সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া অর্থনৈতিক শীর্ষ সম্মেলনের (এসএইএস) বিশেষজ্ঞদের মতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেলেও, দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের মত সমস্যার সমাধান করতে হলে এদের হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে।
এসএইএস হল দক্ষিণ এশিয়ার সুশীল সমাজের প্রমুখ চিন্তাবিদদের এক প্রয়াস। এই বছরের এসএইএস-এর অধিবেশন ২০১৩ সালের ২রা থেকে ৪ঠা সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কাতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর এর আয়োজক ছিল এই দ্বীপের অর্থনৈতিক কর্মপন্থার বিশিষ্ট চিন্তাগোষ্ঠী দি ইন্সটিটিউট অফ পলিসি স্টাডিজ অফ শ্রীলঙ্কা (IPS)। ২০০৮ সাল থেকে এসএইএস-এর অধিবেশন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
এই বছর এসএইএস-এ মানব সম্পদের ব্যবহার, জল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের মত আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং আঞ্চলিক স্তরে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। “আরও শক্তিশালী, প্রগতিশীল ও সামুদায়িক দক্ষিণ এশিয়ার দিকে”- এই মূল বিষয়ের ওপর আয়োজিত তিন দিন ব্যাপী এই শীর্ষ সম্মেলনের বিভিন্ন আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণের জন্য কলোম্বোতে একশ কুড়ি জন বিশিষ্ট আর্থ-সামাজিক বিশেষজ্ঞ একত্রিত হয়েছিলেন।
এই সম্মেলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সামাজিক সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সক্রিয় যোগদান। সম্মেলনের ব্লগ, ফেসবুক , ফ্লিকার আর টুইটার চ্যানেল অবিরত আলোচনায় মুখর ছিল। পুরো সম্মেলনের লাইভ ওয়েবকাস্ট করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের যুব প্রতিনিধি ও ব্লগার তাহমিনা শফিক এই শীর্ষ সম্মেলনের উদ্দেশ্য ও যোগদানকারী দেশগুলোকে যে সব সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় সে সম্বন্ধে লিখেছেন:
এই শীর্ষ সম্মেলন সার্কভুক্ত আটটা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অংশীজনদের একত্রিত করেছে। এই অংশীজনরা বিশিষ্ট থিঙ্কট্যাঙ্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নীতি পর্যালোচনাকারী সংগঠন আর আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য। কিন্তু এই সম্মেলনের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল যুব নেতাদের প্রতিনিধিত্ব, যারা এর প্রধান আলোচ্য বিষয়ের বিশ্লেষণ ও প্রচারের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। এটা নিঃসন্দেহে এই সম্মেলনকে চিরাচরিত ভাবে বন্ধ ঘরে অনুষ্ঠিত সুশীল সমাজের যে আলোচনার ধারা তার থেকে স্বতন্ত্র করেছে আর এই ধরনের সহযোগিতামূলক উদ্যোগে যুব নেতাদের সামিল করার জন্য একটা দরজা খুলে দিয়েছে।
বর্তমান সময়ে যখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করার আশু প্রয়োজন তখন এই শীর্ষ সম্মেলনের প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি, ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ এবং সামগ্রিক উন্নতির প্রেক্ষাপটে দ্রুত উন্নতিশীল এই অঞ্চল অসংখ্য প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। দারিদ্র্য, লিঙ্গ সমতা, খাদ্য নিরাপত্তা, আবহাওয়ার পরিবর্তন, আর অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য দরকার আরও সুবিন্যস্ত ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।

ইয়াসা সামিহর সৌজন্যে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির আলোকচিত্রের সঙ্কলন। সিসি বাই (আলোকচিত্রী সম্পর্কে আরও তথ্যের জন্য ছবিতে ক্লিক করুন))
শ্রীলঙ্কার ব্লগার ও যুব প্রতিনিধি আবদুল হালিক আজিজ কলম্বোর আবহাওয়ার পরিবর্তন ও এই অঞ্চলের ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে বলেছেন:
অনিশ্চিত মৌসুমি বায়ু শহরের অফিস যাত্রীদের জন্য শুধুমাত্র ছাতা নেওয়ার ঝামেলা হলেও, দেশের কৃষি অঞ্চলে এর প্রভাব মারাত্মক, সমুদ্র পৃষ্ঠের ক্রমবর্ধমান উচ্চতা নিচু দ্বীপ গুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন করছে, হিমালয়ের তুষার আচ্ছাদন গলে যাওয়ায় জলের স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি ব্যাহত হচ্ছে আর কলম্বো আরামদায়ক শীতল আবহাওয়া উপভোগ করলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোকে দীর্ঘমেয়াদী অসহ্য গরমের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। যেভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে অচিরেই গল ফেস অঞ্চলে পদচারনা সাঁতার কাটায় রূপান্তরিত হবে। এই সব পরিবর্তন লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে আর এই অঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়া, যা এমনিতেই প্রচুর প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করছে, তাকেও ব্যাহত করছে।
আফগানিস্তানের এক যুব প্রতিনিধি ও ব্লগার আরইয়া নিজাত রাজনীতিকে দায়ী করে বলেছেন :
“আফগান ও ফরাসী বংশোদ্ভূত ‘দি পেশেন্স স্টোন’-এর লেখক আতিক রাহিমি লিখেছিলেন: আফগানিস্তানের মত ইরানেও (আর হয়ত দক্ষিণ এশিয়ায়) মানুষের আওয়াজই পারে স্বৈরাচারকে হার মানাতে… অস্তিত্ববাদের মূল সমস্যা “হবে কি হবে না” ( টু বি অর নট টু বি) তাই নিয়ে নয়… আসল প্রশ্ন হল বলা হবে কি হবে না… তাই যে কোন বিষয় রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি নীরবতাও। মিথ্যাও… সমস্যাটা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে, কারণ আমাদের সবার মনের জানলা গুলো কুলুপ আঁটা… এখন প্রশ্ন হল আমরা কি রাজনৈতিক ভাবে সাহিত্যের যে গুরুত্ব আছে সেটা অস্বীকার করবো? আমার মতে না, কারণ সাহিত্য হল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটা লড়াই। এটা হল ক্ষমতার আওয়াজের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার ক্ষমতা।”
শীর্ষ সম্মেলনের শেষ দিন একটি পোস্টে নিজাত প্রশ্ন তুলেছেন, “আমরা কি আসল প্রশ্নটা নিয়ে আলোচনা করছি?”:
সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য কি একই? এদের স্বার্থের কি কোন মিল আছে যার ওপর ভিত্তি করে একটা অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা যেতে পারে? আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করছি না কেন?
ভারতের যুব প্রতিনিধি নন্দীশ কেনিয়া,বেসরকারি ভাবে এই পরিবর্তন আনা সম্ভব কিনা তাই নিয়ে আলোচনা করেছেন:
একটা বিতর্ক যেটা বারবার উঠে এসেছে সেটা হল একজন কৃষক যদি তার ছোট এক টুকরো জমির জন্য প্রচুর টাকা পায় তাহলে সেটা কোন শিল্পপতিকে বেচে দেওয়া কি অন্যায়? সবুজ বিপ্লবের অন্তরায় হওয়ার জন্য কি তাকে দায়ী করা যায়?
নেপালের যুব প্রতিনিধি তৃষা রানা, মন্তব্য করেছেন যে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ১৯৮৫ সালে স্থাপিত সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন (সার্ক), দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে কোন পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে। :
যেখানে আমরা আমাদের ব্যবহারিক ও অর্থকরী স্বার্থেরই মেলবন্ধন ঘটাতে পারিনি সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মনকে এক করবো কিভাবে?
টুইটারেও এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে:
পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ নাদিম হক (@nadeemhaque) লিখেছেন:
#saes2013. Food security: quality, affordability better distribution. Not possible w/o growth which snot possible w/o governance reform.
— Nadeem Haque (@nadeemhaque) September 3, 2013
খাদ্য নিরাপত্তা: উন্নত গুণমান, সুলভ ও সস্তা। এসব উন্নয়ন ছাড়া সম্ভব না আর উন্নয়ন শাসন প্রণালীর সংস্কার ছাড়া ঘটতে পারে না।
#saes2013 so we want, no poverty, food, no disaster, free education,free health, water security, now sanitation but no growth no reform
— Nadeem Haque (@nadeemhaque) September 4, 2013
তো এখন আমরা চাইছি দারিদ্র্য থাকবে না, খাদ্য থাকবে, কোন বিপর্যয় ঘটবে না, বিনা পয়সায় শিক্ষা, চিকিৎসা, জলের নিরাপত্তা আর নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকবে, কিন্তু সংস্কার আর উন্নয়নের দরকার নেই।
গুগলের উচ্চ পর্যায়ের কার্যনির্বাহক অ্যান ল্যাভিন এই সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছিলেন। শ্রীলঙ্কার আবদুল হালিক আজিজ (@HalikAzeez) লিখেছেন:
The internet contributes avg of 1.9% of GDP growth and generates 3.2 jobs for every one that is lost in emerging mkts – Ann Lavin #Saes2013
— abdulkhaleq (@HalikAzeez) September 4, 2013
জিডিপি-র বৃদ্ধিতে ইন্টারনেটের অবদান গড়ে ১.৯% আর উঠতি বাজারে খোয়ানো প্রতিটা কাজ পিছু ইন্টারনেট ৩.২ টা নতুন কাজ সৃষ্টি করে -অ্যান ল্যাভিন