মধ্য মিয়ানমারের মোগিওপিন গ্রামে বসবাস করতেন ডাও (মহিলাদের সম্মানসূচক সম্বোধন) খিন উইন। ৫৬ বছর বয়সী এই মহিলাকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। গত ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখে ৬০ জন গ্রামবাসী এবং একটি চীনা খনি কোম্পানির মাঝে সংঘর্ষের সময় এ ঘটনা ঘটে। মুখোমুখি এই সংঘর্ষের সময়ে প্রায় আরও ১০ জন লোক এবং দুইজন পুলিশ আহত হন। সহিংসতা পরের দিনেও অব্যাহত থাকায় এতে আরও তিনজন লোক আহত হয়েছেন।
লাতপাদুয়াং কপার খনির আশেপাশের কিছু পরিমাণ জমি কোম্পানিটি বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখার চেষ্টা করলে গ্রামবাসী তাদের বাঁধা দিতে যান। ফলে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। কোম্পানিটি তাদের কাজের প্রক্রিয়ায় ব্যবহার্য একটি বুলডোজার রাখতে জমিতে বেষ্টনি দিয়েছিল। মোগিওপিন গ্রামের অধিবাসীরা যখন গুলতি দিয়ে পাথর ছোঁড়া শুরু করেন এবং এর জবাবে পুলিশ বল প্রয়োগ করে, তখন সংঘর্ষটি আরও মারাত্মক আকার ধারন করে।
মিয়ানমারে চীনা কোম্পানি ওয়ানবাও এবং মিয়ানমার অর্থনৈতিক হোল্ডিং কোম্পানি ইউনিয়নের (ইউএমইএইচ) মাঝে যৌথ কপার খনি ব্যবসাটি অন্যতম বিতর্কিত একটি বিনিয়োগ প্রকল্প। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে খনি কোম্পানির বিরুদ্ধে পালিত প্রতিবাদ কর্মসূচীতে সহিংসতা ছড়িয়ে পরে। এ সহিংসতায় বৌদ্ধ ভিক্ষু সহ ৬০ জনেরও বেশি লোক আহত হন। সে সময় ঘটনাটি গভীরভাবে তদন্তের জন্য রাষ্ট্রীয় পক্ষ থেকে একটি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন স্থানীয় জমির মালিকদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে কোম্পানিটিকে আদেশ দেয়। যদিও এ প্রকল্পের কারনে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক স্থানীয় বাসিন্দা এই সিদ্ধান্তকে অপর্যাপ্ত বলে মনে করছেন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সংঘর্ষে সে সব গ্রামবাসী জড়িত ছিলেন যারা এই ক্ষতিপূরণ নিতে এবং তাদের জমির দখল ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

কপার খনি কোম্পানি কৃষকদের জমি ঘিরে ফেললে প্রতিবাদ স্বরূপ তাঁরা কোম্পানির বুলডজার আটক করার চেষ্টা করে। ইরাওয়াদি ব্লগের হান উইন অং এর তোলা ছবি।
ডাও খিন উইনের মৃত্যুতে অনেক সক্রিয় কর্মী ক্রোধে ফুঁসে উঠেছেন। এই সক্রিয় কর্মীরা ২০১২ সাল থেকেই গ্রামবাসীদের সমর্থন যুগিয়ে আসছেন।
প্রজন্ম আন্দোলন গণতন্ত্র পন্থি তরুণদের একটি গ্রুপ। এই গ্রুপের একজন সদস্য মো থওয়ে মিয়ানমারের নতুন সরকার কর্তৃক বাস্তবায়ন করা রাজনৈতিক সংস্কারের সার কথার প্রতি অভিযোগ করে প্রশ্ন তুলেছেন। (সতর্কীকরন –লিঙ্কটিতে হৃদয়বিদারক তথ্য বিদ্যমান):
বার্মার উঁচু দিকে অর্থাৎ মোনিওয়ার কাছাকাছি অবস্থিত লাপাদুয়াং খনি প্রকল্পের জন্য জমি গ্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে একজন নারী কৃষককে গুলি করে হত্যা [এরকম] করা হয়েছে। ২০ জনেরও বেশি সংখ্যক স্থানীয় কৃষক এতে আহত হয়েছেন [এরকম]।
সংস্কার বলতে কি বোঝায়?
আসলেই কি কোন পরিবর্তন এসেছে?
