বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে এ পর্যন্ত চার ব্লগারকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গত ১লা এপ্রিল, সোমবার রাতে পুলিশ রাসেল পারভেজ, মশিউর রহমান বিপ্লব এবং সুব্রত অধিকারী শুভকে গ্রেফতার করে [1]। এরপর ৩রা এপ্রিল বুধবার ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে [2] গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের ল্যাপটপ এবং কম্পিউটারও জব্দ করা হয়েছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো ৭ জন ব্লগারকে গ্রেফতার করা হবে [3] বলে জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, গ্রেফতারকৃত ব্লগাররা যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধসহ ৬ দফা দাবিতে চলমান শাহবাগ আন্দোলনের [4] সাথে যুক্ত ছিলেন।
এদিকে আমার ব্লগের অ্যাকসেসও [5] বাংলাদেশ থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমার ব্লগের কাছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ইসলাম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত কয়েকজন ব্লগারের তথ্য চাইলে তারা তা দিতে অস্বীকার করেছিল [6]।
অভিযুক্ত ৮৪ ব্লগার!
ইসলামপন্থী দলগুলো ৮৪ জন ব্লগারের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে এবং ব্লগে ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিয়ে ‘অবমাননাকর’ লেখালিখির অভিযোগ এনেছেন। যদিও ব্লগারদের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ উঠে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনের সময়ে। এই আন্দোলন চলাকালেই ইসলামপন্থীরা অভিযোগ করেন ইসলামবিরোধী নাস্তিক ব্লগাররা শাহবাগে আন্দোলনের পেছনে রয়েছেন। তারা এই ব্লগারদের গ্রেফতারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। তাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার নাস্তিক ব্লগারদের শনাক্ত ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গত ১৩ মার্চ একটি কমিটি করে। গত ৩১ মার্চ কমিটি ইসলামী চিন্তাবিদ এবং আলেমদের সাথে বৈঠক করে। বৈঠকে আলেমরা ৮৪ জন ‘নাস্তিক ও অপপ্রচারকারী’ [7] ব্লগারের তালিকা কমিটির কাছে হস্তান্তর করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। আটককৃত তিন ব্লগার ওই ৮৪ জনের তালিকায় রয়েছেন। এদিকে অভিযুক্ত ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন আগামী ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখী লং মার্চ কর্মসূচীর ঘোষণা দিয়েছে।
ব্লগাররা এর আগে মৌলবাদী শক্তির হাতে মরণঘাতি আক্রমণের [8] শিকার হয়েছিলেন। হত্যা করা হয়েছে শাহবাগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত [9] এক ব্লগারকেও। এবার সরকারের দিক থেকে আঘাত আসায় ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ব্লগাররা। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ব্লগারদের গ্রেফতারের প্র্রতিবাদে মানববন্ধন [10] এবং সাংবাদিক সম্মেলন [11] হয়েছে।
মনুআউয়াল [12] সামহোয়ারইনব্লগে লিখেছেন:
ব্লগারদের তথা মুক্তচিন্তার কর্মীদের উপর চলছিল হামলা, মামলা, সর্বশেষ যুক্ত হলো গ্রেফতার। মৌলবাদীদের শারীরিক আক্রমণের পাশাপাশি এখন শুরু হয়েছে রাষ্ট্র এবং সরকারের আক্রমণ। […] ব্লগার এবং অনলাইন লেখকদের বাকরুদ্ধ করে ফেলার চক্রান্ত শুরু হয়েছে।
ব্লগারদের গ্রেফতারের পর তাদেরকে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপনের ধরন নিয়েও কথা উঠেছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্লগার আলী মাহমেদ ফেসবুকে লিখেছেন [14]:
আমি যখন খবরটা শুনি, বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু যখন ছবিটা দেখলাম তখন আমার সমস্ত ভুবন এলোমেলো হয়ে গেল। তিনজন ব্লগারকে যেভাবে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হয়েছে, মনে হচ্ছে এরা একেকজন খুনি, ধর্ষক।
ডয়েশে ভেলে ববস প্রতিযোগিতা ২০১৩ এ মনোনীত ব্লগার নিঝুম মজুমদারও [15] ল্যাপটপ, কম্পিউটারের সামনে ব্লগারদের দাঁড় করিয়ে ছবি রাখা দেখে মন্তব্য করেছেন:
[…] একজন ব্লগার হিসেবে আমি সিম্পলী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেছি এই ছবি দেখে।
এদিকে ব্লগারদের নামধামছবি জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়ায় তাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রবাসী ব্লগার ও লেখক হিমু [16]:
যে তিনজন ব্লগারকে আটক করেছেন, তাদের মুক্তি চাই না। তাদের আপনারা আটকে রাখুন। কারণ আপনারা তাদের নামধামছবি সব প্রকাশ করে দিয়েছেন। মুক্ত বাংলাদেশে এখন তাদের পিছু নেবে আততায়ীরা, যারা আপনাদের কল্যাণই এদের চিনে নিয়েছে।
উল্লেখ্য, মৌলবাদীগোষ্ঠী ‘প্রচলিত ধর্মে অবিশ্বাসী’ ব্লগার আহমেদ হায়দার রাজিবকে [9] তার বাড়ির সামনে হত্যা করেছে। হত্যার উদ্দেশ্যে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের [8] ওপরও আক্রমণ করেছিল।
যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে আন্দোলনে সরকার শুরু থেকেই সমর্থন জানিয়ে আসছিল। তাই সরকার কেন শাহবাগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ব্লগারদের গ্রেফতার করছে, সেটা বুঝতে পারছেন না সচলায়তনের ব্লগার সজল [17]:
যেটা বুঝা দুস্কর, মুক্তিযুরেদ্ধর নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ কেন এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাথে তাল মিলিয়ে নাস্তিক/মুক্তমনা ব্লগারদের উপর এই দমন নিপীড়ন শুরু করেছে!
ব্লগার টুটুল [18] মনে করছেন, শাহবাগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার কারণেই বোধহয় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে:
সবসময় তাদের উপস্থিতি ছিল শাহবাগে… সেটাই কি কাল হলো তাদের জন্য? এইসব মিথ্যাচার করে কি ব্লগারদের থামানো যাবে? আমরা কি থেমে যাবো? লেজ ঘুটিয়ে ঘরে বসে থাকবো?
এদিকে ব্লগার গ্রেফতারের প্রতিবাদে বাংলাদেশের অনেক কমিউনিটি ও ব্যক্তিগত ব্লগ অনির্দিষ্টকালের জন্যে ব্লগ বন্ধ করে [20] প্রতিবাদে নেমেছে।
ভোটের রাজনীতি
২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলোকে পাশে রাখতে, এদের ভোট পেতে আওয়ামী লিগ সরকার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে ব্লগারদের গ্রেফতার করছে বলে মনে করছেন অনেকেই। যদিও হিমু [16] মনে করেন ইসলামপন্থীদের ভোট তারা পাবে না:
ভোটের জন্য? মোল্লাদের ভোট আপনারা পাবেন না। তাদের জুতা জিহ্বা দিয়ে চেটে সাফ করলেও পাবেন না। বরং যারা জামাতশিবিরের রাজনীতির মোকাবেলা করার জন্য আপনাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে, তাদের ভোট হারানো শুরু করবেন।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবী পুরণ [21] হলে বাংলাদেশ মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে অনেকে মনে করছেন। ব্লগারদের গ্রেফতারকে মৌলবাদীদের সাথে সরকারের আপোশ হিসেবে বর্ণনা করে আবিদুল ইসলাম [22] উন্মোচনে লিখেছেন:
[…] আরেকটি হলো হেফাজতে ইসলামের সাথে এক প্রকার সমঝোতায় উপনীত হয়ে নিজেদের পরম ‘ইসলামবন্ধু’ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রমাণ করে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া।
৩ এপ্রিল মঙ্গলবার আইন প্রতিমন্ত্রী আইন সংশোধন করে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বিধান করার কথা [23] জানিয়েছেন যা অনেক প্রগতিশীলকে বিস্মিত করেছে। বর্তমানে এ ধরনের বিভিন্ন অভিযোগে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড ও এককোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।