১৯৭৯ সালে ক্ষমতা দখল করার কিছুদিনের মধ্যে দেশটির ইসলামিক শাসনতন্ত্রে সকল নারীদের জনসম্মুখে মাথা ঢাকার পোষাক (হিজাব) ধারণ করা অত্যাবশকীয় হয়ে পড়ে। তিন দশক পরেও নাগরিকদের পরিচ্ছেদ বিষয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য ইরানের পুলিশ প্রতি গ্রীষ্মে হিজাব অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
১০ জুলাই ২০১২-এ, “ইরান লিবারেল স্টুডেন্ট এন্ড গ্রাজুয়েট” [ইরানের উদারনৈতিক ছাত্র এবং স্নাতকরা] নামক সংগঠন “বাধ্যতামূলক হিজাবকে না বলুন” নামক এক প্রচারণা শুরু করে।
“আনভেইল ওমেনস রাইটস টু আনভেইল” [ অবগুণ্ঠনহীন নারীদের অধিকার উন্মোচন] নামক পাতা ইতোমধ্যে ২৬,০০০ টি লাইক অর্জন করেছে। শত শত নারী এবং এবং পুরুষ তাদের নিজেদের ছবি, অভিজ্ঞতা এবং মন্তব্য প্রদান করেছে, সাথে এই পাতার লোগো নিজেদের পাতায় যুক্ত করেছে। কেউ হয়ত মাথায় কাপড় দিতে পছন্দ করে, আবার অন্যরা তা পছন্দ করে না। কিন্তু সকলে এই বিষয়ে একমত যে কে মাথায় ঘোমটা দেবে, আর কে দেবে না, সেটি তার নিজস্ব অধিকার।
তাদের এই ফেসবুকের পাতায় লেখা আছে:
ঘোমটা দেওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রের এই জবরদস্তি নারীদের মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করেছে। প্রতিটি কোনায়, রাস্তায় এবং এলাকায় বিশেষ পুলিশকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে, সরকার নারীদের তাদের সংকীর্ণ মানসিকতার চিন্তাধারা এবং আদর্শকে গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প রাখছে না এবং এর ফলে নারীরা অনুভব করছে যে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছে এবং বস্তু হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও ইরানের নারীরা সবসময় এই অমানবিক আইন এবং এর ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছে এবং তা পালন করার ক্ষেত্রে অবাধ্য হয়েছে, তারপরেও যারা জোর করে এই সমস্ত আইন প্রয়োগ করে তারা কখনো এই থেকে শিক্ষা লাভ করে না এবং প্রতি বছর গরমের সময় আমরা নারীদের প্রতি ভয়াবহ হামলার কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করি।
ইরানের নারীদের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা এবং পোষাক পড়ার স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব প্রদান করে “ইরানিয়ান লিবারেল স্টুডেন্ট এন্ড গ্রাজুয়েট” সংগঠনটি “ বাধ্যতামূলক হিজাবকে প্রতি না বলুন” নামক প্রচারণা শুরু করেছে। এই প্রচারণায় যুক্ত হতে কিংবা এই প্রচারণাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আমরা স্বাগত জানাই।
নানে সারমা, সম্প্রতি ইরানের রাজধানী তেহরানের লালেহ পার্কে লব্ধ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন [ফার্সী ভাষায়]:
আমি আমার বন্ধুদের সাথে সেখানে ছিলাম এবং সে সময় আমরা হাসছিলাম, এমন সময় একটা বাতাস বয়ে গেল আর আমার মাথার কাপড় পড়ে গেল। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি তাদের আচরণ, তাদের হুমকি বা এই সমস্ত বিষয়ে কথা বলতে চাই না…কিন্তু তাদের প্রহরায় পার্ক থেকে বের হয়ে যাবার সময় এখানে আমি যা পর্যবেক্ষন করলাম তা তুলে ধরতে চাই। আমি দেখলাম একদল কিশোর, যাদের বয়স ১৩-১৪ বছর, তারা সিগারেট খাচ্ছে এবং লোকজনকে বিরক্ত করছে, কিন্তু এর জন্য নিরাপত্তা রক্ষীরা তাদেরকে সতর্ক করেনি বা ধমক দেয়নি। সেই একই নিরাপত্তারক্ষী, যারা এর আগের দিন ছেলে আর মেয়ে একসাথে ফুটবল খেলার জন্য আমাদের পার্ক থেকে বের করে দিয়েছিল। দৃশ্যত তারা মনে করেছিল যে আমরা ফাঁকা কিছু বাসা খুঁজে বের করব, সেখান গিয়ে ধূমপান করব এবং শারীরিক মিলনের মধ্যে দিয়ে আমাদের শক্তি ব্যয় করব।
ইরানের এক তরুণ কামাল লিখেছেন [ফার্সী ভাষায়]:
আমি এক মুসলমান এবং ধর্মীয় শিক্ষানুসারে আমি বলতে পারি যে কেউ জোর করে নারীদের উপর পর্দা চাপিয়ে দিতে পারে না।
নাফিসে লিখছে [ফার্সী ভাষায়], সে মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে একটি ছবি পোস্ট করে উল্লেখ করছে, যদিও আমি মুখে ঢেকে রেখেছি কিন্তু তারপরে তা কারো উপর চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার আমার নেই।
আফসানেহ বলছেন:
আমি চাই ইরান এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত হোক যেখানে হিজাব পড়া বাধ্যতামূলক নয়। যারা হিজাব পড়ার পক্ষে অথবা এর বিপক্ষে, তারা তাদের নিজেদের পোষাক বেছে নেবার মত স্বাধীন। সকলে একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং জীবন যাপনকে গ্রহণ করবে। এটা নারীদের সমস্যা নয়, যখন ( হয়ত সামান্য কয়েকজন) কিছু ভদ্রলোক নারীদের মাথায় কাপড় না দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ভদ্রলোকদের এই ধরনের যুক্তিতে অপমানিত বা আহত বোধ করা উচিত নয়।
আমির লোহরাসবি ইতিহাসের একটি সময়ের কথা পুনরায় স্মরণ করেছেন, সেটি হচ্ছে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের শুরুর সময়, যে সময়টায় ইরানের সংবাদপত্র ইত্তেলাত, বিপ্লবের অন্যতম এক নেতৃস্থানীয় নেতা আয়াতোল্লাহ মাহমোদ তেলাঘানির বক্তব্য উদ্ধৃত করে যিনি বাধ্যতামূলক হিজাব পড়াকে প্রত্যাখান করেছিলেন এবং বিপ্লবের পক্ষের একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন যারা আসলে নারীদের মাথায় কাপড় না দেওয়া নিয়ে মাথা ঘামায়, তারা আসলে প্রতিবিপ্লবী।
বাধ্যতামূলক ভাবে মাথায় কাপড় দেওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয় ৩৩ বছর আগে যখন ইরানের সাহসী নারীরা মার্চ, ১৯৭৯-তে এর বিরুদ্ধে তেহরানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং শাসক-পন্থী সেনাদের দ্বারা প্রহৃত হয়। নিপীড়নের জয় হয়, মাথায় কাপড় দেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়, কিন্তু নিপীড়নের মাঝেও নারীদের স্বাধীন ইচ্ছের বিষয়টি উন্মোচিত হতে থাকে।