নায় মিও জিন হচ্ছেন একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং মিয়ানমার সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ডাও খিন উইনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটিকে কো পার গিকে নিয়ে ঘটে যাওয়া আরেকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাথে তুলনা করেছেন। উল্লেখ্য কো পার গি একজন সংবাদ প্রতিবেদক ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেনঃ
কো পার গিকে গোপনে হত্যা করা হয়েছে। তবে তাঁর হত্যার বিষয়টি প্রকাশিত হয়ে পড়লে [তারা] অজুহাত দেখিয়ে বলেছিলেন যে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গুলি করা হয়েছে। এখন চলুন অপেক্ষা করি, লাতপাদুয়াং অঞ্চলের নারী কৃষকের মৃত্যুর কি অজুহাত [তারা] দেখায়। জনগণের সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন যে তারা কি দূর্ঘটনাবশত তাকে গুলি করার কথা বলবেন, নাকি অন্ধ ও অসহায় [শ্লেষোক্তি করে বলা] বুলডজারটিকে রক্ষার্থে গুলি করা হয়েছে বলে অজুহাত দেখাবেন। ন্যায়বিচার অর্জনের চেষ্টা করতে সবাইকে একত্রিত হতে হবে। আমরা যদি একত্রিত না হই তবে আমাদের এই আতঙ্কের মাঝে বসবাস করতে হবে যে আমাদেরকেও একদিন কো পার গিয়ের মতো ভাগ্য বরণ করে নিতে হতে পারে।
নতুন সমাজের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠাতা মোয়েথি জুন। তিনিও সরকারের নিন্দা করেন এবং ন্যায়বিচারের দাবি জানাতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেনঃ
লাতপাদুয়াং থেকে কৃষকদের ছত্রভঙ্গ করতে সহিংসতার আশ্রয় নেয়ায় আমি প্রকাশ্যে সরকারের আচরণের নিন্দা জানাচ্ছি। কৃষকদের এই সমস্যা শুধু তাদের নয় সমগ্র জাতির। আমাদের অবশ্যই তাদের সাহায্য করতে হবে। উদাসীন হয়ে থাকবেন না, যেন সমস্যাটি আমাদের নিজেদের নয়। যারা আজ উদাসীন পরবর্তীতে হয়তোবা তাদের [ভোগান্তির] সম্মুখীন হতে হবে।
এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মুখপাত্র অদ্রে গঘরান প্রতিবাদ কর্মসূচীটি সামলানোর ব্যবস্থাপনা ব্যাপারে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেনঃ
আমরা কিছু প্রতিবেদন সম্পর্কে উদ্বিগ্ন, যেখানে কয়েকজন প্রতিবাদকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়েছেন। পুলিশ কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বন্দুকের আশ্রয় নিয়েছে সে সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।
মায়ুং জারনি একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক। কোন রকম সাম্প্রদায়িকতা ছাড়াই তিনি চীনা কোম্পানির কার্যকলাপের বিরোধীতা করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। (সতর্কীকরন – লিঙ্কটিতে হৃদয়বিদারক উপাদান বিদ্যমান):
CHINA-#MYANMAR mining LOOT-Kill. Boycott anything #China, but don't allow yourself to become anti-Chinese #racist. pic.twitter.com/dIzzhRYLJ3
— maung zarni (@drzarni) December 22, 2014
চীন-#মিয়ানমার খনির লুণ্ঠন-হত্যা। চীনের যেকোন কিছু বয়কট করুন, কিন্তু চীনা বিরোধী বর্ণবাদী হবেন না।
মোগিওপিনের প্রতিবাদকারী এবং পুলিশের মাঝে সংঘটিত ভয়াবহ সংঘর্ষটি মিয়ানমার সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তোষকে আরও তীব্রতর করে তুলবে। এতে করে মনে হচ্ছে, সারা দেশজুড়ে যে বিপুল সংখ্যক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে, সেগুলো নিয়ে জনগনের মাঝে বেড়ে যাওয়া অসন্তোষে নজর দিতে সরকারের অনীহা রয়েছে।
ওয়ানবাও কোম্পানিটি ডাও খিন উইনকে হত্যার নিন্দা করেছে। কোম্পানিটি তাকে “লাতপাদুয়াং যৌথ পরিবারের একজন সদস্য” হিসেবে উল্লেখ করেছে। এটি পুনরাবৃত্তি করেছে যে “চরমপন্থি” এবং “বহিরাগতরা” সম্প্রদায়টির মাঝে সহিংসতা সৃষ্টি করছে। কোম্পানিটি ২৩ ডিসেম্বর তারিখে দেয়া বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলেছে, “শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমেই শান্তি এবং টেকসই উন্নয়ন অর্জন করা যায়”।