- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

বিতর্কিত ইরানী লেখকের বই অনুবাদ করা নিয়ে বাংলাদেশী প্রকাশক মৃত্যু হুমকির সম্মুখীন

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, ইরান, বাংলাদেশ, ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজম, তাজা খবর, ধর্ম, নাগরিক মাধ্যম, বাক স্বাধীনতা, মানবাধিকার, রাজনীতি, সাহিত্য
The cover of the Bengali Translation of  Iranian Muslim scholar and politician Ali Dashti's book. Image courtesy Haseeb Mahmud. [1]

ইরানের মুসলমান পণ্ডিত ও রাজনীতিবিদ আলী দস্তির বইয়ের বাংলা অনুবাদের মোড়ক। ছবি হাসীব মাহমুদের সৌজন্যে।

বিংশ শতাব্দীর ইরানী যুক্তিবিদ ও রাজনীতিবিদ আলী দস্তি [2] রচিত হযরত মুহাম্মদের জীবনীর বাংলা অনুবাদের প্রকাশক তাদের এই কাজ বাংলাদেশের জাতীয় বই মেলায় প্রদর্শন করার পর থেকে মৃত্যুর হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।  কট্টরপন্থী ধর্মীয় দলগুলো, প্রধানত হেফাজত-ই-ইসলাম [3] কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবী জানিয়েছে যাতে তারা প্রকাশনী সংস্থা রোদেলা প্রকাশনীকে “নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর [4]” শিরোনামের অনুবাদের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। রোদেলা প্রকাশনীর ওয়েবসাইট [5]টি দেখে মনে হয় যে ১৪ই ফেব্রুয়ারী ২০১৫তে এটিকে হ্যাক করা হয়েছে, এবং বাংলা ট্রিবিউনের একটি প্রতিবেদনে [6] বলা হয়েছে রবিবারে তাদের বাংলাবাজারের কার্যালয়ে আক্রমণ চালানো হয়। তবে কেউই আহত হয়নি। এই বিতর্কের পরে প্রকাশনা সংস্থাটি একুশে বই মেলায় [7] তাদের তাক থেকে এবং তাদের ওয়েবসাইট থেকে বইটি তুলে নিয়েছে, এবং সংবাদে জানানো হয়েছে যে প্রকাশক রিয়াজ খান এই বলে ক্ষমা [8] চেয়েছেন যে উনি জানতেন না যে বইটি আক্রমণাত্বক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।  

EUpofBg [9]

রোদেলা প্রকাশনীর বিকৃত করা ওয়েবসাইটের একটি স্ক্রীনশট যার মধ্যে অন্যান্য লেখার সাথে এটি লেখা আছে: এই ওয়েবসাইটটি হ্যাক করা হয়েছে নবিকে অসম্মান করার প্রতিবাদস্বরূপ। [..]  রোদেলা প্রকাশনীকে না বলুন।

এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সত্বেও, বই মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমীর কর্তৃপক্ষ ফেব্রুয়ারীর ১৬ তারিখে প্রকাশনী সংস্থাটি ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন বই বিক্রয় করে’ অভিযোগ এনে রোদেলা প্রকাশনীর স্টলটি বন্ধ করে দিয়েছে [10]।’ মেলা পরিষদ এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে এই বলে যে ‘মেলার নিয়ম নীতি ২০১৫ এর ১৩.১৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে কারোরই মেলায় এমন বই বিক্রয় করার অনুমতি নেই যা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে।’

সচলায়তন কমিউনিটি ব্লগে হাসিব মাহমুদ [1] এই বইটির বিরুদ্ধে যে নির্মম আচরণ করা হয়েছে তা সংকলিত করেছেন:

