দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতের স্থানীয় সরকারের উড়িষ্যায় এক বিশালকায় ইস্পাত কারখানা স্থাপন পরিকল্পনায় জাতিসংঘের একটি প্যানেলের জমি অধিগ্রহণ স্থগিতকরণ পরামর্শ প্রত্যাখান , এই উন্নয়নের মুখে নিজেদের বাড়ি এবং জীবিকার মাধ্যমসমূহ ধরে রাখার জন্য জগৎসিংহপুরের জনতার সাম্প্রতিক লড়াই-এ এক আঘাত।
জগৎসিংহপুর, ভারতের উড়িষ্যার রাজ্যের একটি শহর ও পৌরসভা, যার বাসিন্দারা পোসকো প্রকল্পের, বিরোধিতা করে আসছে, যেটি ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ইস্পাত কারখানা গড়ার পরিকল্পনা, যার নির্মাণ সময়কাল ধরা হয়েছে আট বছর। জুন ২০০৫-এ উড়িষ্যার রাজ্য সরকার এবং কোরীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান পোসকো এই প্রকল্পের জন্য এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে; যে প্রকল্পের জন্য প্রাথমিক ভাবে ৪০০৪ একর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয়, আর এর মধ্যে ২,৯০০ একর জমি ছিল বনভূমি এবং অবশিষ্ট অংশ ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
কিন্তু প্রকল্পের জন্য বনের ভূমি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে, স্থানীয়রা এই জমির উপর তাদের অধিকার দাবী করে, যারা যুগ যুগ ধরে যে বনের উপর ভিত্তি করে তারা তাদের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করে আসছে।
আর যদি এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় তাহলে ২২,০০০-এর বেশী নাগরিককে জোর করে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হতে হবে, যার জন্য দায়ী হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণ। এর জন্য সফল এক অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হবে যে অর্থনীতি পান চাষ, সুপারি বাগান ও মাছ চাষের মত কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভরশীল।
৭ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে কোরীয় প্রজাতন্ত্র এবং উড়িষ্যা সরকার উভয়ে যৌথ এক বিবৃতিতে জানায় যে; প্রস্তাবিত এই কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হবে ২০১৪ সাল থেকে, যদিও জাতিসংঘের মানবাধিকার প্যানেল পরামর্শ প্রদান করেছে যে এই প্রকল্পকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানে হাজার হাজার নাগরিকের বাস্তুচ্যুত হওয়া এবং সাথে আরো অনেকের জীবিকার উপায়সমূহ বিনষ্ট হওয়া।
দি নিউ স্কুল এণ্ড ফেলো এ্যাট ফরেন কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন-এর এক সহকারী অধ্যাপক টেরা লওসন রেমার পরিস্থিতির উপর মন্তব্য করেছেন। ক্রাকটিভিজম ব্লগে তিনি উল্লেখ করেন যে :
সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং হুমকির মুখে থাকা গোষ্ঠীর সম্পত্তির অধিকার হচ্ছে উন্নয়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘ এক সীমাবদ্ধতা; প্রায়শই-বিদেশী বিনিয়োগকারীর অর্থায়নে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির কার্যক্রমে যে সমস্ত ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়, তাতে সম্পদের আদি ব্যবহারকারীদের জোর করে বাস্তুচ্যুত করা হয় এবং সেক্ষেত্রে ভুমির উপর তাদের অধিকার উপেক্ষা করা হয়, যা সম্পত্তি নিরাপত্তাহীনতাকে ঘনীভূত এবং সম্পদকে দুষ্প্রাপ্য করে তোলে- এমনকি সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটার সময়ও এই ঘটনা ঘটে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতে বিলম্ব হওয়ার কারণে এর প্রস্তাবিত সুবিধাদি আটকে যায়। রাষ্ট্র ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকার ভুমির এক বিশাল অংশ অধিগ্রহণ করে ফেলেছে। কিন্তু নিয়মের কঠিন বেড়াজাল পার হতে গিয়ে এবং ১,৬০০ হেক্টর জমি, মূলত যার বেশীর ভাগ অংশ জঙ্গল , তা পরিষ্কার করার বিরুদ্ধে এক গণ অসন্তোষের কারণে এটির নির্মাণে বিলম্ব ঘটেছে।
এই প্রকল্প কেবল স্থানীয় জনতা এবং পরিবেশের উপর প্রভাব সৃষ্টির কারণে বিতর্ক তৈরী করেনি, একই সাথে যে ভাবে পুলিশ এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে তৈরী হওয়া বিক্ষোভ মোকাবেলা করেছে, তা নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
এই প্রকল্প নিয়ে অসংখ্য বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে, এবং সম্প্রতি মার্চ ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে পোসকো বিরোধী চারজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। কাফিলা ব্লগে সুভাষ গাতাদে সংবাদ প্রদান করেছে, যখন দলের মাঝে ছোড়া বোমা বিস্ফোরিত হয়, তখন পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তারাও এই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ।
বিক্ষোভকারীদের দাবীগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ:
১. পোসকো প্লান্টের জন্য ভুমি অধিগ্রহণ দ্রুত বন্ধ করতে হবে।
২. প্রস্তাবিত পোসকো প্লান্ট এলাকা থেকে দ্রুত পুলিশ বাহিনী সরিয়ে নিতে হবে।
৩. জগতসিংহপুর-এর জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ প্রধানকে বরখাস্ত করতে হবে।
৪. বিক্ষোভকারীদের অপরাধের সাথে যুক্ত করার মত মিথ্যা অভিযোগ দ্রুত বন্ধ করতে হবে।
যখন এই ইস্পাত কোম্পানীর প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে, তখন ভিডিও ভলান্টিয়ার্স, নামের এক আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম এবং মানবাধিকার এনজিও একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে যেখানে বাসিন্দাদের এক জোরালো স্বাক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা বর্ণনা করছে, এই প্রকল্প কত ব্যাপকভাবে তাদের জীবন এবং জীবিকাকে আক্রান্ত হয়েছে:
নভেম্বর ২০১২-এ এই তথ্যচিত্র ধারণ করা হয়, যা সে সময় বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার উক্ত এলাকায় চালানো তথ্য অনুসন্ধান অভিযাত্রার সময় ভিডিও ভলেন্টিয়ার নামক এক সম্প্রদায় ধারণ করেছিল। এই অভিযাত্রার আরেকটি ফল হচ্ছে “ইস্পাতের মূল্য” শিরোনামে এক প্রতিবেদন (পিডিএফ) ।
এই তথ্যচিত্রের ইউটিউবের পাতা থেকে জানা যাচ্ছে:
এই তথ্যচিত্রের প্রমাণসমূহ এসেছে জটিল এক সময়ে যখন এলাকা আক্রান্ত হওয়া ও প্রতিবাদ এবং ফাইলিন নামক ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞের পরে এখানকার বাসিন্দারা আবার ধীরে ধীরে নিজেদের গড়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। আক্রান্ত এলাকার লোকজন উক্ত এলাকা পোসকো এবং উড়িষ্যা সরকারের ১,৭০,০০০ টি বৃক্ষ কর্তনের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে। সরকার তাদের ঘূর্ণিঝড়ের হামলার মুখে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছে। এর আগের বছরগুলোয় এই বন ঘূর্ণিঝড়ের সময় এর ভয়ংকরতম ধ্বংসযজ্ঞের প্রভাবকে প্রশমিত করত। [..]
” জাতিসংঘের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান এবং সংঘ বিষয়ক বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি মাইনা কিয়াই বলেছেন “এমন সংবাদ পাওয়া গেছে যে প্রকল্প-আক্রান্ত লোকজন হামলা, হয়রানি, এবং হুমকির শিকার হচ্ছে, পাশপাশি তারা, তাদের শান্তিপূর্ন সম্মিলিত প্রতিবাদী কর্মকাণ্ড এবং যৌথ ভাবে মানবিক অধিকার রক্ষার প্রচেষ্টার কারণে তাদের অযৌক্তিক ভাবে গ্রেফতার এবং মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে”।
জাতিসংঘের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আরো কয়েকজন তাদের মতামত প্রদান করেছে, তারা এই প্রকল্প বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে:
ভারতের উড়িষ্যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার সুবৃহৎ ইস্পাত নির্মাণ কোম্পানী পোসকোর বিশাল আকারে এক ইস্পাত কারখানা এবং বন্দর নির্মাণের ক্ষেত্রে হাজার হাজার নাগরিকের যথাযথ নিরাপত্তা এবং অধিকারের বিষয়সমূহের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নিশ্চিত না করে প্রকল্পটি যেন এগিয়ে নিয়ে না যাওয়া হয়।
চাই কাদাই ব্লগ সংবাদ প্রকাশ করেছে যে এই সমস্ত তথ্যচিত্রের কয়েকটি দেবেন্দ্র সোয়িন ধারণ করেছে, যে ইন্ডিয়া আনহার্ড ; সম্প্রদায়ের এক সংবাদদাতা যে কিনা একই সাথে পোসকো বিরোধী এক একটিভিস্ট:
মিথ্যা অভিযোগে ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে দেবেন্দ্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে, তাকে কুজং কারাগারে প্রেরণ করে যেখানে তাকে ২৬ দিন আটকে রাখা হয় এবং ১ মার্চ, ২০১৩ তারিখে জামিনে মুক্তি প্রদান করে।
পোসকো ইন্ডিয়া , ভারতে তার এই কার্যক্রমে কোন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা জোরালো ভাবে অস্বীকার করেছে:
পোসকো, সব সময় উড়িষ্যা সরকারের কাছে আহবান জানিয়েছে যেন সরল গ্রামবাসীর মানবাধিকার এবং জীবন জীবিকার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের অবৈধ হামলার ঘটনা খারিজ করে এ ধরনের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে।
স্টপ পোসকো ক্যাম্পেইন এবং ভিডিও ভলান্টিয়ার্স -এর ওয়েবসাইটে এই বিষয়ে আরো তথ্য পাওয়া যাবে।