ওরা বাইশ জন। প্রত্যেকের বয়স চার থেকে বারো বছরের মধ্যে। ওরা সবাই ভারতের বিহার রাজ্যের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত ১৬ জুলাই ২০১৩ তারিখে স্কুলে দুপুরের খাবার খেয়ে ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে। ওদের দেয়া দুপুরের খাবার ছিল ভেজাল, কীটনাশকযুক্ত।
ঘটনাটি ঘটেছে রাজ্যের চাপরা জেলার একটি গ্রামে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বেশিরভাগই গরীব। গুরুতর অসুস্থ আরো অনেককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সবার ধারণা, খাবারে কীটনাশক মেশানো ছিল।
এ পর্যন্ত স্কুলে খাবার খেয়ে যতোগুলো ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যেই এটাই সবচে’ বেশি বেদনাদায়ক। অন্য একটি ঘটনায় বিহারের মধুবাণী জেলায় স্কুলে দুপুরের খাবার খেয়ে ১৫ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। গয়া-বিহারে স্কুলে দুপুরের খাবার খেয়ে একজন শিক্ষার্থী মারা গিয়েছিল। মহারাষ্ট্রের ঢুলে জেলায়ও স্কুলে দুপুরের খাবার খেয়ে ৩১ জন শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল।
ভারতের স্কুলগুলোতে দুপুরের খাবার কর্মসূচি চালু হয় ১৯৬০ সালে। এটা ভারতের সবচে’ পুরোনো সাহায্য কর্মসূচি। এর উদ্দেশ্য হলো ভারতের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদেরকে তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে উৎসাহিত করা। স্কুলে ভর্তি হতে উৎসাহ দিতে পড়াশোনার পাশাপাশি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দুপুরের খাবার দেয়া হতো। যদিও এই কর্মসূচি চালু হওয়ার পর থেকেই অভিযোগ আসতে থাকে শিক্ষার্থীদের খাদ্য আত্মসাতের। ২০০৬ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দার্জিলিংয়ের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৮ মাস ধরে দুপুরের খাবার থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
প্রত্যাশিত ভাবেই এই ইস্যুটিতে রাজনৈতিক রং লাগানো হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারি দল অভিযোগ করেছে, সরকারের সুনাম নষ্ট করতে বিরোধী দল এই কাজ করেছে। খবরে বেরিয়েছে, স্কুলের প্রিন্সিপালের স্বামী একজন রাজনৈতিক নেতা। তিনিই ওই স্কুলে খাদ্য সরবরাহ করতেন।
এদিকে সরকারের অবহেলায় এ ধরনের বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটায় সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
ভারতের টুইটার ব্যবহারকারী ভিক্রম সিং (@cynicalvs) লিখেছেন:
@cynicalvs: দুপুরের খাবার খেয়ে বাচ্চারা কীভাবে মারা যায়? এটা খাবার। কেউ বোধহয় হত্যার চেষ্টা করেছে। #chappra
ঘটনা ঘটার পরপরই সাংবাদিকরা হাসপাতালে যান বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন লেখার জন্য। তখন অনেক অসঙ্গতিই উঠে আসে। ভিডিও ছবিতে দেখা যায়, বেঁচে যাওয়া শিক্ষার্থীরা ডেস্কের ওপরে একে অপরের পাশে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। তাদের স্যালাইন দেয়া হচ্ছে।
এবিপি নিউজের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মিলিন্দ খন্দকার (@milindkhandekar)লিখেছেন:
@milindkhandekar:চাপরার ছবিগুলো কাগজে বের হয়েছে। আর সেই কাগজ দিয়ে পাখা বানিয়ে আত্মীয়-স্বজনরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বাতাস করছে। এটা কী উন্নয়নের বিহার মডেল?
এই ধরনের ঘটনা অচিরেই আরো ঘটবে। তাই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা ভারতীয় রাজনীতিবিদদের অবহেলা এবং দাম্ভিকতা নিয়ে আলোচনার অনুরোধ করেছে।
দিল্লীর সাংবাদিক অভিজিৎ মজুমদার (@abhijitmajumder), টুইট করেছেন:
@abhijitmajumder: আমাদের রাজনীতিবিদরা কোনো বৈষম্য করে না। এনআরইজিএ'র জন্য টুজি, গরীবদের জন্য দুপুরের খাবার, রসস্বাদনের জন্য দুটোই সমানভাবে ছিনতাই করে। #Chhapra
সম্প্রতি টুজি এবং এনআরইজিএ‘র কেলেঙ্কারির ঘটনা দুটির উল্লেখ করেছেন মজুমদার। এই দুটি ঘটনায় ভারত সরকারের বিলিয়ন পরিমাণ ডলার নয়ছয় হয়েছে।
দিল্লীর আরেক সাংবাদিক রাঘবেন্দ্র ভার্মা (@r_verma) সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষকদের সাধারণ আচরণ নিয়ে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন:
@r_verma: স্কুলের শিক্ষকরা বাচ্চাদের দুপুরের খাবার দেন, যদি বাচ্চারা তাদের জন্য বড় কোনো কাজ করে দেয়। #Chhapra
মুম্বাইয়ের টুইটার ব্যবহারকারী ফজল আব্বাস (@fazlabas)সাম্প্রতিক আলোচনার কিছু ঐতিহাসিক দিক তুলে এনেছেন:
@fazlabas: চাপরা ৫০ বছর আগের আমাদের প্রথম প্রেসিডেন্ট ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের মতোই। শিক্ষার জন্য বাচ্চারা মারা যাচ্ছে।
দিল্লীর সাবেক পুলিশ অফিসার, সমাজসেবী, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণাকারী কিরণ বেদী (@thekiranbedi) টুইট করেছেন:
@thekiranbedi: দুপুরের খাবার কেচ্ছা-কেলেংকারীর জন্ম দিচ্ছে। এটা অস্বাস্থ্যকরও। এটা রান্না করতে গিয়ে শিক্ষকদের অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে। ওদের কেন ফল এবং বাদাম দেয়া হয় না?
বেদীর কথার সাথে উপরের সংযুক্ত ছবির মিল আছে। শুধু বিহার নয়, সরকার পরিচালিত স্কুল সারা ভারত জুড়েই রয়েছে। আর এসব স্কুলগুলোতে রয়েছে অবহেলা আর অব্যবস্থাপনা। এদিকে বিহারের ঘটনায় সরকার ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারদের প্রত্যেককে দুই লাখ রুপি (৩,৩৬৭ মার্কিন ডলার) ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
স্বল্প বা দীর্ঘকালীন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সত্ত্বেও, খাবার কীভাবে দূষিত হলো তার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে গবেষণা করা দরকার। তবে যারা অপরাধী তাদের কি দায়ী করা হবে?