এই বই প্রকাশের জের ধরে ধর্মীয় মৌলবাদি গোষ্ঠি বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছে। গতকাল গণমাধ্যমগুলো প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে হেফাজতে ইসলামের [3] জুনাইদ বাবুনগরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক “মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি চরম অবমাননাকর ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ ‘নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর’ শীর্ষক বইটি বাজেয়াপ্ত ও ‘রোদেলা’ প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ” করার দাবি জানিয়েছে।” তারা আরোও বলেন, দেশের ক্ষুদ্র একটি ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক পৃষ্ঠপোষিত [..] এই বইটির পরতে পরতে মহান আল্লাহ তা’আলা, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর পবিত্র জীবন সম্পর্কে অসত্য, বিভ্রান্তিকর ও ধৃষ্টতাপূর্ণ মিথ্যাচার করা হয়েছে। বইটির লেখক কুখ্যাত ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক আলী দস্তি। [..]

এই বই প্রকাশের নেপথ্য ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদী দুষ্টচক্রকে তদন্তের মাধ্যমে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির দিতে হবে। অন্যথায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদী গোষ্ঠীকে প্রতিহত করতে বাংলার তৌহিদি জনতাকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে কঠোর কর্মসূচী দিয়ে মাঠে নামতে বাধ্য হবে।

ইসলামী আন্দোলন-এর মতো অন্যান্য সংস্থাগুলোও প্রায় একই রকমের বিবৃতি দিয়েছে। ১৯৭০ সালে প্রথম প্রকাশিত হওয়া [11] বই ‘২৩ বছর: মুহাম্মদের কর্মজীবনের উপর অধ্যায়ন’ নবি মুহাম্মদের উপর আরোপিত অলৌকিক কাজগুলোর বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। লেখক প্রয়াত আলী দস্তি একজন প্রাক্তন সিনেটর এবং লেবাননে ইরানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী অভ্যুত্থানের পরে রুহুল্লা খোমেনী [12] ক্ষমতা গ্রহণ করলে দস্তিকে জেলে ঢোকানো হয় [13], এবং তখন যার কাছেই এই বই পাওয়া যেত তাকেই জেরা করার জন্য আদালতে হাজির করা হতো।  ১৯৯০ এর সালগুলোতে উচ্চ বিদ্যালয় পাঠরত একজন ইরানী ব্লগারকে আমরা এই বই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। এই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইরানি ব্লগার বলেন:

I believe I read his book called 23 years when I was a teenager. Most of the Shiism custom he criticized in the book had disappeared by the time I read it. And I think no Shiite Muslim would defend the things he criticized in his book today. So he was not anti-Islam but against weird customs in Shiite Islam….I don't know how I got it. It is unlikely that you can buy it from bookstores.

আমার বিশ্বাস যে ২৩ বছর নামের এই বইটি আমি আমার তরুণ বয়েসে পড়েছি। আমি যখন বইটি পড়েছি সেসময়ের মধ্যেই এ্ই বইয়ে সমালোচনা করা হয়েছে এরকম বেশীরভাগ শিয়া আচারগুলোই অপসারিত হয়ে গিয়েছিল। এবং আমি মনে করি যে তিনি তার বইয়ে যে বিষয়গুলো সম্পর্কে সমালোচনা করেছিলেন কোন শিয়া মুসলমানই আর সেগুলোকে এখন সমর্থন করবে না। সুতরাং সে ইসলাম বিরোধী নয় বরং শিয়াদের ইসলামের কিছু অদ্ভুত আচারের বিরোধী ছিলেন…আমি ঠিক জানি না আমি এটি কিভাবে পেয়েছিলাম। কোন বইয়ের দোকান থেকে এই বই আর মনে হয় কিনতে পারবেন না।  

বাংলাদেশী প্রকাশকদের একটি দল দাবী করেছে যেন রোদেলা প্রকাশনীকে তাদের বর্তমান কার্যালয় থেকে উচ্ছেদ করা হয় এবং প্রকাশক খানকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তারা তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবারও প্রতিজ্ঞা করেছে। খান বলেছেন যে তিনি তার মোবাইল ফোনে মৃত্যুর হুমকি পাচ্ছেন।

Screenshot of a threatening message posted against the publisher on Facebook. Image courtesy Haseeb Mahmud. [14]

এই বইটি বিক্রয় করছিল এমন একটি অনলাইন ই-কমার্স সাইটের বিরুদ্ধে হুমকিস্বরূপ একটি বাণী ফেসবুক-এর একটি পাতায় প্রকাশ করা হয়। সাইটটি এই বইটিকে তাদের তালিকা থেকে সরিয়ে নিয়েছে। হাসিব মাহমুদ-এর সৌজন্যে এই স্ক্রীনশটটি। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধর্মাবমাননা ও নাস্তিকতার অভিযোগের ফলাফল হয়েছে খুব গুরুতর এবং কখনও কখনও মারাত্মক। দুই বছর আগে ব্লগার রাজীব হায়দারকে ঢাকাতে তার বাড়ীর সামনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় [15] বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী এবং ইসলামী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তার লেখার জন্য। আরও অনেক ব্লগারদের মধ্যে হয়দার একজন যার গায়ে নাস্তিক লেবেল লাগানো হয়েছে। হেফাজতে [16]র মতো ইসলামী দলগুলো প্রকাশ্যে লেখক ও ব্লগারদেরকে নাস্তিক বা ধর্মঅবমাননাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে [17] এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দাবী করেছে। বাংলাদেশে ধর্ম নিরপেক্ষ সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান, তাই সেখানে কোন শরীয়া আইন বা ধর্মঅবমাননা আইন বিদ্যমান নেই। যারা নিজেদেরকে নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরও অন্যান্য নাগরিকদের মতো একই অধিকার আছে। যদিও বাংলাদেশের ফৌজদারী আইনের (১৮৬০) ২৯৫এ অনুচ্ছেদের অধীনে যে কোন ব্যক্তির যদি ‘ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত’ করার ‘ইচ্ছাকৃত’ বা ‘দ্বেষপূর্ণ’ উদ্দেশ্য থাকে তবে সে কারাদণ্ডের জন্য দায়ী হবে। লেখক স্বকৃত নোমান [8] ফেসবুক-এ একটি লেখার মাধ্যমে ‘নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর’ শিরোনামের অনুবাদকে ঘিরে যে ধিক্কার চলছে সে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন:

প্রশ্ন হচ্ছে, আলি দস্তির এই বইটি কি আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ? যদি নিষিদ্ধ না হয় তাহলে বাংলাদেশে বইটি প্রকাশিত হলে অসুবিধা কী? বইটি বাংলা অনুবাদ হওয়ার আগে অনুভূতিপ্রবণরা কোথায় ছিলেন? এতদিন কেন অনুভূতিতে আঘাত লাগল না? নাকি আপনারা পার্সি বা ইংরেজি জানেন না বলে আপনাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগেনি?

নোমান আরও বলেন:

জানি, এই দেশের মানুষ হয়ত এখন রোদেলা প্রকাশনীর প্রকাশক রিয়াজ খানের পক্ষে কথা বলবে না। অধিকাংশ মানুষ এখন হেফাজতের পক্ষে তালি বাজাবে। সরকারও হয়ত হেফাজতের পক্ষ অবলম্বন করবে। আমি বাংলা ভাষার ক্ষুদ্র এক লেখক, আমি হেফাজতে ইসলামির এই অযৌক্তিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করছি। জানি এই প্রতিবাদের কারণে হয়ত আমিও আক্রান্ত হতে পারি। তবুও প্রতিবাদ করছি। কারণ, এভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় না। জ্ঞানের পথকে এভাবে রুদ্ধ করা যায় না। এই বইয়ের বিরুদ্ধে যদি হেফাজত বা ইসলাম ধর্মের কেউ পাল্টা আরেকটি বই লিখত, সেটিই হতো প্রকৃত প্রতিবাদ। জ্ঞানের প্রতিবাদ জ্ঞান দিয়ে করতে হয়। যুক্তির প্রতিবাদ যুক্তি দিয়ে করতে হয়। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে হামলা, প্রকাশকের ফাঁসি দাবিকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।