কেন সামিটে অংশগ্রহণকারীরা ম্যাগেলান এবং সেবু সম্বন্ধে অন্য সব দূর্লভ তথ্য পছন্দ করবে

১.যখন গ্লোবাল ভয়েসেস সামিটে অংশ নেওয়ার জন্য অংশগ্রহণকারীরা জানুয়ারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সেবুতে এসে হাজির হবে, তখন তারা ঐতিহাসিক এক যাত্রার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে যে পথ ধরে এখন থেকে ছয়শ বছর আগে পর্তুগীজ অভিযাত্রী ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান স্প্যানিশ রাজার পক্ষ থেকে বিশ্ব প্রদক্ষিন করে।

১৫১৯ থেকে ১৫২১ সালের এই ম্যাগেলানের অভিযাত্রা বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল এ কারণে যে এটি ছিল প্রথম আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর প্রবেশের ঘটনা এবং একই সময়ে এই অভিযাত্রী দল প্রশান্ত মহাসাগরও পাড়ি দেয়, ম্যাগেলান স্বয়ং নিজে এই মহাসাগরের নাম দেন “শান্ত সমুদ্র”। স্পেনের রাজা পঞ্চম চার্লস ম্যাগেলানকে পশ্চিম থেকে এশিয়ায় যাওয়ার জন্য আরেকটি বাণিজ্যিক সমুদ্র পথ অনুসন্ধানের জন্য তাকে নিযুক্ত করেন।

সেবু প্রদেশের ম্যাকটান আইল্যান্ড হচ্ছে সেই এলাকা যেখানে পর্তুগীজ এই অভিযাত্রী ও যোদ্ধা ২৭ এপ্রিল ১৫২১-তারিখে দাতু লাপু-লাপুর নেতৃত্বে পরিচালিত ম্যাকটান আইল্যান্ডের ঐতিহাসিক যুদ্ধে ফিলিপিনোদের হাতে নিহত হন। মূল যে নৌবহর নিয়ে ম্যাগেলান যাত্রা করেছিলে, তাতে ছিল ৫টি জাহাজ এবং ২৩৭ জন নাবিক, তার মধ্যে মাত্র ১৮ জন নাবিক নিয়ে ভিক্টোরিয়া নামক জাহাজটি ১৫২২ সালে স্পেনের সেভিয়া বন্দরে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।

Photo Credits: http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/a/ab/Magellan_Elcano_Circumnavigation-en.svg

ছবির কৃতিত্ব: http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/a/ab/Magellan_Elcano_Circumnavigation-en.svg

২। সেবু নামটি এসেছে প্রাচীন সেবুয়ানো ভাষার একটি শব্দ সিবু থেকে যার অর্থ হচ্ছে বিনিময় অথবা বাণিজ্য। আর দ্বীপের নাম ম্যাকটান হয়েছে স্থানীয় এক শব্দ মাঙ্গাটাঙ্গ থেকে যার মানে হচ্ছে জলদস্যু।

স্পেন এই এলাকাটিকে তাদের উপনিবেশ বানানোর আগে সেবু সিটির উত্তরপূর্ব উপকূলের অংশকে (যেটিকে এখন পারিয়ান বলে ডাকা হয়) স্থানীয় ভাষায় সিনিবু-আইয়াং হিংপিট বলে ডাকা হত। এর আক্ষরিক মানে হচ্ছে “পুরোপুরি বাণিজ্যের এক জায়গা”, যেখানে চীন, ভারত, জাপান থেকে ব্যবসায়ীরা আসত।

সে সময় সেবু শহরকে বলা হত সুগবো বা ঝলসানো পৃথিবী। তখন স্থানীয়রা মিন্দানাও-এর সুলতানের হামলার হাত থেকে পাহাড়ে পালিয়ে কিংবা অন্য কোথাও পালিয়ে যাওয়ার আগে শহরে আগুন লাগিয়ে দিত, যে সুলতান দাস এবং লুণ্ঠনের জন্য ফিলিপাইনের বাকী দ্বীপপুঞ্জের আক্রমণ শানাত। আর একারণে এর আদি নাম ছিল কাং শ্রী লুমায়াং সুগবো বা শ্রী লুমাই-এর ঝলসে যাওয়া শহর। শ্রী লুমাই ছিলেন সেবুর প্রথম শাসক।

শ্রী লুমাই-এর নাতি হুমাবোন-এর শাসনামলে বোর্নিও থেকে ম্যাকটান আইল্যান্ডের ভবিষ্যৎ শাসক লাপু-লাপু সুগবো-এর উত্তরে মান্দাউলি বা যা এখন মান্দাউয়ি নামে পরিচিত সেখানে ঘাঁটি গাড়ে। যখন এই দুই শাসকের মধ্যে শত্রুতা তীব্র হয়ে দেখা দেয়, তখন যে সমস্ত জাহাজ মান্দাউয়ির পাশ দিয়ে ওপাং আইল্যান্ড অতিক্রম করে বাণিজ্যিক কেন্দ্র সুগবোর দিকে যেত, লাপু-লাপু তার অনুসারীদের সেগুলোকে পাকড়াও করার নির্দেশ প্রদান করে। আর এ কারণে এই দ্বীপ জলদস্যু বা মাঙ্গাটাঙ্গ-এর কারণে ভয়ের দ্বীপে পরিণত হয়, যার কারণে এর নাম দেওয়া হয় ম্যাকটান।

