পাকিস্তানঃ মালালা ইউসুফজায়ীকে লক্ষ্য করে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হামলা

নারী শিক্ষা কার্যক্রমের কারণে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা ১৪ বছরের মালালা ইউসুফজায়ীর উপর হামলা চালিয়ে তাকে গুরুতর আহত করেছে।

তালেবানরা, স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে মালালাকে আটকায় এবং তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। একটি গুলি মালালার কাঁধ ছিদ্র করে ফেলে, যে আঘাত তাকে জীবনমৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। প্রচার মাধ্যমের সাম্প্রতিক সংবাদে জানা যাচ্ছে যে মালালার শরীর থেকে সফলভাবে বুলেট অপসারণ করা হয়েছে এবং সে এখন বিপদমুক্ত।

কে এই মালালা ইউসুফজায়ী?

মালালা ইউসুফজায়ী, পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার এক বালিকা এবং নারী শিক্ষা বিস্তারে উৎসাহী এক কর্মী। সে প্রকাশ্যে নারীদের স্কুলে যাবার অধিকারের পক্ষে কথা বলে থাকে। তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সোয়াত উপত্যকার মেয়েদের স্কুলে তালেবানদের হামলার ঘটনায় মালালা জনসম্মুখে তাদের সমালোচনা করেছিল।

ইউটিউব.কমের ভিডিও থেকে ছবিটি আলাদা করা হয়েছে।

বিশ্বের কাছে মালালা ইউসুফজায়ীর নাম তখন ছড়িয়ে পড়ে, যখন ২০০৯ সালে সে বিবিসির উর্দু বিভাগের জন্য একটি ডায়েরি লিখেছিল। ‘পাকিস্তানের এক স্কুল বালিকার ডায়েরি’ নামের এই লেখাটি মূলত ‘গুল মাকাই’ ছদ্মনামে বিবিসির উর্দু বিভাগে প্রচারিত হয়। ধারাবাহিক এই লেখায় সোয়াত উপত্যকায় তালেবানদের কারণে নারী শিক্ষায় নেমে আসা বিপর্যয়ের কথা বলা হয়েছিল।

যে সময়টায় উগ্রবাদীরা সোয়াত উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করত, সে সময় জোর করে মেয়েদের স্কুলসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শিক্ষার উপর কেবল ছেলেদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। সে সময় নারী শিক্ষার প্রতি তালেবানদের সৃষ্ট এই বিপর্যয়ের বিষয়ে যে কলম ধরেছিল, সে আর কেউ নয়, স্বয়ং মালালা নিজে। মালালার ডায়েরি থেকে তার লেখার একটি ছোট্ট অংশ এখানে তুলে ধরা হল :

ক্লাশের ২৭ জন ছাত্রীর মধ্যে মাত্র ১১ জন এখন ক্লাশে আসে। মেয়েদের স্কুলে আসার উপর তালেবানদের জারি করা নিষেধাজ্ঞার পর থেকে স্কুলে ছাত্রীদের উপস্থিতির হার কমতে শুরু করে। এই নিষেধাজ্ঞা জারির পর আমার তিন বান্ধবী তাদের পরিবারের সাথে যথাক্রমে পেশোয়ার, লাহোর এবং রাওয়ালপিণ্ডিতে চলে গেছে।

কিডস রাইটস ফাউন্ডেশন নামক প্রতিষ্ঠান ২০১১ সালে মালালা ইউসুফজায়ীকে আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিল।

যে সমস্ত হাজার হাজার বালিকা শিক্ষা লাভ করতে এবং সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে চায়, মালালা তাদের কণ্ঠস্বর।

তালেবানদের অবস্থান

নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী দল তেহরিক-এ তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) সাথে সাথে ঘৃণ্য এই কাজের দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। এই দলটি বলছে যে মালালা তার কাজের মাধ্যমে সমাজে ভিন্ন চিন্তাধারা প্রবেশ করাচ্ছিল এবং ভবিষ্যতে যারা এই কাজ করার চেষ্টা করবে তারাও টিটিপির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। তালেবানের মুখপাত্র আরো উল্লেখ করেন যে “ যদি কেউ কখনো ইসলাম এবং শরিয়াহর বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রচারণায় নামে, শরিয়াহ আইনে তাকে খুন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

টিটিপি-এর মুখপাত্র এহসানুল্লাহ এহসান এক সাক্ষাৎকারে বলেন:

[মালালা] অত্র এলাকায় পশ্চিমা সংস্কৃতির এক প্রতীকে পরিণত হয়েছে… [এবং এই হামলা যুক্তিযুক্ত] কারণ সে পশতু এলাকায় পশ্চিমা সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

মিনহাজ-উল-কোরান ওমেন লীগ-এর একটিভিস্টরা মালালা ইউসুফজায়ীর ছবি প্রদর্শন করছে এবং তারা এই হামলার বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। কপিরাইট ডেমোটিক্সের (১০/৯/২০১২)।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া

সমাজের সকল স্তর থেকে এই হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে। ১৪ বছরের এক নিষ্পাপ চিন্তাধারায় গুলি করার পক্ষে তালেবানদের যে যুক্তি, তার সমর্থনে একটি টুইটও করা হয়নি।

টুইটার ব্যবহারকারী তীব্র ভাষায়-এর নিন্দা জানিয়েছে:

@সাবাহতএমএস:মোল্লাদের ইসলামের কাছে ১১ বছরের রিমশাহ মাসিহ- বিপজ্জনক আর তালেবানদের ইসলামের কাছে ১৪ বছরের মালালা ইউসুফজায়ী হুমকি স্বরূপ!! #ডিসগাস্টিং (বিরক্তিকর) #পাকিস্তান

@এশহএ্যাশ#তালেবানরা আর কতদূর পর্যন্ত যাবে? মালালার জন্য সকল প্রার্থনা। পরম করুণাময় আল্লাহ যেন তাকে দ্রুত সারিয়ে তোলেন।

মুবাশ্বার শাহ মন্তব্য করেছেন :

মালালা ইউসুফজায়ী হচ্ছে পাকিস্তানের এবং একই সাথে বিশ্বের *কন্যা*। “ঈশ্বর” তোমায় রক্ষা করুন।

পারভেজ বলছে:

মালালা ইউসুফজায়ী, এত অল্প বয়স সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে ব্যাতিক্রমী এবং সাহসী একজন। টিটিপি অভিশপ্ত, কিন্তু টিটিপির পেছনে যারা আছে তারা দ্বিগুণ অভিশপ্ত।

অজস্র নেট নাগরিক মালালার শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য দোয়া করছে। তারা বুক ভরে শ্বাস নেয় যখন সংবাদ আসে যে মালালা বিপদমুক্ত।

ফিরোজ লিখেছে:

আমি আশা করি মালালা যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে তা এক প্রভাব তৈরি করবে এবং তরুণ প্রজন্ম নিজেদের মাঝে হাজার হাজার মালালাকে ধারণ করবে। যারা পাকিস্তানকে প্রস্তর যুগে নিয়ে যেতে চায়, সম্ভাব্য সকল উপায়ে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। মালালা, সমগ্র বিশ্ব তোমার দ্রুত আরোগ্য কামনায় দোয়া করছে।

পাকিস্তানে নারী শিক্ষার হার অনেক নীচে অবস্থান করছে, যার পরিমাণ শতকরা ৪৫ শতাংশ (২০০৯ সালের হিসেব অনুসারে)। নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের এই হুমকি এই হারকে আরো নীচে নামিয়ে দেবে।

এ্যাডাম বি এলিক স্মরণ করছেন মালালা ইউসুফজায়ীর সাথে কাটানো সময়ের কথা। এ্যাডামকে, মালালা তার ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল, যা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সেই স্কুলের দেওয়ালে লেখা ছিলঃ “এই হচ্ছে পাকিস্তান”। এটি দেখার সাথে সাথে মালালা উত্তর করল:

“দেখ! এই হচ্ছে পাকিস্তান। তালেবানরা আমাদের ধ্বংস করছে”।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .