আমাদের এই পোস্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিশেষ কভারেজ এর অংশ।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার পরিচিতি শুধু চিকচিকে বালুকাভুমি, মন্দির আর চমত্কার সব রিসোর্ট দিয়েই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এলাকা হিসেবেও এর খ্যাতি রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত শতকে সবচেয়ে বেশি বোমা পড়েছে যে দেশগুলোতে তারমধ্যে লাওস, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনাম অন্যতম। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকা লাওসে যত গুচ্ছ বোমা মেরেছে, তার এক-তৃতীয়াংশ বোমা বিস্ফোরিত হয় নি, এগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অক্সফার্ম ইন্টারন্যাশনালের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ প্রচারণা কার্যক্রমের প্রধান আনা ম্যাকডোনাল্ড লাওসের গ্রামের ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরেছেন:
প্লেনে করে আমরা জিয়াং খোয়াং প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গেলাম। মাঠে জলহস্তী চড়ছে। চারপাশজুড়ে সবুজ ধানক্ষেত। পাহাড়ি গ্রামের কৃষকদের চাষের জমিগুলো আঁকাবাঁকাভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। আর আছে বংশ পরস্পরা বসবাস করে আসা কাঠের পাহাড়ি বাড়িগুলো। খুব সুন্দর ছবির মতো একটা গ্রাম। কিন্তু এ ছবিও যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ঢেকে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। গ্রামের মাঠ-ঘাটসহ সর্বত্র ছড়ানো রয়েছে অবিস্ফোরিত বোমাগুলো।
এই অঞ্চলে যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিভীষিকা চলছে, তখন থেকেই দক্ষিণপূর্ব এশিয়া যুদ্ধের তাজা ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে, যার যত্নআত্তির খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এর পরিবর্তে ঘটে উল্টোটা। মিয়ানমার থেকে স্বাধীনতা চেয়ে বসে কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি। স্বাধীনতার দাবিতে তাদের ৬০ বছর ধরে চলা গণযুদ্ধ বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় ধরে চলা যুদ্ধ।
থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমার সীমান্তে বসবাসকারী নিরপরাধ সাধারণ নাগরিকদের ওপর যুদ্ধের প্রভাব কী রকম পড়েছে তা তুলে ধরেছেন বার্মা ম্যাটার:
সৈন্যরা আসার আগেই নিয়ম করে প্রতিবছর তিন/চারবার তাদের বাড়িঘর ছাড়তে হয়। এ সময়ে তারা ব্যাগে করে সামান্য কিছুই সঙ্গে নিতে পারে। প্রত্যেকবারই হাজার হাজার গ্রামবাসী প্রতিকুল বনের গভীরে যেতে বাধ্য হয়, যাতে সৈন্যরা তাদের খুঁজে না পায়। এই পলায়নকালে তারা খুব কম পরিমাণ খাবার পায়। তাদের জীবন কাটে খুবই নাজুক আশ্রয়কেন্দ্রে।
ইরাওয়াদ্দির ভাষ্যমতে, এই গৃহযুদ্ধের সময়ে পূর্ব এবং দক্ষিণপূর্ব মিয়ানমারে আনুমানিক ৪ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন এবং মিয়ানমার কেন্দ্রিয় সরকারের মধ্যে অস্ত্রবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু দুপক্ষই চুক্তি লংঘন করছে।
১৯৬৯ সাল থেকে ফিলিপাইনের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সশ্রস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের ইতিহাসে কমিউনিস্টদের এটাই সবচেয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা সশ্রস্ত্র আন্দোলন।
নিচের ছবিতে রেড আর্মির নারী যোদ্ধাদের দেখা যাচ্ছে। তারা মিন্দানাও দ্বীপে পার্টির বর্ষপূর্তি উদযাপন করছে।
বর্তমানে ফিলিপাইন সরকার এবং কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের মধ্যে শান্তি আলোচনা ভেস্তে গেছে। দেশকে অনুন্নত রাখার জন্য সরকার কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের দোষারোপ করেছে। তারা তাদের অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা অর্থ জোগাতে কিডন্যাপ এবং বলপ্রয়োগ করে অর্থ আদায় করছে। ইতোমধ্যে বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, গত চার দশকে তারা সরকারি সামরিক অভিযান থেকে বেঁচে গেছে। কারণ জনগণ তাদের সমর্থন দিচ্ছে।
মিন্দানাও-এ সংঘর্ষের কারণে হাজার হাজার গ্রামবাসী তাদের বাড়িঘর থেকে পালিয়ে গেছে। পালিয়ে যাওয়া এই উদ্বাস্তু মানুষদের ব্যঙ্গ করে ‘ব্যাকউইট’ ডাকা হয়। সোসাইটি অব দ্য ডিভাইন ওয়ার্ল্ড (এসভিডি) এর এফআর ফেলমার ক্যাস্ট্রোডেস ফিয়েল ‘ব্যাকউইট’রা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন, তা বর্ণনা করেছেন:
… এই বিদ্রোহে কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, ২০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে, ৫০০ মসজিদ, ২০০ স্কুল, ৩৫টি শহর ধ্বংস হয়ে গেছে।
মিন্দানাও-এ ‘ব্যাকউইট’ খুবই জনপ্রিয় একটা শব্দ। এটা বলতে বুঝায় তাদেরকে যারা যুদ্ধে কোনো পক্ষকে সমর্থন না করেই ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে। তারা আসলে যুদ্ধের মাঝে পড়ে স্যান্ডুইচ হয়ে গেছে।
দক্ষিণ থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ ফিলিপাইনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে থাইল্যান্ডের ইসলামী বিদ্রোহ তীব্র হয়ে উঠছে। কিছু কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, অতি শিগগিরই এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো বিদ্রোহ হয়ে দেখা দিবে।
সারাবিশ্বের পত্রপত্রিকাসমূহে মাঝেমধ্যে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সংঘর্ষ নিয়ে সংবাদ দেখা যায়। এই দুভার্গ্যকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বৈশ্বিক সংলাপের মাধ্যমে সংঘর্ষের কারণ বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
1 টি মন্তব্য