ইউক্রেনে ইউরোময়দান আন্দোলন তৃতীয় সপ্তাহে পড়েছে। আন্দোলন সংঘটনে সামাজিক মিডিয়া এবং প্রযুক্তি মূল ভূমিকা রেখে চলেছে। গত ৩০ নভেম্বরে আন্দোলনে অষ্টম দিনে সরকার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীকে সহিংস উপায়ে দমনের চেষ্টা করে। আর এতে করে দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। সরকারবিরোধী এই আন্দোলন অনেকটা ২০০৪ সালে কমলা বিপ্লবের মতোই।
২০০৪ সালের আন্দোলনের সাথে ইউরোময়দান আন্দোলনের একটা বড়ো পার্থক্য হলো, এবারকার আন্দোলন সংগঠিত করতে নতুন ধারার মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে।
একদম শুরু থেকেই আন্দোলন গড়ে তুলতে ফেসবুক মূল ভূমিকা পালন করেছে। একই সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে আন্দোলনের নানা আপডেট পেয়েছেন। নভেম্বরের ২১ তারিখে আন্দোলনকারীরা প্রথম কিয়েভে জড়ো হয়েছিলেন। এবং এটাই অনলাইন সংবাদমাধ্যম ইউক্রেয়ানস্কা প্রাভদার প্রদায়ক মোস্তফা নাঈমের মতো সাংবাদিক ও নাগরিক অধিকার কর্মীদের কাছে ইউরোময়দান হয়ে যায় (ইউরোপিয়ান স্কোয়ার)।
ফেসবুক এবং টুইটারের মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তোলা
আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে এবং আন্দোলনের খবরাখবর সবার কাছে শেয়ার করতে ফেসবুক এবং টুইটার প্রধান ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। ইতোমধ্যে ইউরোময়দানের ফেসবুক অফিসিয়াল পেজ ইউক্রেনে নতুন রেকর্ড গড়েছে। পেজটি খোলার মাত্র আটদিনের মধ্যে ৭৬ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী লাইক দিয়েছেন। এই পেজের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের জরুরি তথ্য এবং দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। তাছাড়া ভবিষ্যতে কী ধরনের কর্মসূচী নেয়া হবে, সহিংসতার বিরুদ্ধে সতর্ক করা, পুলিশ বাহিনীকে কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে তার পরামর্শ ছাড়াও আরো নানা বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা হয়। বর্তমানে পেজটি লাইক দিয়েছেন ১৪১, ০০০ ফেসবুক ব্যবহারকারী। এখানে ১৬৭,৭০০টি আলোচনা হয়েছে। ইউরোময়দান লভিভ নামের ইউক্রেনিয় ভাষার সাথে ইউরোময়দানের একটি ইংরেজি পেজও খোলা হয়েছে।
ইউরোময়দানের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট @EuroMaydan [uk] এবং @EuroMaydan_eng [en] ফেসবুক পেজের মতোই ভূমিকা রাখছে। একই সাথে তারা টুইটারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মাধ্যমে সারাবিশ্বের মানুষদের কাছে ইউক্রেনের আন্দোলনের খোঁজখবর জানানোর কাজটিও করছে।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার এই অ্যাকাউন্ট তৈরি করার আগে তারা তথ্য শেয়ার করতে হ্যাশট্যাগ (ইউক্রেনিয় ভাষায় #Євромайдан এবং রাশিয়ান ভাষায় #Евромайдан) ব্যবহার করতো। আন্দোলন সম্পর্কিত সব ধরনের তথ্য এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টগুলো কয়েকটি ওয়েবসাইটের সাথে সোশ্যাল মিডিয়া এগ্রিগেটর এবং দরকারি লিংকের মাধ্যমে একত্রিত করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে Euromaidan.eu [uk], Euromaidan.tk [uk, ru, en], Euromaidan.com [ru], Maidan.in.ua [en].
“ইউরোময়দান – এসওএস”: আন্দোলন দমনের রূপরেখা এবং সময়মতো সাহায্য পৌঁছানো
রায়ট পুলিশ কোনো প্রতিবাদকারীকে আঘাত করলে, প্রথমবারের মতো কাউকে গ্রেফতার করলে, তাদের চিকিৎসা সাহায্য এবং আইনি সহায়তা দিতে ফেসবুক পেজে এবং গ্রুপে আলোচনা করা হয়। তাছাড়া প্রতিবাদকারীদের নিরাপদ থাকতে নানা ধরনের তথ্য জানানো হয়।
ইউরোময়দান এসওএস পুলিশ কর্তৃক যারা আহত হয়েছেন, যাদের ওপর সরকারের চাপ দিয়েছে এবং আটক করেছে, তাদের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। পেজের বর্ণনায় বলা হয়েছে:
Ця сторінка створена для надання правової допомоги постраждалим на Євромайдані. Ми юристи громадські активісти та журналісти – оперативно збираємо всю інформацію про постраждалих та тих, хто досі приймає участь у мітингах. А також про юристів, консультантів, які готові надати їм правову допомогу – та повязуємо їх між собою.Якщо у вас пропали родичі чи Ви стали жертвою побиття – НЕ МОВЧІТЬ! Відстоюйте свої права разом з нами!
ইউরোময়দানে যারা আহত হয়েছে, তাদের আইনি সহায়তা দেয়াই এই পেজের উদ্দেশ্য। আমরা আইনজীবী, নাগরিক অধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের একটি দল। আমরা আক্রান্ত এবং সক্রিয় প্রতিবাদকারীদের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে তাদের জন্য আইনি এবং বিশেষজ্ঞ সেবা দেয়ার প্রস্তুতি নিই। তাদের একে অন্যের সংস্পর্শে রাখি। যদি আপনার পরিচিত কেউ নিখোঁজ হন কিংবা আপনি পুলিশ কর্তৃক আক্রান্ত হন- তাহলে নীরব থাকবেন না! আমাদের সাথে আপনার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামিল হোন।
শিগগিরই একই উদ্দেশ্যে Eurozahyst.org [uk] নামে আলাদা ওয়েবসাইট খোলা হয়।
ইউরোময়দানের আইনি দিক নিয়ে আলোচনার জন্য ফেসবুকে “দ্য রেভুলিউশন'স লিগ্যাল ডিপার্টমেন্ট” নামে একটি উন্মুক্ত গ্রুপ খোলা হয়। যাদের আইনি সহায়তা দরকার তাদের কীভাবে সহায়তা দেয়া যায় তা নিয়ে এখানে নানা ধরনের আইডিয়া শেয়ার করা হয়।
আইনজীবীদের পাশাপাশি ডাক্তার এবং মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরাও ইউরোময়দানে অংশগ্রহণকারীদের চিকিৎসা সাহায্য দিতে এগিয়ে আসেন। চিকিৎসা কাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবীদের সংগঠিত করতে তারা অর্গানাইজেশন অব ভলেন্টিয়ার ডক্টরস এবং ময়দান ডট ডক্টরস সহ আরো কয়েকটি ফেসবুক পেজ খোলেন। তারা আন্দোলনের মূল এলাকা কিয়েভ এর মিখাইলিভস্কি ক্যাথেড্রাল এবং স্বাধীনতা চত্বরের আশেপাশে প্রথম অন-গ্রাউন্ড হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন।
ক্রাউডসোর্সিংয়ে সৃজনশীল আইডিয়া এবং উপকরণ
ইউরোময়দান আন্দোলনকে টেকসই এবং আরো বিস্তৃত করার জন্য আইডিয়া শেয়ার করতে আরো একটি ফেসবুক পেজ খোলা হয়। ইনফরমেশন সেন্টার হিসেবে “ময়দান ছেড়ে যাবেন না” পেজটি শুরু হয় ডিসেম্বরের এক তারিখে, ক্রিয়েভে আন্দোলনের মূল সাইটের একটি আইডিয়া থেকে। এর চারদিন পর এই ফেসবুক পেজ তৈরি করা হয়। ডিসেম্বরের ৭ তারিখের মধ্যে পেজটিতে ৩ হাজার মানুষ লাইক দেন। এটি ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে কাজের, স্লোগানের এবং পোস্টারের সৃজনশীল আইডিয়া আহবান করে। পরে এগুলো ইন্টারনেটের বিপুল সংখ্যক মানুষের সাথে শেয়ার করা হয়। ইউরোময়দানের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অনলাইন উদ্যোগের সাথেও কাজ করে।
এছাড়া স্ট্রাইক প্ল্যাকার্ড নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলা হয়েছে, যার মাধ্যমে শুধু সৃজনশীল পোস্টার ডিজাইন এবং শেয়ার করা হয়।
একটি এনজিও আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে Biggggidea.com এ “ক্রিয়েভবাসীর জন্য সংস্কার” নামে একটি উদ্যোগ হাতে নেয়। ডিসেম্বরের ৮ তারিখের মধ্যে এই প্রজেক্টের মাধ্যমে ১২ হাজার মার্কিন ডলার সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ এতে জমা পড়ে।
ইউরোময়দান স্বেচ্ছাসেবীদের কাজে সমন্বয় সাধন
আন্দোলনের গতিবিধি লক্ষ্য করছেন এমন অনেক পর্যবেক্ষক আন্দোলনের মূল অবস্থান স্বাধীনতা চত্বর এবং ক্রিয়েভ শহরের প্রশাসনিক ভবন, যেটা আন্দোলনকারীরা দখল করে নিয়েছেন, সেখানকার প্রতিবাদ কর্মসূচী সুচারুভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এমনকি দিনে প্রতিবাদকারীদের রক্ষা করতে স্বাধীনতা চত্বরটি ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে রেখেছেন তারা। আর রাতে টহলের ব্যবস্থা করেছেন। জনতা সেখানে খাবার-দাবার নিয়ে আসছেন এবং প্রতিবাদকারীদের মাঝে সেটা বিলিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া আন্দোলনকারীদের আশ্রয় এবং চিকিত্সা সামগ্রী দিয়েও সহায়তা করছেন। এদিকে আন্দোলনকারীরা পরস্পরকে মাতিয়ে রাখতে প্রতিবাদস্থানেই ফুটবল খেলা থেকে কনসার্ট, বই পড়া, উন্মুক্ত আলোচনাসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন। আর এসব আয়োজনের জন্য বাহবা পাবেন সেখানকার আন্দোলনকারীরা। ইন্টারনেটের নানা ধরনের টুলস-এর সহায়তা নিয়ে এই ধরনের আয়োজনগুলো সফল করা হয়েছে।
ইউরোময়দানের অংশগ্রহণকারীদের কী দরকার আর স্বেচ্ছাসেবীরা কী ধরনের সাহায্য দিতে পারবেন, তার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য Galas.org.ua[uk] ওয়েবসাইট একটি ক্রাউডম্যাপিং টুলস ব্যবহার করেছে। এ বিষয়ে একটি ফেসবুক পেজও চালু করা হয়েছে।
Maidanhelp.org ওয়েবসাইটিও একই উদ্দেশ্যে চালূ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ইউরোময়দানের অংশগ্রহণকারীদের কী কী দরকার তার তথ্য টুকে রাখছে।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংহতি
এই উদ্যোগগুলোর পাশে প্রতিদিনই নানা ধরনের উদ্যোগ যুক্ত হচ্ছে। তবে এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, তা হলো, এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য প্রযুক্তি সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যা ইউরোময়দানকে ইউক্রেনে টিকে থাকতে সাহায্য করছে। গত সপ্তাহে আন্দোলনের মধ্যেই ইউক্রেনের অন্যতম ইন্টারনেট প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠান ভলয়া-ক্যাবল ঘোষণা দিয়েছে, তারা ক্রিয়েভের মূল কেন্দ্রের গ্রাহকদের জন্য ইন্টারনেট স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি আন্দোলনকারীদের জন্য ইন্টারনেট সেবাও তারা উন্মুক্ত করে দেয়। তাদের ঘোষণার প্রেক্ষিতে অনেকেই তাদের ওয়াইফাই কানেকশন চালু করে। আবার অনেকেই তাদের ওয়াইফাই পাসওয়ার্ডও আন্দোলনকারীদের কাছে প্রকাশ করে দেয়।