ভারত ছাড়া বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাম মায়ানমার। সীমান্ত ভাগাভাগি করা ছাড়াও, এই দুটি রাষ্ট্রের সীমান্ত এলাকায় বাস করা জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্ম এক। সম্প্রতি মায়ানমারে রাখাইন প্রদেশে জাতিগত দাঙ্গার কারণে এই সমস্ত মানুষগুলো এখন অসহায় অবস্থায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের সে দেশে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না, যার ফলে এই সমস্ত উদ্বাস্তুরা এখন সমুদ্রে ভাসছে।
মূলত মায়ানমারে জাতিগত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার পর, সেদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজন প্রাণ ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে। সর্বস্ব হারানো এই সব নাগরিকরা কেবল প্রাণটুকু সম্বল করে, সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু স্থল সীমান্ত অনেক বেশী দুর্গম হওয়ার কারণে, পাশাপাশি নৌপথে যাতায়াতের সুবিধার কারণে তারা নৌকায় করে নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার স্পষ্টত জানিয়ে দেয় যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা প্রতিহত করবে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) গত ১২/৬/২০১২ তারিখে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দিতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানায়। একই সাথে জাতি সংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংগঠন ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশের প্রতি এই আহবান জানায়, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তার অবস্থানে অনড় থাকে। যার ফলে আশ্রয় প্রার্থী রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে এক চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে সাগরে ভাসছে।
১৪ জুন ২০১২ তারিখে স্থানীয় পত্রিকা মারফত জানা যায় যে বিগত তিন দিনে ৭৬৮ জন রোহিঙ্গাকে অনুপ্রবেশের সময় আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কিন্তু মায়ানমারের তারা ফেরত যেতে পারেনি কারণ সেখানে মৃত্যু তাদের তাড়া করেছে, যার ফলে এই সমস্ত নাগরিকরা এখন সমুদ্রে ভাসছে।
নাসিরুদ্দিন হোজ্জা বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের কারণ এবং রোহিঙ্গাদের বাস্তবতার কথা তুলে ধরেছেঃ
এক সময় বার্মার আরাকান এবং বর্তমানে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের সে দেশের সামরিক সরকার বহিরাগত বাঙ্গালী বলে অভিহিত করে। যার ফলে এই সমস্ত নাগরিকরা একবার যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তাহলে ভবিষ্যতে মায়ানমারের কোন সরকার তাদের গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হবে না, বরঞ্চ আগামিতে তারা আরো জোরালো ভাবে বাঙ্গালী অভিবাসনের অভিযোগ করবে এবং বিষয়টি দুটি দেশের সরকারের মাঝে জটিলতা আরো বৃদ্ধি করবে।
একই সাথে বাংলাদেশ জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত একটি দেশ, এর আগেও এদেশে ১৯৭৮ সাল বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৫ লাখ-এর মত রোহিঙ্গা বাংলাদেশ প্রবেশ করে, কিন্তু পরবর্তীতে মায়ানমার সরকার বাংলাদেশর প্রদত্ত সংখ্যা মেনে নিতে অস্বীকার করে। এবং এই ঘটনার পর বেশ কিছু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশে থেকে যায়”।
এখন নতুন করে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর প্রবেশে দেশটির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করবে!আবার অভিযোগ রয়েছে যে জামাত-এ –ইসলাম নামক সরকার বিরোধী দল রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে সশস্ত্র করছে, যার ফলে সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাকে আর বাড়তে দিতে ইচ্ছুক নয়।
নাসিরুদ্দিন হোজ্জা জানাচ্ছেন কেন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পাড়ি জমাচ্ছে,
কিন্তু মায়নমারের বাস করা রোহিঙ্গার এই সব রাজনীতির অনেক বাইরে। একজন রাখাইন নারীকে রোহিঙ্গারা ধর্ষণ করেছে এই অভিযোগে আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণের মধ্যে রাখাইন এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলে আরাকানী বাংলাভাষী এবং মুসলিম সংখ্যালঘু এই সব মানুষগুলোর জন্য নরকের দ্বার খুলে যায়।
তারা পালাচ্ছে, কারণ তারা জানে যে জীবন বাঁচাতে হবে আগে। সব সম্বল ত্যাগ করে কেবল একটা নৌকায় করে তারা এমন একটা রাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে, যে রাষ্ট্রটি তাদের স্বদেশভুমি নয়, যেখানে তাদের কোন আত্মীয় নেই, কোন স্বজন নেই, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা পথ পাড়ি দেওয়া কষ্টকর, তাই নৌকায় করে নাফ নদী দিয়ে তারা আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে একমাত্র প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ আশ্রয়ের সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছে।
তিনি লিখেছেন, কিন্তু তাদের দুর্দশা কমছে না:
“তারা নৌকায় করে-এ পারে আসছে, কিন্তু পাড়ে ভিড়তে পারছে না, কারণ পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড, যারা মানবিক, কিন্তু রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কাছে অসহায়। তারা যে টুকু পারছে নৌকায় কিছু খাবার দিয়ে আবার এই সব মানুষদের সমুদ্রে ঠেলে দিচ্ছে”।
যদিও বাংলাদেশে সরকার রাজনৈতিক কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের বিপক্ষে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিশাল একটা অংশ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দানের পক্ষে।
সামহয়্যারইন নামক কমিউনিটি ব্লগে আরিফ, কেন আরাকানের নাগরিকরা বিশেষ করে বাংলাদেশে আসছে তাঁর কারণ জানাচ্ছে:
“মিয়ানমারে বৌদ্ধ মুসলমান সংঘর্ষ চলছে। বৌদ্ধরা যারা দূর্বল তারা অন্য প্রদেশে পালিয়ে যাচ্ছে। সংগত কারণেই মুসলিমরা সেই দেশে যেতে পারছে না আসছে বাংলাদেশে।“
সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশেও উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে দেওয়াটাকে তিনি অমানবিক মনে করেন
বাংলাদেশে এভাবেই নানান সমস্যা রোহিঙ্গাদের নেয়া সম্ভব না। কথা একটুকুও মিথ্যে নয়। কিন্তু আমরা কি এতই নিষ্ঠুর হয়ে গেছি যে লোকগুলোকে মূত্যু মুখে ফেরৎ পাঠাচ্ছি?
ফেসবুকে আনোয়ার হোসেন ফারমার লিখেছে:
ন্যূন্যতম মানবতাবোধ থাকলেও রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পূণরায় মৃত্যুর মুখে ফিরিয়ে দেওয়া যায়না।
কেননা পৃথিবির সব মানুষেরই আছে মানবিক অধিকার,প্রত্যেকটি ভুখন্ডে। সভ্য জাতি মাত্রই তা বুঝতে পারে,অসভ্যরা নয়!
মনে রাখতে হবে,এটি ব্যাবসায়িক কারবার নয়,বরং মানবিক দায়ভার।
রোহিঙ্গাদের এই বিপর্যয়ের পেছেন অনেকে মায়ানামারের নেট নাগরিকদের ভূমিকাকে দায়ী করে, এই ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের জন্য ভিন্ন এক সাহায্যে প্রস্তাব নিয়ে অনেকে এগিয়ে এসেছেন। সামহোয়্যার ইন-গ্রুপ ব্লগে তোমদাচি একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, যার “এটি হতে পারে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার এক কার্যকর উপায়” শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন:
এই দাঙ্গা রহিঙ্গা ও রাখাঈনদের মধ্যে বাধলেও এখানে সারা মিয়ানমারের লোকজন মূলত রাখাইনদের পক্ষ অবলম্বন করেছে। আমার কিছু মিয়ানমার ফ্রেন্ডদের দেখছি ওরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ইন্টারনেটে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের ভাষায়, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক, তারা মিয়ানমারে এসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে, তারা রাখাইন দের ২০ টি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে … ইত্যাদি, ইত্যাদি। অপরদিকে, রোহিঙ্গারা অবহেলিত অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী; তাদের পক্ষে কথা বলার লোকের খুব অভাব, আমরা এবিষয়ে তাদের কিছুটা সাহায্য করতে পারি।
সামহোয়্যারইন ব্লগে আমরা কাঠের ঢেকি নামে লেখা ব্লগার মিল্টন দুটি ছবি প্রদর্শন করে লিখেছেন।
অনুরোধ করবো ছবি দুটো দেখেন। দুটি ছবি কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের। কিন্তু দুটোর ছবির কিন্তু ভাষা একই। অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্যের আবেদন, চোখে অনিশ্চয়তার ভাষা, সব হারানোর ব্যথা, ক্ষুধাপীড়িত চাহনি।
প্রথম ছবিটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কোন এক সময়ের (একটি শিশু তার মায়ের কোলে কাঁদছে) দ্বিতীয় ছবিটি খুবই সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশ যারা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশের জলসীমানা দিয়ে ঢুকে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। ছবিটির শিশুগুলোর দিকে একটু খেয়াল করেন। অবুঝ, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
মানুষ মানুষের জন্য
সিবিএনবিডি.কম এর এক সংবাদে জানা যাচ্ছে খালি নৌকায় পাওয়া এক রোহিঙ্গা শিশুর কথা
সীমান্তবর্তী নাফ নদীতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি নৌকা থেকে একটি শিশুকে উদ্ধার করেছে বিজিবি সদস্যরা। বুধবার দুপুরে শিশুটিকে একটি খালি নৌকা থেকে উদ্ধার করা হয়। মাত্র দেড় মাস বয়সী হতভাগ্য মেয়ে শিশুটিকে টেকনাফের একটি বাংলাদেশী পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেই পরিবারের সদস্যরাই শিশুটিকে দেখভাল করছে। তবে শিশুটি ভয়াবহ রকমের অসুস্থ ও ভগ্ন স্বাস্থ্যের বলে জানিয়েছে পরিবারটি।
এই বাংলাদেশী পরিবারের প্রচেষ্টা কেবল একটি শিশুকে নয়, যেন বিপন্ন মানবতাকে বাঁচানোর চেষ্টা, বেঁচে থাকা এই পৃথিবীর জন্য যার খুব জরুরী।