হ্যাকিংয়ের অভিযোগে ‘দি ইকনমিস্ট’ এর প্রতি সমন বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার তদন্ত এবং বিচার সংক্রান্ত বাংলাদেশের একটি চলমান ট্রাইবুনাল।

গত ৬ই ডিসেম্বর, ২০১২ তারিখে ইকনমিস্ট পত্রিকাকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল অভিযুক্ত করে হ্যাকিংয়ের এবং তারা কিভাবে এবং সভাপতিত্বকারী বিচারক মোহাম্মদ নিজামুল হক এবং বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে বসবাসকারী বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ জনাব আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যেকার কথোপকথন শুনতে পেয়েছে এবং ইমেইল হাতে পেয়েছে তা ব্যাখ্যা করতে বলেছে। এই দুই ব্যক্তি গত ২৫ বছর ধরে একে অপরের পরিচিত। আদালতের রায়ে ইকনমিস্ট পত্রিকাকে কথোপকথন বিষয়ে বিচারকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করায় “ট্রাইবুনালের কাজে হস্তক্ষেপ এবং এর সভাপতিত্বকারী বিচারকের গোপনীয়তা লংঘন”-এর দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

৮ই ডিসেম্বর, ২০১২ তারিখে ইকনমিস্ট পত্রিকা একটি ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে জবাব দেয় যাতে দাবি করা হয়েছে যে এটি “ব্যক্তিদ্বয়ের মধ্যেকার ১৭ ঘন্টা রেকর্ডকৃত টেলিফোন কথোপকথন শুনেছে এবং ২৩০টি ই-মেইল দেখেছে।” তারা জনাব  হক এবং জনাব আহমেদ সঙ্গে তাদের আদান-প্রদানের একটি নাতিদীর্ঘ বিবরণ প্রকাশ করেছে। একটি স্থানীয় দৈনিক আমার দেশ [বাংলা ভাষায়] কথোপকথনের কিছু অংশের লিখিতরূপ প্রকাশ করলে পরিস্থিতি তুঙ্গে উঠে। সেই উপাদানের উৎস একটি ‘বাইরে দেশ’, জানানো হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের দায়মুক্তি

ইতিহাসের অন্যতম নিকৃষ্ট একটি গণহত্যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় দোসররা  ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যা এবং ২ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ নারীকে ধর্ষন করা হয়েছে বলে
বাংলাদেশ দাবি করে

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশের মুলতবি বিচার থেকে পাকিস্তানে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী হস্তান্তর করা হয়েছে এবং পাকিস্তান কখনো তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। যুদ্ধাপরাধের একটি সত্য অনুসন্ধান কমিটি প্রকাশ করেছে  যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্থানীয় দোসররা অন্ততঃ ৫৩ ধরনের অপরাধে জড়িত ছিল। স্থানীয় সহযোগীদের একটা বড় অংশ ছিল যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর সদস্য। সরকার জাতীয় পুনর্মিলনের একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দালাল আদেশের (১৯৭২) এর অধীনে বিভিন্ন অপরাধের জন্যে দোষী সাব্যস্ত বা অভিযুক্ত কিন্তু হত্যা, ধর্ষণ বা অগ্নিসংযোগের দায়ে অভিযুক্ত নয় এমন ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা (পিডিএফ) ঘোষণা করে। পরবর্তীতে সমস্ত মোকদ্দমা থামিয়ে দিয়ে সমস্ত অভিযুক্তদের ছেড়ে দেওয়া হয় সমাজে একটি ক্ষত রেখে ফলে অনেকে বিশ্বাস করে যে ন্যায়বিচার সম্পন্ন হয়নি।

মেয়েরা অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের দাবি করে আঁকা ছবিযুক্ত প্ল্যাকার্ড বহন করছে। ছবি রেহমান আসাদ। সর্বস্বত্ত্ব ডেমোটিক্স (৩০/১১/২০১২)

২০১০ সালে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ এবং দায় মুক্তি সংশোধন

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন ১৯৭৩ এর গঠিত কিছু কিছু দিক সংশোধন করে ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ তারিখে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আইসিটি গঠন করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তাদের একটি নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল। বর্তমানে ট্রাইবুনালটি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় সংঘটিত অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও অন্যান্য নৃশংসতার অভিযোগে জামায়াতের কয়েকজন নেতাসহ ১০জন ব্যক্তির বিচার করছে।

ট্রাইবুনালে কিছু কিছু ত্রুটির কারণে কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা আইসিটি’র সমালোচনা এবং এর স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া সম্পর্কে উদ্বেগ উত্থাপন করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সুশীল সমাজ লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশে আইসিটি বিরুদ্ধে তদবির করার দায়ে জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করেছে। এছাড়াও জামাত তাদের নেতাদের বিচার থামাতে দেশজুড়ে প্রায়শ:ই পুলিশের বিরুদ্ধে আক্রমণের মতো হিংসাত্মক উপায় ব্যবহারসহ রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ করছে।

ট্রাইবুনালে ইকনমিস্টের সম্পৃক্ততা

ইকনমিস্ট ম্যাগাজিনকে সভাপতিত্বকারী বিচারক মোহাম্মদ নিজামুল হক এবং যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ জনাব আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যেকার বিভিন্ন ই-মেইল এবং স্কাইপ কথোপকথন হ্যাকিংয়ে অভিযুক্ত করার সংবাদ বেরিয়ে পড়লে ব্লগ মণ্ডলে প্রতিক্রিয়ার উদ্গীরণ ঘটে। অনার্য সঙ্গীত প্রশ্ন করেছে:

বিচারকের কথা/আলোচনা তাঁর অনুমতি ছাড়া কেন রেকর্ড/হ্যাক/প্রচার করা হবে? এই প্রশ্নটির জবাব নিশ্চয়ই মাননীয় আদালত চাইবেন। বাংলাদেশের আইনানুযায়ী (এবং ব্রিটিনের আইনেও) হ্যাকিং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

প্রশ্ন হচ্ছে এরা কতদিন থেকে সক্রিয়? জামায়াতের হ্যাকাররা কতদিন থেকে হ্যাকিং করছে?

এই অনুসন্ধানী পোস্টটি স্থানীয় সংবাদপত্র এটা প্রকাশ করার অনেক আগে ফেসবুক এবং ইউটিউবে হোস্ট করা স্কাইপ কথোপকথনের অডিও এবং ভিডিও প্রকাশ করতে থাকা ‘আওয়ামী ট্রাইব্যুনাল’ শিরোনামের একটা জামায়াতপন্থী ফেসবুক পৃষ্ঠার সন্দেহজনক কার্যকলাপ প্রকাশ করে।

একজন সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নগুলোকে তার নিজের “ট্রাইব্যুনালের ই-মেইলগুলো প্রকাশ করা কী ইকনোমিস্টের জন্যে সম্পাদকের নৈতিকতা লংঘন হবে?” ব্লগে কাভার করেছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন:

তাই ট্রাইব্যুনালের এসব ই-মেইল যোগাযোগগুলো প্রকাশ করা ইকনোমিস্টের জন্যে সম্পাদকের নৈতিকতা লঙ্ঘন হবে কী হবে না নির্ভর করে তাদের প্রকাশনায় যথেষ্ট শক্তিশালী জনগণের একটি স্বার্থ রয়েছে কিনা তার উপর এবং সেটা নির্ভর করবে প্রকাশিত যোগাযোগ কতটা গুরুতর অন্যায়ের মাত্রা প্রদর্শন করছে তার উপর।

তিনি আরেকটি পোস্টে যোগ করেছেন:

সরকারের মধ্যে অনেকে এবং এর সমর্থকরা মনে করে যে ইকনমিস্ট পত্রিকা এটা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্যে করেছে। (কোনো প্রমাণ না দিয়ে) ‘ভারতীয় টাকার বস্তা এবং উপদেশ‘সহ গত নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল এই দাবি করা একটি নিবন্ধ এর মূল কারণ। এছাড়াও এটা ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সমালোচনা করে আসছে।

ট্রাইবুনালের আদেশক্রমে জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আজমকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়েছে। ছবি ফিরোজ আহমেদ। সর্বস্বত্ত্ব ডেমোটিক্স  (১১/১/২০১২)

এছাড়াও বিচার সংক্রান্ত কিছু আলোচনাসহ প্রধানতঃ ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে প্রকাশিত কথোপকথন বিষয়ে জনগণের যথেষ্ট আগ্রহ আছে কিনা  তা নিয়ে ব্লগাররা আলোচনা করছে।

প্রীতম দাস মন্তব্য করেছেন:

আহমেদ জিয়াউদ্দিন এবং নিজামুল হক নাসিম দুইজনেই চাইছেন সরকারের তাগাদা অনুযায়ী তাড়াহুড়ো না করে একটু সময় নিয়েই কাজ শেষ করতে। একাধিকবার তারা ‘ফেয়ার ট্রায়াল’ নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করেছেন।

আরিফ জেবতিক লিখেছেন:

ড.জিয়াউদ্দিন কোনো দলের নেতা কিংবা কর্মী নন, একেবারে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন একজন আইনজীবী যার মূল এক্সপার্টিজ ও আগ্রহের জায়গা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ। তিনি যদি আদৌ এরকম কথোপকথনে অংশ নিয়ে থাকেন, তাহলে সেটি ট্রাইবুনালকে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং সঠিক মান অর্জনে সহায়তা করার উদ্দেশ্য থেকেই করেছেন- এজন্য তিনি সাধুবাদ প্রাপ্য।

গোটা আলোচনার স্ক্রিপ্ট নামে যে দীর্ঘ লেখাটি আমারদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার অধিকাংশই ব্যক্তিগত আলোচনায় ভরপুর। একই সঙ্গে দুই আইনের মানুষ নিজেদের মধ্যে দেশের এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন আদালতের খবর নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরকম আলাপের মাঝে আমি দোষ দেখি না।

ইকনোমিস্ট পত্রিকা কাহিনীটি প্রকাশ করে কিনা এবং ট্রাইব্যুনালের উপর এর কোনো প্রভাব পড়বে কিনা তা দেখার বাকি রয়েছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .