বাংলাদেশ সরকার ঢাকার অদূরে গাজীপুরে পূর্বাচল নতুন শহর [1] প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় জনগণ বলছেন, এই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের ফলে গাজীপুর জেলার [2] ১ হাজার ৬০০ একর কৃষিজমি, সবুজ বনভূমি এবং প্রাণিজগৎ [3] ধ্বংস হয়ে যাবে। পরিবেশ বিভাগের সুপারিশ ছাড়াই প্রকল্পের কাজ চলছে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল মেগাসিটি [4] বলে বিবেচনা করা হয়। ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ৬ মিলিয়ন থেকে ১২ মিলিয়ন ছুঁয়েছে। জাতিসংঘ ভবিষ্যদ্বাণী [5] করেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ঢাকায় ২০ মিলিয়নের বেশি মানুষ বসবাস করবে।
ব্যাপক হারে নগরায়ন [6], গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের ভিড়ের কারণে কিছু সমস্যা [6] তৈরী হচ্ছে। যেমন, দূষণ বাড়ছে, রাস্তাঘাটে ভিড় বাড়ছে, অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পর্যাপ্ত সেবা পাওয়াটাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ৩৬০ বর্গ কিলোমিটারের মেগাসিটি ১৪.৪ মিলিয়ন মানুষের [7] ভার বহন করতে পারছে না।
সরকার ইতোমধ্যে ঢাকা সম্প্রসারণ কর্মসূচী [9] হাতে নিয়েছে। আর এই কর্মসূচীর অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, কদমরসুল, সিদ্ধেশ্বরী এবং তারাব মিউনিসিপ্যালিটিকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে নিয়ে এসেছে। তাছাড়া প্রশাসনিক সেবা দানকে বেগবান করতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে [10]। এর একটি ঢাকা উত্তর এবং অন্যটি ঢাকা দক্ষিণ।
বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে [11], ঢাকার নগরায়িত এলাকা মাত্র ৪৮ শতাংশ। আর এর বড় একটা অংশ (১৮%) তরূ-লতাঘেরা গ্রামীণ জায়গা-জমি দখল করে গড়ে উঠেছে। তাছাড়া নগরায়ন হয়নি এমন বড় একটা এলাকা এখনো কৃষিপ্রধান। দ্রুত নগরায়নের বড় শিকার এই এলাকার বনভূমি এবং কৃষি জমি।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের [12](রাজউক) ওয়েবসাইটে পূর্বাঞ্চল নতুন শহর প্রকল্প সম্পর্কে বলা হয়েছে:
এটি দেশের সবচে’ বড় টাউনশিপ প্রকল্প। প্রকল্পটি ৬১৫০ একর জমি নিয়ে গঠিত, যা ঢাকার উত্তর-পূর্বের নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার শীতলক্ষ্যা এবং বালু নদীর মধ্যবর্তী স্থানে এবং গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানায় অবস্থিত। […]
২০০২ – ২০০৩ অর্থ বছর থেকে নারায়ণগঞ্জ অংশের ৪৫০০ একর জমিতে উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। আর গাজীপুর অংশে বাকী কাজ ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে।
গাজীপুর শাল [13] বনের জন্য বিখ্যাত। তাছাড়া এখানে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান [14] অবস্থিত। এটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংরক্ষিত এলাকাও। রাজউক একটি জমি জরিপের কাজ [15] করেছে। সেখানে ৪২.৪৬ শতাংশ এলাকা বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত, ৩৯.৪৭ শতাংশ এলাকা কৃষি ভুমি এবং ৯.৭৫ শতাংশ এলাকা বাস্তুভিটা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পত্রিকার সংবাদেও [16] বলা হয়েছে, পূর্বাঞ্চল নতুন শহর উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে গাজীপুরের বিপুল পরিমাণ শালবন এবং ব্যাপকভাবে প্রাণি এবং উদ্ভিদকুল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ দপ্তর রাজউককে বনভূমি এলাকা পরিহার করে প্লট বরাদ্দে সুপারিশ করেছে। কিন্তু পরিবেশ দপ্তরের এই সুপারিশ মানা হয়নি। শুধু এই আবাসন প্রকল্পের জন্য নয়, নানা কারণে [17] শালবন ধ্বংস করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বোম্বিং প্রশিক্ষণের জন্য শাল গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। আবার সামাজিক বনায়ন কর্মসূচীর আওতায়ও শাল গাছ কেটে সেখানে পরিবেশ বিধ্বংসী ‘আকাশিয়া’ গাছ লাগানো হচ্ছে।
গাজীপুর ঘুরে এসে অনলাইন সংবাদ সংস্থা ইউএনবি কানেক্ট-এর ফয়সাল রহমান [19] লিখেছেন:
ভুমি উন্নয়নের কারণে বারকাউ, বাসাবাসি, কালীকুঠি, পূর্বা তালনা এবং পারাবারতা গ্রামের মানুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা আমাদের টিমকে সাম্প্রতিক সময়ে কাটা বিপুল পরিমাণ গাছ দেখালেন। গাছগুলোর বেশিরভাগ কাঁঠাল, আম, বাঁশ এবং শাল। […]
পাদারির বিলের ১৫০ একর ধানী জমি ইতোমধ্যে ভরে ফেলা হয়েছে। এই বিলের আয়তন প্রায় ৮০০ একর। বর্ষার সময়ে এখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।
যে এলাকায় প্রকল্প গড়ে উঠছে, ব্লগার বিপ্লব বিশ্বাস [20] সেখানেই বাস করেন। তিনি জমি অধিগ্রহণের জন্য এখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের যেভাবে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তা নিয়ে আমার ব্লগে লিখেছেন:
যেখানে এখন জমি দাম হচ্ছে বিঘা প্রতি ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা সেখানে রাজউক ৯৫ সালের ভুয়া দলিল অনুসারে জমির দাম দিচ্ছে মাত্র ১ লাখ টাকা বিঘা। শুধু কি তাই, কোন গ্রামবাসী যদি বিল আনতে যায়, সরকারি ও রাজউকের কর্মচারীরা ঘুষের জন্য প্রায় তার পুরো বিলের টাকাই রেখে দেয়। যদি সে বলে যে তাহলে আমি কি পেলাম?, আমার জমি-জমা, বাড়ি-ঘর সবই সরকার কে দিয়ে দিলাম, আমি তাহলে কি পেলাম?, আর আমি এখন কি নিয়ে থাকবো, আমার ভবিষ্যৎ চলবে কি করে?
যারা জমি দিতে অস্বীকার করেছে, পুলিশ এবং ঠিকাদারের গুণ্ডারা তাদের কিভাবে হেনস্তা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা দেয়া হচ্ছে, সেসব বিষয়ও ব্লগার তার লেখায় তুলে এনেছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেছিল। রিট আবেদনে তারা বলেছিল, পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের জন্য গাজীপুরের বারকাউ এবং পারাবত এলাকার জমি ভরাট এবং নির্মাণ কাজের জন্য পরিবেশ দপ্তর থেকে পরিবেশ ছাড়পত্র পায়নি। গত ১ আগস্ট ২০১৩ তারিখে হাই কোর্ট [21]নতুন কোনো আদেশ না দেয়া পর্যন্ত গাজীপুরের পূর্বাঞ্চল আবাসন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন এবং ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস অব বাংলাদেশ-এর মতো কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন গাজীপুরে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে [23]নিচের দাবিগুলো করে:
১. রাজউক এর পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম অবিলম্বে সম্পূর্ণ বন্ধ করা।
২. পূর্বাচল প্রকল্পের নামে পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের ক্ষতি নিরূপণ করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা।
৩. পূর্বাচল প্রকল্পের নামে এরূপ বিধ্বংসী এবং অমানবিক কর্মকাণ্ডে জড়িত রাজউকের কর্মকর্তাকে দৃষ্টান্তমূলক শান্তি প্রদান করা।
৪. নিরীহ এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার করা।
ব্লগার বিপ্লব বিশ্বাস [24] অন্য একটি পোস্টে লিখেন:
বাহিরের মানুষ সবাই খুব মজা পাচ্ছে এখানে পৃথিবীর আধুনিকতম শহর হবে, সেই শহরে বসবাস করবে অতি সুখের সাথে। কিন্তু তারা কি একবারও সেই মানুষ গুলির অনুভূতি টুকু অনুভব করেছেন, যাদের চৌদ্দ পুরুষের সঞ্চিত শেষ সম্বলটুকু জোর করে কেড়ে নিয়ে এই শহর বানানো হচ্ছে, যে মানুষ গুলির শিকড় উপড়ে তুলে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে মারা হচ্ছে, যে মানুষ গুলিকে সর্বস্ব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। জানি না, কেউ তাদের এই কষ্টের সামান্যতম অংশও অনুভব করতে পেরেছেন কি না।
সারাবিশ্বে গড় বনভূমির পরিমাণ [25] ২৬ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে বনভুমির পরিমাণ মাত্র ১৮ শতাংশ [26]। এখন যা আছে, তা যদি রক্ষা করা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে দেশটি পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।