ভারতে গায়ের ফর্সা রংয়ের প্রতি অনেক মানুষের দুর্বলতা রয়েছে। এই দুর্বলতা দূর করে সব ধরনের ত্বকের সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠার একটি আন্দোলন শুরু হয়েছে।
২০০৯ সালে একদল নারী ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল‘ প্রচারণা প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩ সালে পুরস্কার বিজয়ী পরিচালক-অভিনেত্রী নন্দিতা দাস প্রচারণা কার্যক্রমে যোগ দিলে এটি আরো বেগবান হয়। তিনি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গায়ের কালো রং নিয়ে যে নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত তার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যম এবং মূলধারার মিডিয়াতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, এর কারণগুলো নিয়ে সক্রিয়ভাবে কথা বলছেন।
ভারতের বেশিরভাগ মানুষ গায়ের ফর্সা রং চায়! কেননা তারা মনে করেন কালো রংয়ের ত্বক হল কুৎসিত। এবং এটা তাকে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে রাখে। গায়ের ফর্সা রং শুধু সৌন্দর্যের স্বরূপ-ই নির্দেশ করে না, এটা তাকে আত্মবিশ্বাসী, সফল এবং সুখী করে তোলে।
আর এই সুযোগটা নেয় ক্রিম, লোশন, সাবান, প্রসাধনীর মতো রং ফর্সাকারী ব্র্যান্ডগুলো। আর্টলান্টিক ম্যাগাজিনের প্রতিবদেন অনুযায়ী ভারতে এই রং ফর্সাকারী শিল্প বছরে ৪০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি ব্যবসা করে, যা কোকা-কোলা এবং চায়ের বিক্রির চেয়ে বেশি। বছর কয়েক আগে রং ফর্সাকারী একটি পণ্যের ফেসবুক অ্যাপস বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল (গ্লোবাল ভয়েসেস প্রতিবেদন দেখুন)।
বস্তুত ভারতের বাঙালি সমাজে গায়ের রং নিয়ে সবচে’ বেশি মতভেদ রয়েছে। যদিও বিশ্ববাসী, ভারতীয়দের গায়ের রং বাদামি হিসেবেই দেখে থাকেন। তাই এখানে আপনি গায়ের রং-গুলোকে ‘ধবধবে ফর্সা’, ‘ফ্যাকাশে ফর্সা’, ‘দুধে আলতা’ ‘স্বাভাবিক ফর্সা’, ‘উজ্জ্বল ফর্সা’ থেকে ‘উজ্জ্বল শ্যামলা’ হয়ে ‘কুচকুচে কালো’ হিসেবে দেখতে পাবেন।
সম্প্রতি যদিও গায়ের রংয়ের পুরোনো সংস্কার থেকে বের হয়ে সৌন্দর্যের আরো বড় পরিসরে আসার আহবান জানানো হচ্ছে। তারপরেও গায়ের রংয়ে আত্মবিশ্বাস এবং সফলতার ধারনা বাড়ছে। কেন এই পরিবর্তন জরুরি তা ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ ক্যাম্পেইনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে:
Dark is Beautiful is an awareness campaign that seeks to draw attention to the unjust effects of skin colour bias and also celebrates the beauty and diversity of all skin tones.
Launched in 2009 by Women of Worth, the campaign challenges the belief that the value and beauty of people (in India and worldwide), is determined by the fairness of their skin. This belief, shaped by societal attitudes and reinforced by media messages, is corroding the self-worth of countless people, young and old.
‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ একটি সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন। এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে গায়ের রংয়ের প্রতি যে অযথাই দুর্বলতা আছে সেই প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে সব ধরনের রং ও সৌন্দর্যকে উদযাপনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
২০০৯ সালে উইমেন অব ওয়ার্থ ক্যাম্পেইনটি শুরু করে। ক্যাম্পেইনের মূল চ্যালেঞ্জ হলো গায়ের ফর্সা রংয়ের মূল্যবোধ এবং সৌন্দর্য নিয়ে মানুষের বিদ্যমান বিশ্বাস (ভারত এবং বিশ্বব্যাপী)। সামাজিক আচরণের মাধ্যমে এই বিশ্বাস একটি মাত্রা পেয়েছে। মিডিয়া মেসেজ দেয়ার মাধ্যমে একে শক্তিশালী করে তুলেছে। যা আবাল-বৃদ্ধ অগণিত মানুষের আত্মমর্যাদাকে ক্ষয় করেছে।
ক্যাম্পেইন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা শুরু হওয়ার পর তা মূলধারার মিডিয়ার গোচরে আসে।
টুইটারে তাদের বার্তা ছিল উচ্চকিত এবং পরিষ্কার:
Say NO to Stupidity and Colourism… http://t.co/NiWGttKykl
— Dark is Beautiful (@disbcampaign) August 10, 2013
বোকামি এবং গায়ের রংয়ের পার্থক্য-কে না বলুন…
ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে গত ১৫ আগস্ট ২০১৩ তারিখে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়, যেখানে ভারতীয়দেরকে “১.২ বিলিয়ন সৌন্দর্যময় রংয়ের সাথে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে”র আহবান জানানো হয়।
“ডার্ক ইজ বিউটিফুল” প্রচারণার আপলোড করা ভিডিওটি এখানে আছে। ভিডিওটিতে ভারতের গায়ের রংয়ের বিপুল বৈচিত্র্যকে উদযাপন করা হয়েছে:
ক্যাম্পেইনটি অনলাইনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। টুইটারে কিছু প্রতিক্রিয়া এসেছে যেখানে ফর্সা ত্বক এবং রং ফর্সাকারী পণ্যের প্রতি মনোভঙ্গি কেমন তা দেখা গেছে। অনেকেই আশা প্রকাশ করেছেন, এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সৌন্দর্যকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ভালোভাবেই পাল্টে যাবে। তাছাড়া এই আলোচনার মাধ্যমে গায়ের রং নিয়ে মানুষের যে পুরোনো সংস্কার রয়েছে, তা লাঘব হবে।
কলকাতা থেকে ফার্স্ট পোস্ট ডট কম (Firstpost.com) এর সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক সন্দীপ রায় (@sandipr) লিখেছেন:
66 years after Independence India still craves Fair and Lovely, not Dark is Beautiful. David vs Goliath story http://t.co/QU1bCcWkP6 via @kalw
— Sandip Roy (@sandipr) August 14, 2013
ভারতের স্বাধীনতার ৬৬ বছর পরে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী'র প্রতি ব্যগ্রকামনা ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ নয়। এ যেন ডেভিড বনাম গোলিয়াথের গল্প। @kalw থেকে।
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবস্থাপনা বিষয়ের পরামর্শক এবং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যকর্মী পারুল বাট্রা (@parul_batra) টুইটারে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, রং ফর্সাকারী পণ্যগুলো সবচে’ বেশি অর্থ উপার্জনকারী প্রতিষ্ঠান:
Fairness cream market is $432M in India, larger than coca cola and tea. Let's get over this silly obsession. Support http://t.co/A4fZGZDK8h
— Parul Batra (@parul_batra) August 16, 2013
ভারতে ৪৩২ মিলিয়ন ডলারের রং ফর্সাকারী ক্রিমের বাজার রয়েছে। যা কোকাকোলা এবং চায়ের বাজারের চেয়েও বেশি। আমাদের এই হাস্যকর অবস্থা কাটাতে হবে। ডার্ক ইজ বিউটিফুলকে সমর্থন দিন।
মুম্বাইয়ের সিনেমা পরিচালক শেখর কাপুর (@shekharkapur) বিজ্ঞাপনকে অভিযুক্ত করেছেন:
Are fairness creams just satisfying a demand? Y does their advertising then try n make u feel bad about ur skin color?They r creating demand
— Shekhar Kapur (@shekharkapur) August 13, 2013
মানুষের চাহিদাকে কি রং ফর্সাকারী ক্রিম তুষ্ট করতে পারে? তাদের বিজ্ঞাপন কি আপনার গায়ের রং নিয়ে দুর্ভাবনার অনুভব তৈরি করে? তারা চাহিদা তৈরি করছে।
দিল্লির সাংবাদিক এবং প্রযুক্তি বিষয়ক লেখক মাধবন নারায়ণ (@madversity) টুইট করেছেন:
Darkness creams involve fair criticism. Fairness creams are best handled with dark humour
— Madhavan Narayanan (@madversity) August 19, 2013
কালো রং ফর্সার করার ক্রিম সৌন্দর্যের সমালোচনায় জড়িত। রং ফর্সাকারী ক্রিমগুলো গায়ের কালো রং-কে ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
মুম্বাইয়ের কগনিটিভ ডিজন্যান্স (@_HJ86) রং ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনের ভণ্ডামির কথা তুলে ধরেছেন:
We live in a world where fairness cream is marketed aggressively and expect people not to be racist about colour @madversity
— Cognitive Dissonance (@_HJ86) August 19, 2013
আমরা যে বিশ্বে বাস করি সেখানে রং ফর্সাকারী ক্রিমের ভয়ানক বাজার রয়েছে। আশা করবো, মানুষজন রং বিদ্বেষী হয়ে উঠবে না। @madversity
ত্রিভানদ্রামের লিলি (@lillyvgp) ব্যাপক আশাবাদী এই ক্যাম্পেইন নিয়ে:
I sincerely hope Nandita Das’ ” Dark is beautiful. Stay unfair campaign” becomes a great success so at least my grandkids won't face racism.
— Lilly (@lillyvgp) August 15, 2013
নন্দিতা দাসের ”ডার্ক ইজ বিউটিফুল। স্টে আনফেয়ার ক্যাম্পেইন” নিয়ে আমি ব্যাপক আশাবাদী। এটা তুমুলভাবে সফল হবে। আমার সময়ে না হোক, অন্তত আমার নাতিপুতিরা রং বিদ্বেষের বাইরে বেড়ে উঠুক।
ডার্ক ইজ বিউটিফুল ক্যাম্পেইন রং ফর্সকারী পণ্যের ব্র্যান্ড এবং বিপণনকারীদের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছে। তাদেরকে বৈষম্যমূলক বিজ্ঞাপন প্রচার না করতে অনুরোধ করেছে। উল্লেখ্য, বিজ্ঞাপনগুলোতে ফর্সা ত্বককে সাফল্যের অগ্রদূত হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রসাধনী কোম্পানি ইমামীর ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসামের সর্বশেষ বিজ্ঞাপনটি তুলে নিতে একটি অনলাইন পিটিশন করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনটিতে বলিউডের সুপারস্টার শাহরুখ খান অভিনয় করেছেন। শাহরুখ খান ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসামের একজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। ক্যাম্পেইনের প্রতিবেদন অনুসারে:
This petition is the latest initiative of the Dark is Beautiful campaign. Since 2009, the campaign has been challenging women and girls to see “Beauty Beyond Colour”. Now, with this change.org petition, we are speaking up for men and boys, who are also targets of “unfair” advertising.
“ডার্ক ইজ বিউটিফুল” ক্যাম্পেইনের সাম্প্রতিক উদ্যোগ হলো এই পিটিশন। ২০০৯ সালের এই ক্যাম্পেইনে চ্যালেঞ্জিং নারী এবং মেয়েরা দেখেছে রং-কে ছাড়িয়ে যাওয়া এক সৌন্দর্যকে। বর্তমানে চেঞ্জ.অর্গ পিটিশনে আমরা পুরুষ এবং ছেলেদেরকে জেগে উঠার আহবান জানিয়েছি, যারা এখন বৈষম্যমূলক বিজ্ঞাপনের দর্শকে পরিণত হয়েছেন।
আপনি এই পিটিশনের আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন এখানে। ক্যাম্পেইনে ব্লগ, টুইটার এবং ফেসুবক পাতা অনুসরণ করতে পারেন।