- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

বাংলাদেশ: ফেসবুকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের প্রতিক্রিয়া

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশ, ইতিহাস, ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজম, তাজা খবর, নাগরিক মাধ্যম, প্রতিবাদ, মানবাধিকার, যুবা, সরকার

ব্লগার্স এন্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক [1] (বোয়ান) – এর আহ‌বানে শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে প্রতিবাদের ডাকে ঢাকার শাহবাগ [2] চত্বর এখন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালে দেশব্যাপী সংগঠিত গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে চলমান এ আন্দোলন আজ আট দিন অতিক্রম করল। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর [3] সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে  ১৯৭১ সালে ৩৪৪ জনকে হত্যা, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ ও মানবতা বিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচারক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান [4] করে।

বাংলাদেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় হত্যার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির বিধান রয়েছে। এ রায়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় জনগণ বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

Ocean of people in Shahbagh. Image by Firoz Ahmed. Copyright Demotix (11/2/2013)

শাহবাগে জনতার সমুদ্র। ছবি ফিরোজ আহমেদের। কপিরাইট ডেমোটিক্স (১১/২/২০১৩)।

বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। রাজধানীর শাহবাগে গণ অবস্থানের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ ফেসবুকে তাদের প্রতিক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।

ফেসবুকে প্রদত্ত কিছু প্রতিক্রিয়া এখানে তুলে ধরা হল-

আন্দোলনের সফলতার প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রখ্যাত কবি, ছড়াকার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খালেদ হোসাইন [5] তাঁর ফেসবুক দেয়ালে লিখেনঃ

লোভ থেকে বা লাভের আশা থেকে উত্থিত নয় এ অভিনব চৈতন্যের জোয়ার। সমবায়ী শুভচেতনার এ এক অভাবিতপূর্ব নান্দনিক বিস্ফোরণ। বিজয় ছাড়া আমাদের আর কোনো প্রাপ্য নেই।

শাহবাগ চত্বরে যাবার আহবান জানিয়ে ব্লগার, লেখক ও শিক্ষক মুম রহমান [6] বলেনঃ

যে সব তরুণ সুস্থ আছেন, দেশে আছেন, অথচ এখনো শাহবাগে জাননি, তাদেরকে জানাচ্ছি আপনারা ইতিহাস থেকে দূরে আছেন, বর্তমান থেকে দূরে আছেন, ভবিষ্যত থেকে দূরে আছেন। এখনো সময় আছে, আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান। এখন যৌবন যার, শাহবাগ যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

শাহবাগ তথা প্রজন্ম চত্বরে রাত জেগে অবস্থান করে আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানো একজন তরুণ তাউসিফ হামিমের [7]ফেসবুক স্ট্যাটাস শেয়ার করেছেন ব্লগার ভাস্কর আবেদিন [8]। তাউসিফ আমাদের জানান:

নিয়ম করে তিন বেলা শাহবাগ যাই, স্লোগান দেই, ক্লান্ত হয়ে গেলে নখ দিয়ে চুলের খুশকি খুটি, আশে পাশে তাকাই, মুগ্ধ হয়ে দেখি ল্যাম্প পোস্টগুলো এক একটি ফাঁসি কাষ্ঠ, সেই কাষ্ঠে ঝুলছে কাদের মোল্লার প্রতিকৃতি, স্লোগান দেয়া আপুটার সাথে নতুন করে বর্নমালা শিখি- “স” তে সাকা চৌধুরী, তুই রাজাকার, “গ” তে গোলাম আজম, তুই রাজকার। ক্ষুধা পেলে বাসায় আসি, ভাত খাই, তারপর আবার শাহবাগ যাই, বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, ফাঁসির স্লোগান তীব্র হয়, সন্ধ্যা নামলে মিছিলের উপরে মশাল জ্বলে সেই মশালের আলোতে পাপমুক্তির গন্ধ থাকে, এখানে সেখানে উল্টে পড়া মশালগুলো তুলে নিয়ে আমি এক জায়গায় জড়ো করি, পরে থাকা কেরোসিনের উপর ছড়িয়ে দেই খবরের কাগজ, আবার ক্লান্ত হই, ১০ টাকার বাদাম খাই, মোমবাতির আগুনে পোড়াই বাদামের খোসাগুলো।…

Students from different institutions join the protest demanding the death penalty for all war criminals at Shahbagh in the capital. In the Picture Lucky Akter shouting slogans. Image by Firoz Ahmed [9]

শাহবাগে লাকী আক্তারের মর্মভেদী স্লোগান। ছবি ফিরোজ আহমেদের। কপিরাইট ডেমোটিক্স (১১/২/২০১৩)।

চলমান এ আন্দোলনকে বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করছে। বাংলাদেশের এ চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে আন্দোলনের স্লোগান চালিয়ে যাওয়া নারী লাকি আখতারের নাম এখন বেশ জনপ্রিয়। লাকি আখতার সম্পর্কে যুক্তরাজ্য প্রবাসী ফেসবুক ব্যবহারকারী মোর্শেদ আখতার [10] বলেনঃ

আজ থেকে ‘লাকী আখতার’ নামের মেয়েটি আমার বোন। আর এভাবেই ‘লাকী’-রা আমাদের বোন হয়ে যায়, হয়ে যায় ‘আত্মার আত্মীয়'।  অফুরান ভালবাসা তোমাদের জন্য।

বেসরকারি টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার শিমুল বাশার [11]  শাহবাগ আন্দোলনের প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেনঃ

আমি আবার বলছি, শাহবাগের এইসব দিন ইতিহাস হবে। জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আমার নেই। মা, আমার চোখে ঘুম আসেনা। আমি শাহবাগের কথা ভাবি। আমার তার মুখ মনে পড়ে।

গণদাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ সংহতি প্রকাশ করলেও নোবেল জয়ী ডঃ মোহাম্মদ ইউনূস [12] এখন পর্যন্ত নিশ্চুপ। সে বিষয়ে ইঙ্গিত করে আজাদ মাস্টার [13] বলেনঃ

নন নোবেল বিজয়ী জাফর ইকবাল স্যার আমাগো সাথে তার সহধর্মিণীকে নিয়ে এসে মঞ্চে উঠে তুই রাজাকার বলে স্লোগান দিতে পারেন । কিন্তু নোবেল বিজয়ী ডক্টর ইউণূস সাব রামুর মতো এইবারও মৌন ব্রত পালন করছেন।

School student are protesting. Image by Zakir Hossain Chowdhury. Copyright Demotix (11/2/2013) [14]

স্কুলের শিশুরা প্রতিবাদ করছে। ছবি জাকির হোসেন চৌধুরীর্ কপিরাইট ডেমোটিক্স (১১/২/২০১৩)

দেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) [15]- এর বর্তমান অবস্থান নিয়ে সৈকত শুভ্র আইচ [16] বলেনঃ

হায় বিএনপি! না আছে গলায় কোনও আওয়াজ, না আছে চোখে কোনও জ্যোতি! ইয়া মাবুদ এলাহী, দলটারে তুমি রক্ষা কর. .

আন্দোলনকে অনেকে সরকার সমর্থিত বলে মনে করেন। অনেকে এই আন্দোলনকে সরকারের ব্যর্থতা বলে মনে করেন। তাঁদের এ বক্তব্যের সাথে ব্লগার বিজয় মজুমদার [17] একমত নন। তিনি বলেনঃ

রাজনীতির জনতাকে ভুল বুঝবার কোন অবকাশ নেই।
জনতার রাজনীতি মানুষের জন্য। জনতার রাজনীতি অন্যায় , নির্যাতন, শোষণের বিরুদ্ধে। জনতার রাজনীতি ক্ষমতার জন্য নয়, ক্ষমতাকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য। শাহবাগে যার অন্দোলন করছে, তাদের আন্দোলন কোন দলকে শক্তিশালী করার জন্য করছে না, তাদের এই আন্দোলন ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

এই আন্দোলন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের চৈতন্যের ফসল। [..]

কারো কাছে মনে হচ্ছে এই অন্দোলন, শাসক দলের নানাবিধ ব্যর্থতাকে আড়াল করার অপচেষ্টা।

আমার কাছে এর একটা ভিন্ন উত্তর আছে।

এখন থেকে ৪২ বছর আগের অপরাধের শাস্তি দাবী করেছে যে জনতা, সে জনতাই আরেকদিন দেশের সম্পদ লুটপাটের জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তি দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠবে।

এ জনতাই সেই জনতা যারা ১৯৭১-এ উত্তাল হয়ে উঠেছিল, স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে এনেছিল, ২০১৩-এ সেই জনতাই আবার সোচ্চার হয়ে উঠেছে, আরেকটি অর্জনের জন্য।

তারুণ্যের এ গণজাগরণ নিয়ে প্রতিদিনই রচিত হচ্ছে অসংখ্য গান, কবিতা, ছড়া ও ব্যঙ্গচিত্র। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট গায়ক, সাংসদ কবীর সুমন [18] এ আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে গণদাবী [19] এবং শাহবাগে রাতভর [20] নামে গান রচনা করেছেন।

এ আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে প্রতিদিন ই নিত্য নতুন ফেসবুক পাতা খোলা হচ্ছে। দাবির পক্ষে শাহবাগ আন্দোলন [21]স্বাধীনতা প্রজন্ম চত্বর [22]  সহ আরও অনেক ফেসবুক পাতা আর বিপক্ষে ভয়েস অফ ন্যাশনালিস্ট [23], বাশের কেল্লা [24] সক্রিয় রয়েছে।

দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।