৩ সমগ্র সেবু এলাকা কিছু সময়ের জন্য স্পেনের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা উপভোগ করে, ডিসেম্বর ১৮৯৮-এ উপনিবেশিক শক্তি স্পেনের এই এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-এ যুক্তরাষ্ট্র এই এলাকা দখল করে নেওয়ার মাঝে দুই মাসের কিছু বেশী সময় এই এলাকা স্বাধীন ছিল।

৩৩৩ বছর স্পেনের শাসনের পর, আন্দ্রেস বোনিফেসিওর নেতৃত্বে সংগঠিত কাটিপুনান বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে জেগে ওঠা সেবু বাসী তাদের স্বাধীনতা অর্জন করে। ২৩ আগস্ট ১৮৯৬ তারিখে ম্যানিলা এবং তার আশেপাশের এলাকায় আন্দোলন শুরু হয় এবং ঘটনাক্রমে সাড়া দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

৩ এপ্রিল ১৮৯৮-এ সেবু সিটিতে ট্রেস ডে আব্রিল নামক গণজাগরণ বিস্ফোরিত হয়ে সেবুতে উপনিবেশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। সেবুর বিপ্লবী এবং স্পেনের সেনাদের মাঝে ২৪ ডিসেম্বর ১৮৯৮ পর্যন্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে, যতক্ষণ না সেবুর স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় মেস্তিজো অভিজাত শ্রেণী এবং বিপ্লবী নেতাদের দ্বারা গঠিত এক তত্ববাধায়ক সরকারে হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে।

কিন্তু অর্জিত এই স্বাধীনতা খুব স্বল্প সময় টিকে ছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-এ তত্ত্ববধায়ক গর্ভণর পাবলো মেজিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের হাতে সেবু সিটিকে সমর্পণ করে। জেনারেল আর্কেডিয়া ম্যাক্সিলোমের নেতৃত্বে সেবুর অবশিষ্ট অংশ ফিলিপিনোদের হাতে রয়ে যায়। ২৭ অক্টোবর, ১৯০১ এ ম্যাক্সিলোম-এর আত্মসমর্পণ-এর পূর্ব পর্যন্ত ফিলিপিনোরা ভয়াবহ এক প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছিল। ১৯০৬ সাল পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে সশস্ত্র যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে।

৪ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সেবু সিটিকে ধ্বংস স্তূপে পরিণত করে। কিন্তু জাপানী সেনারা নয়-যারা শহরটির তেমন ক্ষতি করতে পারেনি, যারা শহরটির বেশীরভাগ অংশ ধ্বংস করে তারা হচ্ছে আমেরিকান সেনা, যারা শহরটিকে ব্যাপকভাবে ধ্বংস করে দেয় বিরামহীন ভাবে বোমা বর্ষণ করে ধারণা করা হয় সেবুর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়।

ইতিহাসবিদদের মতে, যুদ্ধ সেবুকে ২৫ বছর পেছনে নিয়ে যায়। ভবন, শিল্প কারখানা, গৃহ, কৃষি, রাস্তা এবং সেতু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে, শহরটিকে আবার নতুন করে গড়তে সরকারকে ১০ বিলিয়ন পেসো খরচ করতে হয়।

৫। সেবু সিটিকে “দক্ষিণের রাণী” হিসেবে ডাকা হয়। তবে আদতে এই উপাধি ১৮৯৮ সালে স্পেনের রাণী ইলোইলো সিটিকে প্রদান করেছিল।

স্পেনের রাণীর প্রতিনিধি হিসেবে ফিলিপাইন শাসন করা মারিয়া ক্রিস্টিনা, ১ মার্চ ১৮৯৮ সালে ইলোইলো সিটিকে সবচেয়ে সুন্দর এবং অভিজাত শহর (লা মুয়ে লেল ইয়ে নোবল কিউদাদ) উপাধি প্রদান করে। কাটিপুনান নামক স্প্যানিশ বিরোধী বিদ্রোহের সময় বিপ্লবের দমনে স্প্যানিশ সেনাদের সাহায্য করার জন্য লুজানে ইলোইলো শহরের অভিজাতদের স্বেচ্ছাসেবক পাঠানোর ঘটনায় কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে এই উপাধি প্রদান করা হয়। স্প্যানিশ উপনিবেশবাদের প্রতি এই বিশ্বস্ততার অঙ্গিকার-কারণে ইলোইলো শহর দক্ষিণের রাণী উপাধি অর্জন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং ম্যানিলার বাইরে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার কারণে পরে সেবুকে এই উপাধি প্রদান করা হয়।

City Skylineসূত্র
মারিভির আর মনটেবোন, আবার আমাদের শেকড়ের সন্ধানে: সেবুর উপনিবেশ পূর্ব এবং উপনিবেশ উত্তর অতীত (মিঙ্গলানীলা: ইএস ভিলাভের প্রকাশনা, ২০০০).
পলিকারপিও এফ. হার্নানদেজ, ইলোইলো, সবচেয়ে অভিজাত শহরঃ ইতিহাস ও উন্নয়ন ১৫৬৬-১৮৯৮ (কুয়েজন সিটিঃ নিউ ডে প্রকাশনী)।
রেসিল বি.মোজারেস, আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ:প্রতিরোধ এবং সহযোগিতায় সেবু-১৮৯৯-১৯০৬ (কুয়েজন সিটি, এ্যান্তেনিও ডে মানিলা প্রেস ১৯৯৯)

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .