার নীচেই বন্ধনীর মধ্যে ‘পারশ্য’ শব্দটি লেখা ছিল। ৮ বছর বয়েসে আমার কাছে পারশ্য ছিল একটি জায়গা যেখানে আমার প্রিয় খেলা ‘পারশ্যের রাজপুত্র’ সংঘটিত হয়েছিল।  

বছর অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে আমি আমার অংকের পাঠ্য বইয়ে পারশ্যের আরও উদ্ধৃতি, এবং আমার পিতামাতার গ্রন্থাগারে পারশ্যের কবিদের সম্মুখীন হলাম। এছাড়াও, সেই ‘দূর’ দেশে ধারণ করা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। অবশ্যই হলিউডের ছবি। এর মধ্যে একটি ছিল বিষাদময় ঘটনা যেখানে দেখানো হয় কিভাবে একজন ইরানীকে বিবাহ করার পর একজন মার্কিন নারীর পৃথিবী ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় যখন তারা একত্রে তার স্বদেশ ভ্রমণ করে এবং নারীটি তার স্বামীর প্রতারণা ও ইরানের দমনমূলক লোকাচার দ্বারা আটকা পড়ে যায়। সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে সে তার তরুণী মেয়েকে নিয়ে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হয়, এবং যখন সে সেই পরিচিত তারা ও ডোরা দেখে তখন সে উপলব্ধি করতে পারে যে সে সত্যিই ঘরে ফিরে এসেছে…

পারশ্য সম্পর্কে আমার যে ধারণা ছিল তার থেকে এটা ছিল আমূল ভিন্ন চিত্র। আরব্য রজনীর গল্পগুলোর কারণে তৈরী হওয়া ধারণার ফলে আমার কাছে ইরান ছিল মধ্য প্রাচ্যের একটি অংশ এবং আমরা সবাই ভাবতাম বাস্তবিকভাবেই সেখানকার সবাই আরব। শেষেরটার ব্যাপারে আমি ভুল ছিলাম না, কিন্তু আমি এটি অনেক পরে গিয়ে আবিষ্কার করি, যখন ইরান ও পারশ্য উভয়ই বেশ অযাচিতভাবে কারাকাসে এসে উপস্থিত হয়। 

২০০৭ সালে আমি গণ অর্থনীতি মন্ত্রণালয়ে কাজ করছিলাম, যে মন্ত্রণালয়টি অন্যান্য কাজসহ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সমবায় গঠন ও উদ্যোক্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ সহায়তার কাজে বরাদ্ধ অর্থ পরিচালনা করতো যেটি শ্যাভেজ প্রশাসনের জন্য সেসময় প্রধান কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমার কাজের বেশীরভাগই ছিল যে দলিলগুলো ব্যবস্থাপনা থেকে সারা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হতো সেগুলোকে সম্পদনা ও অনুবাদ করা। আমি বিভিন্ন সহায়িকা ও উপস্থাপনা, এবং প্রতিলিপির কপি সম্পাদনা করতাম যেগুলোর মধ্যে এতো বেশী অর্থের পরিমাণ উল্লেখ করা আছে যেগুলোকে অংকের আকারে পড়া কঠিন ছিল।

অন্যান্য যে সমস্ত দলিল আমার ডেস্কে আসতো সেগুলো ছিল চিঠি ও আমন্ত্রণপত্র, এবং এগুলোরই একটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে: যন্ত্রকারিগর ও বিভাগীয় প্রধানদের লক্ষ্য করে ফার্সি-ভাষা শিক্ষার কোর্স-এর জন্য স্থান বরাদ্দের একটি স্মারক। এটাকে কঠিন ও অপব্যয়ী একটি কৌশল বলে মনে হয়েছে, কিন্তু আমাকে এই কোর্সে ভর্তি হবার জন্য বলা হয়েছে।     

এই ক্লাসগুলো স্প্যানীয় অনুবাদ ও সাহিত্যে ডিগ্রিসম্পন্ন ইরানীদের দ্বারা পরিচালিত হতো। এরা ছিল ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সের মধ্যে, যাদের কেউ কেউ প্রথমবারের মতো ইরানের বাইরে এসেছে। আমার কাছে এই ক্লাশগুলো ছিল একটি বিস্ময়কর জগতের প্রবেশদ্বার, শুধুমাত্র ভাষা এবং ব্যকরণের নয়, বরং ব্যক্তিগত মিথষ্ক্রিয়ারও। ক্লাশের দুই-তৃতীয়াংশই চলে যেত ইরান সম্পর্কে প্রশ্নের উপর: ‘কেন নারীদেরকে তাদের চুল ঢাকতে হয়?’ ‘কেন কেউ কেউকে তা করতে হয় না?’ ‘কেন আপনাদের এত জন করে স্ত্রী থাকে?’ ‘আমার ধর্মে ঈশ্বর সব জায়গায় বিরাজমান। কেন আপনার মক্কার দিকে ফিরে প্রর্থনা করেন?’ যা ভাষার ক্লাশ হিসেবে শুরু হয়েছিল তা ইরান বিষয়ক অধ্যায়নের ক্লাশে পরিণত হলো।

আমি আমার ভাষার ক্লাশে খুব ধীরে অগ্রসর হলাম, কিন্তু আমি সকল ইরানী জিনিসের উৎসুক ক্রেতা হিসেবে পরিণত হলাম। ভাষার শিক্ষকরা প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হলো, বিশেষভাবে নির্দিষ্ট একজন, যে আমাকে পারশ্য উচ্চাঙ্গ সংগীত, সিনেমা, কবিতা, এবং সমসাময়িক ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করলো। আমি ১৯৭৯ সালের অভ্যূত্থানের বিভিন্ন ঘটনা, এবং সমসাময়িক ইরানে জীবনযাত্রা সম্পর্কে পড়লাম ও শুনলাম। আমি ফার্সি থেকে আরবীতে, এবং পরিশেষে স্পেনীয় ভাষায় আসা বিভিন্ন শব্দের একটি দীর্ঘ তালিকা আবিষ্কার করলাম। তখনই আমি আবিষ্কার করলাম যে রূপকথা তাদের সবাইকে একটি বন্ধনে আবদ্ধ করেছে সেটিসহ আরব্য রজনীর অনেক গল্পের সাথেই দৃঢ় বন্ধনে জড়িয়ে আছে পারশ্যের ঐতিহ্যবাহী লোককাহিনী।

কারাকাসে এই নতুন বন্ধুদের কী প্রতিক্রিয়া হয় তা লক্ষ্য করা ছিল একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা, এবং তারা যেখানে থাকতো ও প্রায়ই যাতায়াত করতো সেখানে তাদের সাথে ঘুরতে গিয়ে মনে হয়েছে যে কারাকাসের মধ্যে একটি ছোট তেহরানে আছি। নারীদেরকে মনে হয়েছে যে নেকাব পড়তে হচ্ছে না দেখে তারা খুশী, এবং নিজের দেশে কিনতে পাওয়া কঠিন এমন কাপড় কেনা উপভোগ করছে। আমার সবচেয়ে বড় যে অভিজ্ঞতা তা হলো ওয়াক্সিং, ইরানী ধাঁচের, তার সাথে তাদের চুল ঠিক করা ও প্রসাধনী ব্যবহার করার উপায়। আমরা ল্যাটিন আমেরিকার তালবাজনার সাথে পারশ্যেরগুলো বিনিময় করলাম। 

এই বিনিময় কার্যক্রমের মাধ্যমে আমি যে মানুষগুলোর সানিধ্যে আসি তারা ছিল ভাষাবিদ, যন্ত্রকারিগর, প্রকৌশলী, এবং দূতাবাসের কর্মীবৃন্দের একটি মিশ্রণ। তাদের কেউ কেউ পরিবার নিয়ে এসেছে। অন্যান্যরা তাদের পরিবার ও প্রিয় জনকে দেশে রেখে এসেছে। 

ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠানগুলো পালনের সময় এই ইরানীদের রাজনৈতিক পক্ষপাত দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সরকারের সমর্থকরা, উদাহরণস্বরূপ, পারশ্যের নতুন বছর নওরুজ পালন করতো দূতাবাসের মধ্যেই প্রার্থনা এবং একটি ঐতিহ্যবাহী ভোজের মধ্যে দিয়ে। বিরোধী সমর্থকরা ঘরে থেকে বা কারাকাসে তাদের কোন একটি প্রিয় ইরানী রেস্তরাঁয় নাচের অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে নববর্ষ পালন করতো।

বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে, আমি মন্ত্রণালয় ত্যাগ করার পর যে সংবাদপত্রের জন্য কাজ করতাম সেই সংবাদপত্রের উপর একজন ইরানী বন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পেরে হতবাক হয়েছি। এটি একটি বলিষ্ঠ বিরোধী সংবাদপত্র ছিল যাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল সরকারের পদক্ষেপগুলোর সমালোচনা করতে ও শ্যাভেজকে যে কোন ভাবেই হোক চ্যালেঞ্জ করার জন্য (বর্মমানে এটি সরকারের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও তহবিলের অভাবে গভীর সংকটের মধ্যে আছে)। আমার কার্যালয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসে সে বেশ আতঙ্কের সাথে হলঘরে প্রদর্শন করা প্রথম পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলতো: ‘ইরানে এটি করা একেবারে অসম্ভব হতো!'। 

কিন্তু বেশীরভাগ সময়েই আমাদের ইরান, আহমেদিনেজাদ, শ্যাভেজ এবং ভেনিজুয়েলা সম্পর্কে উত্তপ্ত কথোপকথন হতো। তাদের কেউ কেউ শ্যাভেজকে পছন্দ করতো আর আহমেদিনেজাদকে অপছন্দ। কেউ কেউ আবার তাদের উভয়কেই অপছন্দ করতো। কেউ কেউ উভয় প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তাকে বুঝতো, এবং কেউ কেউ এর কিছুই বুঝতো না এবং শুধু চাইতো একটি পরিবর্তন আসুক। এই আলোচনাগুলো আমাকে শ্রেণীভেদ ও ধর্মের প্রতি মনোভাব দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল, এই উপলব্ধি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্মাতক অর্জন করা, বা ইরানের রাজধানীর বাইরের অঞ্চলগুলো থেকে আসা নতুন নতুন ইরানী অনুবাদকের আগমনের দ্বারা আরও গভীরতম হচ্ছিল। 

আমার ইরানী বন্ধুদের বেশীরভাগই ছিল মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর; পশ্চিমা চালচলনের প্রতি তাদের ঝোঁক ছিল আর সরকার ও একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ধারণার প্রতি তারা বেশী সমালোচনামূলক ছিল। আমার কাছে তাদেরকে বিশেষাধিকারভোগী মধ্যবৃত্ত ও উচ্চবৃত্ত শ্রেণীর ভেনিজুয়েলিয়দের মতোই মনে হয়েছে, কিন্তু তাদের পরিপক্কতা অনেক বেশী তা হয়তো তারা যা চেয়েছিল তার সব না পাওয়ার কারণেই হয়েছে। 

নতুনদের আগমণ ছিল দৃষ্টিগোচরভাবেই বেশ রক্ষণশীল। পরবর্তীতে আমার বয়ফ্রেন্ড হয়েছিল এমন একজন ইরানী বন্ধুর সাথে আগত  নারীদের একজন শেষ পর্যন্ত এ্যাপার্টমেন্ট ভাগাভাগি করলো। আমার বেশীরভাগ বন্ধুদের তুলনায় তার নেকাবের প্রতি অমূল একটি ভিন্ন মনোভাব ছিল, এবং সে তার চুল আঁচড়ানোর সময় আমার বয়ফ্রেন্ডকে তার নিজের কামরায় থাকতে বলতো, যে বিষয়টি সে সহজে উপলব্ধি করতে পারতো না। আমি ভাবি, যে সে হয়তো আমার তার সাথে দেখা করতে যাওয়াটাকে, এবং এমন কি রাতে একসাথে থাকাটাকে মেনে নিতো না, যদি তা হয়ও তবু সে তা কখনো জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি।  

যারা দূতাবাসে কাজ করতো তাদের মতো অতিমাত্রায় রক্ষণশীল ও ধার্মিক ইরানীরা কারাকাসের জীবনধারার সাথে তাদের প্রথম মোকাবেলাতেই কতখানি মর্মাহত হয়ে থাকতে পারে তা কল্পনা না করতে পারা কঠিন। ভেনিজুয়েলার দিগন্তরেখা বড় বড় বিজ্ঞাপন বোর্ড দ্বারা খোঁচা খোঁচা দাড়ির মতো ছেয়ে আছে, যেগুলোতে হাতে বিয়ার ধরা উদ্দীপক বিকিনি পরিহিত নারীদেরকে খোলা মুখে আবেদনময়ী ইসারা করতে দেখা যায়। বাসগুলো থেকে অতি উত্তেজনাকর রেগে ও আবেদনময়ী সালসার তাল শোনা যায়, এবং ক্লাবগুলোতে লোকে ইংঙ্গিতপূর্ণভাবে বুকে বুক মিলিয়ে অন্ধকারে নাচানাচি করে। আর টিভির তারকাদের জন্য বেশী মাত্রায় ত্বক দেখানো বাস্তবিকভাবেই একটি আবশ্যকতা। 

আমি জানি, অবশ্যই, এই ধরনের কার্যকলাপ ইরানে একেবারে অপরিচিত নয়। সেখানে ইরানী সমাজের নির্দিষ্ট স্তরে পারশ্যের রেগে এবং উন্মত্ত আমদানুষ্ঠান  ঠিকই অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমি উপরে যার বর্ণনা দিলাম তার বেশীরভাগই এতো খোলামেলাভাবে ইরানে খুব সহজে দেখা যাবে না। আমার মনে পড়ে আমি ইরানী দূতাবাসের একদল কর্মীকে একটি জনপ্রিয় ফার্সি রেস্তরাঁয় খেতে দেখেছিলাম, তারা সুস্পষ্টভাবেই বিব্রত হয়ে মাথা নীচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে খাচ্ছিল কারণ তখন রেস্তোরাঁর ঢিভি সেটে সাকিরা-সাজো প্রতিযোগিতা পরিভ্রষ্ট হয়ে একটি দণ্ডনৃত্যে রূপান্তরিত হয়েছিল।  

আমার পুরুষ ইরানী বন্ধুরা বলে যে তারা যখন প্রথম আগমন করে তখন ভেনিজুয়েলিয় নারীদের দিকে লজ্জায় না তাকানোটা কঠিন ছিল, কিন্তু পল্লী অঞ্চলে প্রকল্পগুলোর জন্য ইরানী যন্ত্রকারিগরদের কাছে কথা অনুবাদ করতে তাদের সাথে সাথে থাকার প্রয়োজনীয়তা থেকে সূর্যের নীচে দীর্ঘ সময় কাজ করা, এবং প্রায়শই অতিরিক্ত সময় কাজ করার জন্য কোন ক্ষতিপূরণ না পাওয়া সত্ত্বেও তারা দ্রুত এই খোলামেলা অবস্থার সাথে মানিয়ে নিয়েছে। তাদেরকে যে শোচনীয় গৃহায়ন পরিস্থিতি সহ্য করতে হয়, এবং ইরান ত্যাগ করার সঠিক তারিখ বা শর্তসমূহ প্রায়শই পরিষ্কার করে না বলা অদ্ভুত নির্বাচন প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয় তা সত্ত্বেও তারা মানিয়ে নিয়েছে। ভেনিজুয়েলাতে আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পর ইরানী নারীদেরও কেউ কেউ তাদের ভেনিজুয়েলিয় সঙ্গিদের মতো আরও বেশী খোলামেলা পোষাক শৈলী ধারণ করতেও শুরু করে। 

ইরানীরা কাজের ব্যাপারে যাদের সাথে যোগাযোগ করতো তাদের সাথে রোমান্টিক সম্পর্ক হয়ে যাওয়া, যেমন ঘটেছিল আমার নিজের ক্ষেত্রে, অথবা বিবাহ পর্যন্তও গড়ানো বিরল ছিল না। ভাষার বাঁধা থাকা সত্ত্বেও রোমান্স বিকশিত হতো, এবং গুয়ারিকো প্রদেশের নির্মাণ এলাকায় যেখানে আমার ইরানী অনুবাদক ছেলে বন্ধু কাজ করতো, সেখানে ইরানী যন্ত্রকারিগরদের সাথে নারী কর্মীদের কর্মদিবসে উধাও হয়ে যাবার গল্প শোনা যেত। কর্মী দলকে নির্মাণ এলাকা থেকে আনা-নেওয়া করার কাজে নিয়োজিত বাসটিতে একে অন্যের সাথে কোন মতে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে এরকম জুটিতে ভরা ছিল, এবং মাঝে মাঝেই সম্ভাব্য ভেনিজুয়েলিয় মেয়ে বন্ধুদেরকে ভালবাসার বক্তব্য অনুবাদ করার জন্য ইরানী অনুবাদকদের স্বদেশী পুরুষরা তাদের শ্মরণাপন্ন হতো। 

ইরানের সাথে ভেনিজুয়েলার সম্পর্ক কখনোই বিতর্কমুক্ত হয় নি। বিরোধী নেতারা মধ্য প্রাচ্যের রাজনীতিতে দেশটির সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে ওঠার ব্যাপারে ভীত ছিল। ২০০৯ সালে শ্যাভেজ তার বক্তব্যে বলেছিল যে ইরান ভেনিজুয়েলিয়াকে ইউরেনিয়ামের সন্ধান কাজে সাহায্য করছে, এবং অনলাইন রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার (কারিনী) এবং অন্যান্যরা দেশের মধ্যে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের একটি আন্তঃপ্রবাহের অভিযোগের বিষয়ে কথা তুলেছে। 

এদিকে, উভয় দেশেই অন্যান্য ধরনের বিনিময় সংঘটিত হয়েছে: ইরানের রাস্তার নাম রাখা হয়ছে শ্যাভেজ এবং বলিভার-এর নামানুসার; ভেনিজুয়েলিয় সঙ্গিত দলগুলো সঙ্গিত ভিডিও নির্মাণ করেছে তেহরানকে উপজীব্য করে। ইরানের সরকারের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ল্যাটিন আমেরিকিয় দর্শকদেরকে জন্য একটি নতুন টেলিভিশন ও অনলাইন চ্যানেল চালু করা হয়েছে, এদিকে ভেনিজুয়েলাতে ইরানী রান্নার কর্মশালা এবং ভাষা শিক্ষার কোর্সগুলোর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দশ বছর আগেও দেখতে পাওয়া খুব অসম্ভব ব্যাপার ছিল। 

সাংস্কৃতিক বিনিময়? রটনা? উভয়েরই কিছু কিছু? কোন কোন মৈত্রী কোন দিকে এগোবে সে বিষয়ে উদ্বিঘ্ন না হওয়া কঠিন, কিন্তু আমাকে যা মুগ্ধ করে তা হলো সরকারের হস্তক্ষেপের আওতার বাইরে ঘটা সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ। এগুলোকে বাদ দিলে দৃশ্যপট অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।   

রাজনৈতিক মৈত্রী চলতে থাকে। নেতৃত্বস্থানীয়দের অতি উৎসাহব্যাঞ্জক ঘোষণা যে এটি চিরস্থায়ী হবে সত্ত্বেও আমরা জানি না এটি কতদিন ধরে টিকে থাকবে। গুয়ারিকো প্রদেশের নির্মাণ এলাকায় সেসময় আমার দেখা বিকশিত হওয়া কোন কোন প্রেম সম্পর্কের মতো, ভেনিজিুয়েলা ও ইরানের সম্পর্ক হয়তো বর্তমানে প্রগাঢ় রয়েছে, কিন্তু এটি হাঙ্গামাপূর্ণ ও অনিশ্চিতও। তেলের মূল্য হ্রাস পাওয়া চলতেই থাকলে, এবং ভেনিজুয়েলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার যদি অবনতি হতেই থাকে তবে এই সম্পর্কের কী হবে? 

কিন্তু এই ভয় ছাপিয়েও আমি জানি যে চিরস্থায়ীভাবে অনেক অদৃশ্য সেতু নির্মিত হয়েছে। আমার সকল ইরানী মেয়ে বন্ধুরা ভেনিজুয়েলিয়দেরকে বিয়ে করেছে এবং তারা নিশ্চিতভাবেই ফার্সি-ভেনিজুয়েলিয়দের একটি নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি করবে যা এক যুগ আগেও কম লোকই ভাবতে পারতো। একটি বিশেষ দলের ইরানীরা এখনও ভিন্নভাবে ল্যাটিন আমেরিকাকে আবিষ্কার করে চলেছে। আমার নিজের প্রেমের সম্পর্ক হয়তো টিকতো না, কিন্তু আমি ইরানের সংস্কৃতির সাথে যে সম্পর্ক সৃষ্টি করেছি তা অবিচ্ছেদ্য। 

আমি এখনও কাউকে ফার্সি বলতে শুনলে আমার মাথা ঘুরিয়ে তাকাই। আমি এখনও এই ভাষাতে কবিতা মুখস্ত বলার চেষ্টা করি, আর যখনই কোনো সন্দেহ দেখা দেয় আমি উত্তরের জন্য হাফিজ-এর গজলের পাতা উল্টাই। আমি অধ্যায়ন বিষয়ক পত্রের জন্য ইরানী বিষয়গুলোকে নির্বাচন করেছিলাম, এবং যখন আমার প্রিয়জনেরা ২০০৯ সালের ইরানী নির্বাচনের পর সংঘটিত প্রতিবাদ ও নিপীড়নে জড়িয়ে পড়ে বিশেষ করে তাদের একজনকে যখন জেলে ঢোকানো হয় এবং জেলের মধ্যেই তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে আহত করা হয় আমি খুব গভীরভাবে ভুগেছিলাম। আমি এখনও ভাবি যে তার সেই অভিজ্ঞতার পরও সে তার সুন্দর ও সংবেদনশীল মনন উজ্জীবিত করে রাখতে সমর্থ হয়েছে, যা ভেনিজুয়েলাতে থাকাকালীণ আমার সাথে যখন তার পরিচয় হয়েছিল তখন আমাকে খুব আকর্ষণ করতো।  

সংস্কৃতি বিনিময় হয়েছে, কিন্তু মানুষের মিথষ্ক্রীয়ার মাধ্যমে। ভাল হোক খারাপ হোক সাংস্কৃতিক দিগন্ত স্বচ্ছন্দে বা অস্বাচ্ছন্দে বিস্তৃত হয়েছে। আন্ত-সাংস্কৃতিক হলো আন্ত-ব্যক্তিক। আমি যখন এই স্মৃতিগুলোকে ঝালিয়ে নেই তখন একজন লেখক ও দীর্ঘ দিন ধরে ভেনিজুয়েলিয় সক্রিয় কর্মী ছিল এরকম আমার একজন প্রিয় বন্ধুর বলা কিছু কথা মনে পড়ে, যে আমার মতোই ইরান সম্পর্কে বেশ মোহিত হয়েছিল এর মানুষগুলো দ্বারা। সে একবার একজন অসাধারণ ইরানী নারীকে বিবাহ করেছিল, যে খোমেনীর সময়ের আগে ও পরেও একটি সক্রিয় কর্মী ছিল। সে আমাকে একবার বলেছিল: ‘কোন ইরানী যদি একবার তোমার পথে পড়ে, তবে তুমি কখনওই তাদের মনমুদ্ধকরতা এড়িয়ে যেতে পারবে না।’ 

বেশ কয়েক বছর পর এমনকি আমি যে এখন ফ্রান্সে থাকি, তার কথাগুলো আমার কানে এখনও বাজে। ইরান বা ভেনিজুয়েলা যাই থেকে থাকুক, বা যাই হোক না কেন যে জিনিষটি টেকসই হবে তা হলো নিজেকে নতুন পৃথিবীর কাছে মেলে ধরার প্রয়োজনীয়তা থেকে মানুষ দ্বারা সৃষ্ট নতুন সংস্কৃতি। ইরানের সাথে আমার যোগাযোগ প্রমান করে বাস্তবিকভাবে সংস্কৃতিগুলো হলো প্রায় অনোপলব্ধিযোগ্য বলয়, যাকে যথোপযুক্ত সংখ্যক শব্দ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। ইতিহাস, শ্রেণী, রাজনীতি, ধর্ম, ও সাহিত্য এই দেশের সম্পর্কে এতো বেশী সংখ্যাক চিত্র তুলে ধরে যে একজন সর্বদাই বাস্তবতাকে অতিসরলীকরণের প্রচেষ্টর জন্য মর্মাহত হয়। 

নিদেনপক্ষে আমার কাছে ইরান কী ছিল, আছে, বা হতে পারে তার ব্যাখ্যা করতে একজন প্রিয় লেখকের বলা কথাগুলো থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করাটা তাহলে সঠিক অনুভূত হচ্ছে: শুধুমাত্র সর্বত্তোম সরলীকরণ করে, ও সুবিধা খোঁজার জন্য আমরা মাত্র একটি ইরানের বিষয়ে কথা বলি। বাস্তবিকভাবে, ভৌগলিক নামকরণ ব্যাতীত আমরা যে ইরানকে চিন্তা করি যে ইরানকে দেখি তার হয়তো কোন অস্তিত্বও নেই।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .