কিরগিজস্তানঃ আদালতের নির্দেশে ইসলাম বিরোধী চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ

২১ সেপ্টেম্বর তারিখে কিরগিজস্তানের এক আদালত কুখ্যাত ছবি “ দি ইনোসেন্স অফ মুসলিম” –এ প্রবেশ নিষিদ্ধ করে এক আদেশ জারি করে [রুশ ভাষায়]। এই ছবিটি সারা বিশ্বে প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ উসকে দিয়েছে, আর যার কারণে লিবিয়ায় চারজন মার্কিন কূটনীতিবিদ নিহত হয়েছে।

কিরগিজস্তান মধ্য এশিয়ার এক ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্র, যে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমান, কিন্তু প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের এক অংশ হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে রাষ্ট্রটি প্রবলভাবে তার ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য বজায় রেখেছে, সে রাষ্ট্রে এ রকম একটি সিদ্ধান্ত, দেশটির অনলাইন সংবাদপোর্টালে প্রাণবন্ত এক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।

ইউটিউবের এই ভিডিও, অনেক মুসলমান যাকে “ ইসলাম বিরোধী” এবং “অবমাননাকর” হিসেবে অভিহিত করেছে, ইতিমধ্যে তা অনেক দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মিশর, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ভারত এবং ফিলিপাইনস। আফগানিস্তানও এই চলচ্চিত্রের লিঙ্কে প্রবেশ বন্ধ রেখেছে

অনেক কিরগিজ নাগরিকের ইউটিউবে রাখা কুখ্যাত এই ছবির লিঙ্কে ঢোকার চেষ্টার প্রমাণ হচ্ছে এই ত্রুটিপূর্ণ বার্তার স্ক্রিনশট।

“আপত্তিকর উপাদান “

১৯ সেপ্টেম্বর তারিখে সরকারের আইন মন্ত্রণালয়, আদালতে এই ভিডিওর উপাদান অত্যন্ত আপত্তিকর বলে ঘোষণা করার এবং কিরগিজস্তানে এর বিতরণ নিষিদ্ধ করার দাবী উত্থাপন করে [রুশ ভাষায়] । একই সাথে, আদালতের আদেশ জারির প্রাক্কালে দেশটির সংসদ এই ভিডিওর লিঙ্কে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এক আদেশ জারি করে [রুশ ভাষায়।

তুরসুনবাই বাকির উউলু, কিরগিজস্তানের আর-নামিয়াস নামক রক্ষণশীল দলের একটি অংশের সংসদ সদস্য। তিনি কিরগিজস্তানের সর্ববৃহৎ সংবাদপত্র ভিচেমিভ বিশকেক –এ একটি বিবৃতি প্রদান করেছেন [রুশ ভাষায়]:

Возможно, если мы как-то отреагируем, примем решение, то люди успокоятся и не станут устраивать акции протеста.

যদি আমরা যে কোন একভাবে আমাদের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন এবং সিদ্ধান্ত প্রদান করি, তাহলে হয়ত জনতা শান্ত হবে এবং কোন ধরনের প্রতিবাদের আয়োজন করবে না।

কিন্তু কোন ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শিত না হওয়ায়, অনেকটা অস্বাভাবিকভাবে সেই একই এমপি পরে টুইটারে ঘোষণা প্রদান করেন যে [রুশ ভাষায়] তার ইচ্ছে ২৫ সেপ্টেম্বরে কিরগিজিস্তানে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সামনে তিনি এই ভিডিওর বিরুদ্ধে এক বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব প্রদান করার:

Пусть посол США не перживает.Все пройдет спокойно и законно! Согласно закону мы уведомили мэрию о мирной акции протеста 25 сентября в 11-00

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের চিন্তিত হবার কিছু নেই। সকল কিছু হবে শান্তিপূর্ণ এবং আইনানুগ ভাবে, আইন যে ভাবে বলে ঠিক সেভাবে। ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখে বেলা ১১ টার সময় এক শান্তিপূর্ণ মিছিলের জন্য আমরা বিশকেক-এর মেয়র অফিসে দরখাস্ত প্রদান করেছি।

(বিশেষ দ্রষ্টব্য (বাকির উউলু এর আগেও জাতীয় সংসদে স্বল্পদৈর্ঘের স্কার্ট পড়া নিষিদ্ধ করা নিয়ে লেখা গ্লোবাল ভয়েসেস-এর এক প্রবন্ধের বিষয় ছিলেন। এই প্রবন্ধের নীচে তাবাকিরুলু নামের এক ব্যবহারকারী লেখকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে [রুশ ভাষায়], লেখক বস্তুনিষ্ঠ ছিলেন না এবং কেবল মাত্র নির্বোধ এবং ভাঁড়দের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন”।

এই আইন প্রণেতা গত বছরের শেষের দিকে আবার সংবাদের শিরোনামে উঠে আসেন, যখন তিনি সংবিধানের পরিবর্তে কোরানের উপর হাত রেখে আইন প্রণেতা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং দেশটির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানান, যেন সে এক ড্রাগনে (দানবে) পরিণত না হয়)।

দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি?

কিরগিজস্তানের সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এক সংসদ সদস্য দানিয়ারত বিশালিইয়েভ ধারণা দেন যে [রুশ ভাষায়] এই ভিডিওর লিঙ্কে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মাঝে আরো কৌতূহলের সৃষ্টি করবে:

Все, кто хотел посмотреть, посмотрел. Если мы введем запрет, то желающих посмотреть фильм будет больше.

যাদের এই ভিডিওটি দেখার আগ্রহ রয়েছে, তারা ইতোমধ্যে তা দেখে ফেলেছে। আমরা যদি এটাকে নিষিদ্ধ করে ফেলি, তাহলে আরো অনেকে তা দেখতে চাইবে।

ক্লপ. কেজ সংবাদপত্রের ওয়েবসাইটের এই প্রবন্ধের নীচে অনেক নেট নাগরিক দৃশ্যত তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইবেক বারাতাশভিলি মন্তব্য করেছেন [রুশ ভাষায়]:

Чем больше запрещают, тем сильнее желание посмотреть! Дайте линк!

যতই তারা এই ভিডিওকে নিষিদ্ধ করবে, ততই তা দেখার ইচ্ছা সবার মাঝে তীব্র হতে থাকবে, আমাকে কি কেউ একজন [এই ভিডিওর] লিঙ্ক প্রদান করবেন।

সাংবাদিক জারেমা সুলতানবেকভ এর মন্তব্য আরো বেশী তীব্র ছিল [রুশ ভাষায়] :

Что за бред, такой дешевый тупой фильм. Не думаю, что он здравомыслящего человека может спровоцировать… На Ютюбе вообще 15 минутный ролик, а не весь фильм… Эхх, Кыргызстан

এটা কি ধরনের কাজ? [এই চলচ্চিত্রটি ] একবারে সস্তা এবং বাজে একটা চলচ্চিত্র। আমি মনে করি না এটা কোন যুক্তিবাদী মানুষের ভিত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে … এমনকি ইউটিউবে সমগ্র চলচ্চিত্রটি রাখা হয়নি, মাত্র ১৫ মিনিটের একটি ভিডিও রয়েছে। ওহ, কিরগিজস্তান।

কিন্তু ক্লপ –এর ধারাভাষ্যকার টিম এলে, এই ঘটনায় জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করেছেন [রুশ ভাষায়]:

И правильно сделали… А то у нас тоже беспорядки начнутся..

