পাকিস্তান: ১১ বছর বয়সী খ্রীস্টান বালিকা ব্লাসফেমির অপরাধে অন্তরীণ

১১ বছর বয়সী খ্রিস্টান বালিকা রিমশা মাসিহকে ব্লাসফেমির অভিযোগে অভিযুক্ত করে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী রাওয়ালপিন্ডির যুব কারাগারে ১৪ দিনের অন্তরীণ রাখা হয়েছে।  তাঁরডাউন সিনড্রোম আছে কি নেই তা নিয়ে বিতর্কিত খবর আসছে।

আরবি শিক্ষার প্রাথমিক বই নূরানী কায়দা, পুড়িয়ে প্লাস্টিক ব্যাগে ভরার অপরাধে রিমশাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। জি- ১২, ইসলামাবাদের মেহেরাবাদি বস্তিতে গত ১৬ আগস্ট ২০১২ তারিখে এ ঘটনা ঘটে। সেখানে সে তার পরিবারের সাথে থাকত। একজন স্থানীয় প্রতিবেশী তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানানোর পর স্থানীয় পুলিশ তার বিরুদ্ধে প্রথম তথ্য প্রতিবেদন (এফ আই আর) দাখিল করে।

ব্লাসফেমি অপরাধ পাকিস্তান পেনাল কোডের ২৯৫-বি ধারার অন্তর্ভুক্ত, এতে অপরাধীর যাবত জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। সংবাদটি ১৮ আগস্ট‘ক্রিশ্চান ইন পাকিস্তান’ নামের একটি ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়।

পাঁচ দিন পর ২২ আগস্ট তারিখে পাকিস্তানের প্রধান প্রচার মাধ্যমগুলোতে এ প্রতিবেদন বড় সংবাদ আকারে প্রকাশিত হয়। তাঁকে গ্রেফতারে দাবিতে স্থানীয় কিছু এলাকায় রাজধানীর প্রধান সড়ক অবরোধ করা হয়। উশৃঙ্খল জনতা আপাতভাবে তাঁরা নিজেরাই বিচার করতে চাইছিল। গত মাসে উশৃঙ্খল জনতা   বাহাওয়ালপুরে মানসিকভাবে অপ্রকৃতস্থ একজনকে পুড়িয়ে হত্যা করে; ঐ ব্যক্তিও ব্লাসফেমির অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন।

পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ পল ভাট্টি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন ব্লাসফেমির অভিযোগে ১১ বছর বয়স্ক ঐ বালিকার গ্রেফতারের পর ইসলামাবাদে ৬০০ খ্রিস্টান বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। খ্রিষ্টানরা ভয় পেয়ে লুকিয়ে আছে;  ২০০৯ সালের গোজরা আক্রমণ এখনো তাঁদের মনে তাজা রয়েছে ঐ ঘটনায় মুসলিম উশৃঙ্খল জনতা খ্রিষ্টানদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়, পুলিশ খ্রিষ্টানদের কোন সাহায্য করে নি। পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের মতে গোজরা দাঙ্গা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং এতে স্থানীয় প্রশাসন জড়িত ছিল।

এ ঘটনাটিকে  সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাসকারী পাকিস্তানী খ্রিস্টান এন্থনি পারমাল টুইটার ব্যবহারকারীদের নজরে আনেনঃ

@এন্থনিপারমাল: নিশ্চিত –  ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ১১ বছর বয়সী খ্রিস্টান বালিকাকে ব্লাসফেমির অপরাধে # পাকিস্তানের পুলিশ গ্রেফতার করেছে।

রিমশার রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য ইতোমধ্যেই অনলাইন দরখাস্ত চালু করা হয়েছেঃ

@মহসিনসাইদ (মহসিন সাইদ): রিফতা এবং তাঁর পরিবারের জীবন রক্ষার জন্য আওয়াজ তুলুন। ধর্ম নিরপেক্ষ কোন দেশে পালিয়ে যাওয়াই একমাত্র উপায়। তাঁরা তাঁকে হত্যা করবে: http://www.change.org/petitions/high-commissions-and-diplomats-of-secular-western-nations-asylum-to-the-family-of-11-year-old-christian-girl-accused-of-blasphemy# …

অনলাইন দরখাস্তে রিমসার পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য ধর্ম নিরপেক্ষ পশ্চিমা দেশগুলোকে অনুরোধ করা হয়:

শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন পাকিস্তানীরা এই দরখাস্তে স্বাক্ষর করেছেন কারন নিষ্ঠুর ব্লাসফেমি আইনের বিরুদ্ধে কথা বলা নিজের গভর্নরকে পাকিস্তান রাষ্ট্র সুরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে- যে রাষ্ট্রে ব্লাসফেমির সামান্য অপরাধে কারাবন্দিত্ব থেকে আরও খারাপ কিছুও ঘটতে পারে।

অন্য আরেকটি দরখাস্তে পাকিস্তানের মানবাধিকার মন্ত্রীকে রিমসা মাসিহকে মুক্তি ও সুরক্ষা প্রদানের আহ্বান জানানো হয়েছে।

ইতোমধ্যেই পাকিস্তানী রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার জন্য কর্মকর্তাদের ডেকেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত টুইট করেন:

@শেরিরেহমান: ব্লাসফেমির দায়ে অভিযুক্ত ছোট খ্রীস্টান বালিকার গ্রেফতারের বিষয়টিকে রাষ্ট্রপতি জারদারি গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন এবং প্রতিবেদন চেয়েছেন।

পাকিস্তানকে ব্লাসফেমী আইন সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল:

@এমনেস্টি (অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল): # পাকিস্তানের  উচিত জীবন সংকটে থাকা ‘ব্লাসফেমিতে’ অভিযুক্ত  গ্রেফতার হওয়া খ্রীস্টান বালিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা http://owl.li/d9aPc

ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মেয়েটিকে মুক্তি প্রদানের জন্য পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছে। ‘আল্লাহ, স্বাধীনতা এবং ভালবাসা’ গ্রন্থের রচয়িতা মুসলিম নারীবাদী লেখিকা ইরশাদ মানজি পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের নিন্দা জানিয়েছেন।

@ইরশাদমানজি: আমার @আরএফআই_ ইংরেজী সাক্ষাতকার পরিচালিত হয়েছে #পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনে অভিযুক্ত  #রিমসা নামের # খ্রিস্টান মেয়েটিকে কেন্দ্র করে:

টুইটারে পাকিস্তানী মানবাধিকার প্রচার কর্মী, সক্রিয়তাবাদী এবং কিছু রাজনীতিবিদ এ পরিস্থিতির নিন্দা জানিয়েছেন।

@আলি_ আব্বাস _জাইদি (সৈয়দ আলি আব্বাস জাইদি): # পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের সবচাইতে করুণ ছোট গল্প হল: “সে মাত্র ১১ বছর বয়সী।”

@মাহীনআখতার (মাহীন আখতার): পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির সুও মোটো গেল কই, তিনি কি ঘুমাচ্ছেন… ও আচ্ছা এটা ‘ব্লাসফেমি”

@বীনাসারোয়ার (বীনা সারোয়ার): ‘ব্লাসফেমি’তে অভিযুক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল  অভিযুক্তের মনোভাব বা নিয়ত। যা যে কোন অভিযুক্তই অস্বীকার করতে পারে। #পাকিস্তান

ক্ষমতাসীন দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং পাকিস্তান তেহরিক ইনসাফ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। পিটি আই নেতা ইমরান খান টুইট করেন।

@ইমরানখানপিটিআইঃ  লজ্জাজনক! ১১ বছরের একজন বালিকাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে যা ইসলামের মর্ম দয়া ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থী । ১/২

@সুন্দাশহুরাইন: ব্লাসফেমির দায়ে অভিযুক্ত ১১ বছর বয়সী বালিকাকে মারপিট করা ও গ্রেফতার করার বিষয়ে পি এম এল- এন এর কাছে থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ ও শাস্তি প্রদানের আশা করে @সিএমশেহবাজ এখনও অপেক্ষা করছেন #ফ্রিরিমশা

অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। এটাকে স্পর্শকাতর বিবেচনা করা হচ্ছে। যদিও কেউ এ আইনকে বাতিল করার কথা বলে নি।

@এন্থনিপারমাল: আমরা ব্লাসফেমী আইন বাতিল করতে পারি না। ক) জনতা কোন সংশয় ছাড়াই নজরদারি চালাবে খ) পুলিশরা শিয়াদের হত্যা করবেই, তাহলে কিভাবে সম্ভব?

২০১০ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রদূত শেরি রেহমান ‘ব্লাসফেমী আইন সংশোধন অধ্যাদেশ ২০১০’  জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর ইসলামী মতাদর্শ কাউন্সিল প্রস্তাবিত সংশোধনী এ আইনের অপব্যবহার রোধ করবে বলে ঘোষণা করে। কিন্তু সংসদের অন্যান্য ধর্মীয় দলগুলো- জামাত-ই-ইসলামী, জামিয়াত উলেমা- ই- ইসলাম পাকিস্তান, সুন্নী তেহরিক এবং অন্যান্যরা ব্যাপক গণ সমাবেশের হুমকী দেয়। পরবর্তীতে শেরি রেহমানকে মৃত্যু হুমকী দেওয়া হয় এবং তিনি গৃহ বন্দী থাকেন।

সালমান তাসিরের হত্যাকারী মুমতাজ কাদরির মুক্তির সমর্থনে পাকিস্তানের হায়দারাবাদে সুন্নী তেহেরিক পার্টির মিছিল। ছবি- রাজপুত ইয়াসির, স্বত্ব ডেমোটিক্স (০৯/০১/২০১১)

সালমান২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে  পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের সোচ্চার সমালোচক পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসীরকে তাঁর নিজের দেহরক্ষী মুমতাজ কাদরী প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনাচক্রে রিমসাকে আদিয়ালা জেল যেখানে কাদরি থাকে সেখানেই পাঠানো হয়েছে। কাদরিকে যখন বিচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তখন তার সমর্থকেরা তাকে গোলাপ পাপড়ি ছিটায়

হাফিংটন পোস্ট- এর জন্য লেখা মালিক সিরাজ আকবর তার ব্লগে বলেন যে পাকিস্তানী সমাজে বৈষম্যমূলক আইন গেড়ে বসেছে:

এ ধরণের প্রায়শ:ই সংগঠিত অস্বস্তিকর ঘটনার পরেও ব্লাসফেমির সাথে সম্পর্কিত ও ভীষণ ভাবে দ্ব্যর্থ বোধক বৈষম্যমূলক আইন সংস্কারে কোন অগ্রগতি নেই। এ ধরণের আইনগুলো একদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক অন্যদিকে এটা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও উন্মাদনাকে পাকিস্তানী সমাজের আরও গভীরে প্রবেশ করায়।

মেহেদি হাসান তাঁর ব্লগে লিখেন:

ব্যক্তিগত ভাবে আমি কখনোই বুঝতে পারি না যে আমার ধর্মের লোকেরা কেন ইসলাম, নবী মোহাম্মদ (সাঃ)  এবং কোরান‘ অবমাননা’ কারীদের হত্যার জন্য অতি উৎসুক। তাদের এত সাহস এবং উষ্মার পেছনের কারন কি, এটা কী নিরাপত্তাহীনতা? তাদের ঈশ্বর কী এত দুর্বল, এত স্পর্শকাতর, এতই মূল্যবান যে তিনি কোন প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারেন না?

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .