গত ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ওইদিন রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আবদুল কাদের মোল্লা ছিলেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল।
ফাঁসি কার্যকর হবার পর মোল্লার দলের কর্মী ও সমর্থকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস হামলা চালায় যার ফলে অনেক যানবাহন ও বাড়িঘর ধ্বংস হয় এবং বেশ কয়েকজন মারা যায়।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারান ৩০ লক্ষ নিরীহ মানুষ। ধর্ষণের শিকার হন ২ লক্ষের ও বেশি নারী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এসব কাজে সহযোগিতা করে এদেশীয় রাজাকার, আলবদর বাহিনী। কাদের মোল্লা ছিলেন রাজাকার বাহিনীর নেতৃস্থানীয় সদস্য। সেই সময় তার নেতৃত্বে মিরপুরে মিরপুরের আলোকদী গ্রামে ৩৪৪ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়, ১১ বছর বয়সী বালিকাকে ধর্ষণ করা হয় এবং এক মহিলা কবির জীবনাবসান হয়। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সেই সময়কার যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম চলছে।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয় এবং বছর খানেক পর ২০১১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে ৬টি অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তাকে যাবজ্জীবন দন্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ফুসে উঠে ছাত্র-জনতা। গড়ে উঠে শাহবাগ আন্দোলন (শাহবাগ আন্দোলন সংক্রান্ত বিশেষ কাভারেজ পাতা দেখুন)।
শাহবাগ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠার পর উভয়পক্ষকে আপিলে সমান সুযোগ দিয়ে সংশোধন করা হয় আইন, যে আইনে করা আপিলে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয় সুপ্রীম কোর্ট। মোল্লা ছাড়া এখন পর্যন্ত ১২জনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এর আওতায় বিচার করা হচ্ছে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিভিন্ন সাজা পেয়েছেন। জামাত প্রথম থেকেই এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে আসছে এই বলে যে এটি বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার।
কাদের মোল্লার বিচার প্রক্রিয়া ও এ সংক্রান্ত সংবাদ নিয়ে টুইটারে খুব জোরেশোরে আলোচনা চলেছে। শাহবাগ আন্দোলনের সমর্থকেরা (#shahbag এবং #BanJamaat হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে) মোল্লার ফাঁসির সমর্থনে প্রচার চালায়। অন্যদিকে জামাতের সমর্থকেরা (#FreeQuaderMollah, #WeAreQuaderMollah, #MartyrAbdulQuaderMollah ইত্যাদি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে) কাদের মোল্লাকে নির্দোষ দাবী করে তাকে মুক্ত করার প্রচারে নামে। এই হ্যাশট্যাগের মধ্যে কোন কোনটি ট্রেন্ডিং (বহুল ব্যবহৃত) হয়।
অ্যালান তুরিং (@turing1010) শাহবাগ আন্দোলনকে ধন্যবাদ জানিয়ে টুইট করেন:
Thank you #Bnagladesh & #Shahbag, this is the beginning of a new era, secular and independent nation 🙂 'V'
— Alan Turing (@turing1010) December 12, 2013
ধন্যবাদ #বাংলাদেশ এবং #শাহবাগ। সেকুলার এবং স্বাধীন জাতি হিসেবে নতুন যুগের শুরু হলো আজ। 🙂 V
যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতির কলঙ্ক মোচন শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নেটিজেনরা। ব্লগার একরামুল হক শামীম ফাঁসি কার্যকরের খবর শুনেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন:
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর। দায়মুক্তির সূচনা এখানেই। জয় বাংলা।
ব্লগার অভিজিৎ রায় একে বাংলাদেশের নতুন যুগে প্রবেশের সূচনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন:
আজ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির সাথে বাংলাদেশ নতুন দিনে, নতুন যুগে, নতুন জগতে প্রবেশ করলো। অনেক দুঃখ পেয়েছি মা এই বছরটায়, আশা করি বিজয় দিবসটা এবার নতুন আলোয় অন্যরকম একটা ভোর দেখবে।…
টুইটার ব্যবহারকারী রয়েসয়ে (@royesoye) ৪২ বছর ধরে বাংলাদেশ যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে আসছে, সেটা উল্লেখ করে টুইট করেছেন:
After 42 years, we tried and executed one of the monsters who participated in one of the cruelest genocide in 20th century. #JoyBangla
— royesoye (@royesoye) December 12, 2013
৪২ বছর পর অনেক চেষ্টায় আমরা একজন দানবকে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারলাম। দানবটা ২০ শতকের সবচে’ নিষ্ঠুরতম গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল। #জয়বাংলা।
এখানে আরও টুইটার প্রতিক্রিয়া রয়েছে:
Why people of Bangladesh is demanding death penalty of Quader Mollah?? Here is the reason! #shahbag pic.twitter.com/wtpqeFVckd
— ChLoeyy (@_chloey_001) December 12, 2013
বাংলাদেশিরা কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কেন চাচ্ছে? উপরে সেই কারন পাবেন!
[DEAR WORLD] The Mass Movement in @Bangladesh is not against “Islamists” by @moshahidas http://t.co/VAc5WsVCuc #Righton #RT #shahbag
— Shahbag Worldwide! (@Projonmo13) December 13, 2013
প্রিয় বিশ্ববাসী: বাংলাদেশের শাহবাগের গণজাগরণ ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের বিপক্ষে নয়!
Angry Jamaat warns of dire consequences | Sets alight house of ex-minister: http://t.co/fsvqjJQccp #Shahbag
— Ruhin Afrin Joyee (@rajoyee) December 10, 2013
বিক্ষুব্ধ জামাত দেখে নেবার হুমকি দিয়েছে । প্রাক্তন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন
#Jamaat threatens to burn 56,000 square miles. It is still Government's fault, right? http://t.co/zs3Mm2R3HD #Shahbag @nytimes @andyrNYT
— Enamul Hoque (@enamul1hoque) November 22, 2013
#জামাত বাংলাদেশের ৫৬০০০ বর্গমাইল জ্বালিয়ে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে। এটিও সরকারের দোষ, তাই না?
I reject the verdict of Quader Mollah #FreeQuaderMollah Send in your picture with this message! pic.twitter.com/7L1L6QICpU #Bangladesh
— RT 2 #SaveBangladesh (@RT_SaveBD) September 19, 2013
আমি কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় মানি না। #কাদেরমোল্লাকে মুক্ত কর। আপনারা দয়া করে এই বার্তা সম্বলিত ছবি পাঠান!
Abdul Quader Mollah death sentence violates international law http://t.co/qJ816FE6Ut #SaveBangladesh #FreeQuaderMollah
— Mahfuz Nahid (@MahfuzNahid) September 19, 2013
আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা, হিউমান রাইটস ওয়াচ এবং আরও অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠন বিচারের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন এই মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর না করতে। তবে নেটনাগরিকেরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন:
Where is @UN when people die on the streets every day from violence by Jamaat? Human rights only for the powerful eh? #shahbag
— AD (@m0th3rh3n) December 10, 2013
যখন প্রতিদিন জামাতি সন্ত্রাসে লোক মারা যাচ্ছে রাস্তায় তখন জাতিসংঘ কিছু বলে না কেন? মানবাধিকার কি শুধু ধনী ও ক্ষমতাধরদের জন্যে?
চতুর্মাত্রিক ব্লগে কালো কাক (Black Crow) লিখেছেন:
কাদের মোল্লার ফাঁসির দিনে Jang Song Thaek নামে নর্থ কোরিয়ার একজন সাবেক ক্ষমতাধর ব্যক্তির’ও মৃত্যদন্ড কার্যকর হয়েছে। নর্থ কোরিয়া কাউকে পাত্তা-টাত্তা দেয়না বলে সেখানে গিয়ে নাক গলানো সম্ভব না। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হলো কী? তারা তো একটু শব্দ-টব্দ করতে পারতো? করেছে কেউ? আমার গুগলমতে না। [..] বিশ্ববাসীর সিলেক্টিভ মানবতা দেখছি!
শাহনূর বেগম (@ShahnurBegum) কাদের মোল্লার ফাঁসিতে যারা খুশি, তাদের উদ্দেশ্যে টুইট করেছেন:
"আয়রনি আর আয়রনি" #WeAreQuaderMollah.কাদের মোল্লার মৃত্যুতে যারা খুশি, তারা কেউ তাঁকে খুন,ধর্ষণ করতে দেখেনি.https://t.co/ypej4jmoRS
— Shahnur Begum (@ShahnurBegum) December 13, 2013
ব্লগার আমি অপটিমিস্ট মনে করেন, এই রায় দেশের মানুষকে শত ভাগে ভাগ করে দিয়ে গেছে:
আয়রনি হচ্ছে, বেয়াল্লিশ বছর অপেক্ষা করে যেই রায় দেয়া হলো এবং কার্যকর করা হলো, যাতে বেয়াল্লিশ বছর আগের ক্ষত ভুলে আমরা একসাথে সামনে আগাতে পারি, সেই রায়ই দেশের মানুষকে শত ভাগে ভাগ করে দিয়ে গেল। […]
এদিকে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করায় জামায়াতে ইসলামী দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছে। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও পুড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি বিচার কার্যক্রমের সাথে জড়িত কয়েকজন বিচারকের বাড়িতেও হামলা করেছে। তারা দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে। এক বিবৃতিতে দলটি কাদের মোল্লাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বিচারে সাজা দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করে এবং আগামি রবিবার (১৫ই ডিসেম্বর, ২০১৩) সকাল সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয়।
ইশতিয়াক মাহমুদ (@iamahmud) কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরবর্তী সহিংসতার একটি চিত্র তুলে ধরেছে:
10 killed in Jamaat-Shibir men unleashed violence on political rivals in #bangladesh http://t.co/xjs1Xqr3Sn @UNHRC @amnesty #shahbag,
— Istiaque Al Mahmud (@iamahmud) December 13, 2013
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জামাত-শিবিরের সহিংসতায় দেশব্যপী এ পর্যন্ত ১০ জন মারা গেছে।
ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট কল্লোল মোস্তফা জামায়াতে ইসলামীর ‘তান্ডব সংগঠকদের’ সনাক্ত করে দ্রুত গ্রেফতার করা জরুরি বলে মনে করেন:
কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসিকে কেন্দ্র করে বরাবরের মতোই জামাত সারা দেশে পরিকল্পিত ভাবে তান্ডব চালাচ্ছে- হিন্দু পল্লী,সরকারি প্রতিষ্ঠান, দোকান-পাট, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, জানবাহন ইত্যাদি এই জামাতি তান্ডবের লক্ষ বস্তু । শুধু জামাতি সেন্ট্রাল কমান্ড নয়, গ্রাম-থানা-উপজেলা-জেলা-বিভাগ পর্যায়ের জামাত-শিবিরের ‘তান্ডব সংগঠকদের’ সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। তাৎক্ষণিক ভাবে তান্ডব ঠেকানোর পাশাপাশি এই ‘তান্ডব সংঠকদের’ দ্রুত সানাক্ত করে গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনা এখন সবচেয়ে জরুরী কাজ।
কাদের মোল্লার ফাঁসির খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করে। বেশিরভাগ মিডিয়া কাদের মোল্লাকে ‘ইসলামিস্ট লিডার’ বলে অভিহিত করে। এটার বিরোধীতা করে সাংবাদিক পল্লব মোহাইমেন ফেসবুকে লিখেন:
কাদের মোল্লাকে Islamist leader বলা হচ্ছে দুই জায়গায়। এক. জামাত বলছে। আর দুই. পশ্চিমা গণমাধ্যম। পশ্চিমা গণমাধ্যমের শিরোনামে war criminal লিখতে কেন এত কষ্ট? ব্যতিক্রম হিসেবে রয়টার্স ও এএফপি তবুও কিছুটা যুদ্ধপরাধের কথা যুক্ত হয়েছে।
1 টি মন্তব্য