ইয়েমেন আরব উপদ্বীপের দক্ষিণের একটি দেশ। এর রয়েছে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর ইতিহাস। এখানকার মানুষজন বন্ধুবত্সল আর অতিথিপরায়ণ। কিন্তু সেগুলো খবরে না এসে প্রায় দেশটি পশ্চিমা মিডিয়ায় নেতিবাচকভাবে উঠে আসে।
ইয়েমেনে নানা ধর্ম, মতের, ভাষার ২৪ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে “যা আল কায়েদা অথবা আরব উপদ্বীপের আল কায়েদা, যুদ্ধ, দারিদ্র্য, মাদক, উপজাতীয় দ্বন্দ্ব অথবা ওসামা বিন লাদেনের পিতৃভুমির কাছে ম্লান হয়ে গেছে… ইয়েমেন আল কায়েদার সংবাদে ঢেকে গেছে।” – লিখেছেন ব্লগার আতিয়াফ আলীওয়াজির (@womanfromyemen) তার “ইয়েমেনের আখ্যানে মিডিয়ার খুঁত” পোস্টে:
আজকাল ইয়েমেনের ওপর সাংবাদিকতায় সত্যের লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এগুলো মানুষদেরকে উত্সাহ জোগায় না। এখনকার ব্যাপারস্যাপারই হলো রোমাঞ্চকর কাহিনি লেখা। কতোবার যে এ বিষয়ে লেখা হয়েছে, তার ইয়াত্তা নেই। তবে তাতে কি, এটাই যে পাবলিক খায়।
তবে ইয়েমেনের একদল কর্মী ইয়েমেনিদের চোখ দিয়ে ইয়েমেনকে সারাবিশ্বের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছেন। এইসব সংবাদ আর সহিংসতার বাইরেও যে ইয়েমেনের সমৃদ্ধ কালচার, অনন্য স্থাপত্য, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, প্রাণবন্ত প্রকৃতি রয়েছে, তারা বিশ্ববাসীকে সেগুলো দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন।
ইয়েমেনকে জানা:
অনেকেই হয়তো জানেন না ইয়েমেন বিশ্বের সবচে’ প্রাচীন সভ্যতাগুলোর একটি। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম মিলেনিয়ামের ইতিহাসে এর উল্লেখ রয়েছে। এ সময়ে এর পরিচিতি ছিল অ্যারাবিয়ান ফেলিক্স বলে। এর মানে হলো সুখী আরব। এমনকি ইয়েমেন চারটি ঐতিহ্যময় স্থান বা হেরিটেজ সাইট রয়েছে। প্রথমটি হলো এর প্রাচীন রাজধানী সানা। এটি বিশ্বের সবচে’ প্রাচীন বসতিগুলোর একটি। পুরোনো এই নগরিতে ১০৩টি মসজিদ, ১৪টি হাম্মাম এবং ৬,০০০ এর বেশি বহুতল ভবন রয়েছে। এই বহুতল ভবনগুলোর অনন্য স্থাপত্য, দামী সুশোভিত কাঁচের জানালা একে দর্শনীয় করে তুলেছে।
(প্রাচীন সানা'র ভিডিও। আপলোড করেছে ইউনেস্কো।)
দ্বিতীয়টি হলো শিবাম। এটি মরুভুমির ম্যানহাটান নামে পরিচিত। বিশ্বের সবচে’ পুরোনো স্কাইস্ক্র্যাপারের নগর বলেও পরিচিত। এখানে ৫০০ এর মতো কাদা-ইটের বাড়ি রয়েছে, যেগুলো এগারো তলা পর্যন্ত উঁচু।
ইয়েমেনের তৃতীয় ঐতিহ্যটি হলো সোকোট্রা দ্বীপ। এটি একটি বৃহত্তম দ্বীপপুঞ্জের অংশ। এর রয়েছে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এবং উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল। ইউনেস্কোর তথ্যমতে, “সোকোট্রা দ্বীপের ৩৭% এলাকায় ৮২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৯০% এলাকায় নানা প্রজাতির সরীসৃপ, ৯৫% এলাকা জুড়ে রয়েজে নানা প্রজাতির শামুক, যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না।”
নিচের ভিডিওতে এক নজরে দ্বীপটি দেখে নিন। ইউটিউবে ভিডিওটি আপলোড করেছেন টুইয়েমেন:
আর সর্বশেষটি হলো ছবির মতো উপকূলীয় শহর জাবিদ। এর সংকীর্ণ গলিপথ আর পোড়া ইটের ভবন, সত্যি অনন্য।
মিডিয়ার বর্ণনাকে ছাপিয়ে
ইয়েমেনের প্রতি মিডিয়ার এই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের লড়াই জারি রয়েছে।
২০ মিনিটের এই ভিডিও সিনেমাটি বানানো হয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিল আয়োজিত জুম শর্ট ফিল্ম প্রতিযোগিতা ২০১০ উপলক্ষে। এটি ইউটিউবে আপলোড করেছে জুমকম্পিটিশন। বিকৃত সংবাদ প্রতিবেদন বিরুদ্ধে ইয়েমেনিদের সাদামাটা জীবন দেখিয়ে ভুল সংশোধনের চেষ্টা করা হয়েছে:
ইয়েমেনের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য জানাতে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বসবাসরত ইয়েমেনি কবি সানা (@Sanasiino) ইয়েমেন সম্পর্কে কবিতা লিখে তা আবৃত্তি করছেন:
(ইউটিউবে ভিডিওটি আপলেঅড করেছে Yemeniah Feda'aih)
আমার ব্লগে খুব জনপ্রিয় একটা পোস্ট আছে। পোস্টটির শিরোনাম “ইয়েমেন… আমার অপরূপা জন্মভুমির কিছু অপ্রকাশিত তথ্য“। পোস্টটিতে ইয়েমেনের অনেক অজানা বিষয় তুলে আনা হয়েছে। যেমন, বিশ্বের সবচে’ ভালো এবং দামী মধু বলে পরিচিত ‘দোয়ানি মধু’, এটা ইয়েমেনে পাওয়া যায়। আবার ইয়েমেন হলো সেই দেশ, যারা ইউরোপবাসীকে সর্বপ্রথম কফি চিনিয়েছিল। তারা মোকা বন্দর দিয়ে ইউরোপে নিজেদের ব্র্যান্ডের কফি রপ্তানি করতো।
৩৫ বছর বয়সী ইয়েমেনি যুবক ফাহদ আকলান বর্তমানে মিশরের কায়রোতে বসবাস করেন। তিনি ফেসবুকে সো ইউ থিঙ্ক ইউ হ্যাভ সিন ইয়েমেন? নামে একটি পেজ চালু করেছেন। এই পেজের লক্ষ্য হলো পত্রিকার সংবাদের মধ্য দিয়ে ইয়েমেন সম্পর্কে যে ভুল ধারণাগুলো তৈরি হয়েছে, তা দূর করা।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাসকারী সামার নাসের নামের ইয়েমেনি ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্ট “পিপল অব ইয়েমেন” নামে আরেকটি ফেসবুক পেজ খুলেছেন। এই পেজের উদ্দেশ্য হলো, ছরি'র মধ্যে ইয়েমেনের সাধারণ মানুষের জীবনকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা।
ইয়েমেনকে তুলে ধরতে অন্যরাও কথা বলেছে। ইয়েমেনে অবস্থানরত সাংবাদিক অ্যাডাম ব্যারন তার ব্লগে বলেছেন:
Others have spoken out in support of the country. Yemen-based journalist Adam Baron said in his Drones-Ad-Hoc hearing testimony:
ইয়েমেনীরা নিয়ম করেই যেন বন্ধুবৎসল ও আপন করে নেয়।
টুইটারে বিশ্ব প্রেস পুরস্কার বিজেতা ফটোসাংবাদিক স্যামুয়েল আরান্দা (@Samuel_Aranda_) একজন বিদেশী হিসেবে এই প্রসস্তিটুকু করেছে:
@স্যামুয়েল_আরান্দা: যারা ভাবেন যে ইয়েমেন শুধুই মৌলবাদের আখড়া তারা অনুগ্রহ করে দেশটিতে এসে দেখুন!! http://www.youtube.com/watch?v=yNMsm1Fl_X8&feature=related…
খাবার-দাবার:
ইয়েমেনে সাধারণত ঘরে তৈরি রুটি আর পাথরের বাসনকোসনে তরকারি রান্না করা হয়। এই ছবি'র খাবারগুলোই দেখুন। সকালের নাস্তা কিংবা রাতের খাবারে এই রুটি, ফাভা বিন, কলিজা থাকে। আর সাথে থাকে দুধ, চা এবং এলাচ।
ইয়েমেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো বিন্ত এল সাহন। ইংরেজিতে অনুবাদ করলে এর মানে দাঁড়ায়- ডটার অব দ্য প্লেট বা পাত্রের কন্যা। আগুনে সেঁকা ময়দার পিঠা স্তরীভূত করে এটা বানানো হয়। আর পরিবেশনের সময় এর উপরে মধু দেয়া হয়। ডেজার্ট হিসেবে নয়, এটা খাওয়া হয় মূল খাবার হিসেবেই।
ইয়েমেনের নানা রকমের খাবার-দাবারের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য চমৎকার একটি ব্লগ রয়েছে। ব্লগটির নাম ইয়েমেনি কিচেন। লেখক ব্লগটির বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “ইতিহাসের মোড়কে ইয়েমেনের খাবার-দাবার”। এখানে শুধু রন্ধনপ্রণালির বর্ণনাই থাকে না, এর পেছনের যে ইতিহাস রয়েছে তাও তুলে ধরে।
সংগীত, নাচ:
ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নাচের নাম হলো বারা। একটি বড়ো সাইজের ছুরি, ইয়েমেনি ভাষায় জানবায়া হাতে দ্রুত তালে এই নাচ নাচতে হয়। নাচের সময় ড্রাম এবং ইয়েমেনি বাঁশি মুজমার বাজানো হয়। নিচে দেখুন, তরুণ ইয়েমেনিরা এই নাচটি কীভাবে পারফর্ম করে। ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করেছেন জিটিভি৩১৩:
আর দক্ষিণে আছে হার্দামট নাচ এবং সংগীত। ইউটিউবে আপনি এই নাচ-গান দেখতে পাবেন। ভিডিওটি আপলোড করেছেন ইয়েমেন রিফর্ম।
ইয়েমেনের বিভিন্ন গান, ছড়া শুনতে নিচের লিংকগুলোতে ঢু মারতে পারেন: আইয়ুব তারিশ জনপ্রিয় ইয়েমেনি গায়ক এবং কম্পোজার। ইয়েমন রিফর্ম আপনাকে ইয়েমেনের বিভিন্ন গায়ক যেমন আলহারেথি, আলনেসি, আলকেবসিদের গানের ইউটিউবের লিংক দিয়ে থাকেন। এছাড়াও আসওয়াত ইযেমেনিয়াতে বিভিন্ন ইয়েমেনি কণ্ঠস্বর পাওয়া যাবে। এখানে আবু বকর সালেম বালফাকিহ, আলী তাহবান এবং মুহাম্মদ মোরশেদ নাজিদের গান শোনা যাবে। ইয়েমেনের সর্বসাম্প্রতিক গানের সংকলন হলো মাই দিওয়ান। আর আহমেদ ফাতহি হলেন ইয়েমেনের পরিচিত সংগীতশিল্পী এবং কম্প্রোজার।
শিল্প, স্থিরচিত্র ও প্রকৃতি:
টুরইয়েমনের আপলোড করা ভিডিওতে ইয়েমেনের শিল্প, সংস্কৃতি এবং দিগন্তবিস্তৃত নয়নাভিরাম প্রকৃতি দেখা যাবে:
ইউটিউবে তোমেরির আপলোড করা আরেকটি ভিডিওতে ইয়েমেনের প্যানারোমিক দৃশ্য দেখা যাবে:
তবে ইয়েমেনের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সব ছবি দেখা যাবে আমেন আল-গাবরি এবং আবু মালিকের ফেসবুক পেজে:
ইয়েমেনের কিছু চিত্রশিল্পী হলেন লামিয়া আল-কিবসি, ফুয়াদ আল-পুতেহ, মাজহার নিজারসহ আরো অনেকের চিত্রকর্ম দেখতে পাবেন এখানে এবং এখানে।
পশ্চিমা মিডিয়ার বিকল্প হিসেবে দ্য ইয়েমেন টাইমস এবং লা ভয়েক্স ডু ইয়েমেন মতো সাইটে ইয়েমেন শিল্প-সংস্কৃতি এবং সামাজিক জীবনের গল্প শুনতে পারেন।