তারা ঠিক কাজটি করেছে…অন্যথায়, এখানেও দাঙ্গা বেঁধে যেত।

নেট নাগরিকদের ভেতরে যে বিষয়টি সবচেয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে তা হচ্ছে, যারা এই নিষেধাজ্ঞার সম্বন্ধে সচেতন নয়, এই চলচ্চিত্র শেয়ার করার অভিযোগে, জাতীয় নিরাপত্তায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় কমিটি [স্টেট কমিটি ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি বা এসসিএনএস, যা সোভিয়েত আমলের কেজিবির উত্তরসূরি] তাদের গ্রেফতার করতে পারে, উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন। আর এ কারণে ক্লপ.কেজ –এর সম্পাদক এলদিয়ার আর্কাবায়েভ এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে এক প্রচারণার আহ্বান জানান [রুশ ভাষায়]:

Извините за выражение, но это пиздец. Ребята, прошу расшерить, потому что теперь людей могут осудить за ссылки на фильм. Нужно предупредить пока не начались задержания, аресты. Ментами дали повод для перевыполнения плана по задержанию. Поделитесь!

ভাষার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন, কিন্তু বন্ধুগণ এটা একটা বাজে জিনিষ, আমি আপনাদের এই বিষয়টি [নিষেধাজ্ঞার তথ্য] সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ তা না হলে নাগরিকরা হয়ত এই চলচ্চিত্র শেয়ার করার জন্য শাস্তি পেতে পারে। গ্রেফতার এবং কারাদণ্ড প্রদান শুরু হবার আগে তাদেরকে অবশ্যই নোটিশ প্রদান করতে হবে। পুলিশ গ্রেফতারের পেছনে কারণ প্রদান করা শুরু করেছে। কাজে বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দিন!

“স্বাধীনতা মৃত্যুবরণ করেছে ”

কিরগিজস্তানের অতি পরিচিত ব্লগার কারিমদাগানভ, আদালতের এই আদেশ প্রদান করার ঘোষনার দিনটিকে এক ‘ঐতিহাসিক দিন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন [রুশ ভাষায়]:

Сегодня исторический день в Кыргызстане – свобода умерла…

আজকের দিনটা কিরগিজস্তানের এক ঐতিহাসিক দিন… স্বাধীনতা মৃত্যু বরণ করেছে।

তবে স্বাধীনতার বিষয়ে সকলে কারিমদাগানভ-এর মত মনোভাব পোষণ করেনি। সাংবাদিক আইদাই ইরগেবাইয়ে এর জবাবে বলেছেন [রুশ ভাষায়]:

о чем ты? при всей моей не религиозности, видео – говнянное. пропускать такое – нельзя. какая нах свобода?.. нельзя издеваться над святым…

আপনি কিসের কথা বলছেন? যদিও আমি ধার্মিক নই, তারপরে আমি ভিডিওর বিষয়কে বাজে এক বিষয় হিসেবে আবিস্কার করেছি। এই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেওয়া উচিত নয়। আপনি কোন ধরণের স্বাধীনতার কথা বলছেন? কোন পবিত্র বিষয় নিয়ে মজা করা ঠিক নয়…

যখন ২০১০ সালের জুন মাসে দেশটির দক্ষিণ অঞ্চলে জাতিগত সংঘর্ষ শুরু হয় তখন থেকে ভিডিও এবং ওয়েবসাইট সেন্সরশীপ নিয়ে বিতর্ক কিরগিজস্তানের নবীন সংসদীয় গণতন্ত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকের মতে জাতিগত এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝে উত্তেজনা ছড়াতে পারে এমন উপাদান প্রকাশের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দায় রয়েছে।

তবে অনলাইনে, ক্রমশ বাড়তে থাকা ইন্টারনেট স্বাধীনতার প্রবক্তা একদল তরুণ, এই বিষয়ে আবেদন জানিয়ে তাদের কণ্ঠস্বর জোরালো করছে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ইন্টারনেটের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরোধীতা করছে। তবে এখন পর্যন্ত দেশটির প্রধান রাজনৈতিকদল তাদের কথায় কর্ণপাত করেনি।

এই পোস্টটি কিরগিজস্তানের বিশকেকে অবস্থিত আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ সেন্ট্রাল এশিয়ার, জিভি সেন্ট্রাল এশিয়া প্রজেক্টের একটি অংশ।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .